ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দিনাজপুরে ড্রেজার মেশিন দিয়ে চলছে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের মহাউৎসব

প্রকাশিত: ০৮:৪৬, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯

দিনাজপুরে ড্রেজার মেশিন দিয়ে চলছে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের মহাউৎসব

স্টাফ রিপোর্টার, দিনাজপুর ॥ অবৈধভাবে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলনের মহাউৎসব চলছে দিনাজপুরের ফুলবাড়ী ও বোচাগঞ্জ উপজেলায়। এতে করে বাঁধ ভেঙ্গে নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা দিয়েছে ফসলী জমি। নদী থেকে অবৈধভাবে প্রকাশ্যে বালু উত্তোলন করা হলেও কোন ধরনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি প্রশাসন। শুধু অবৈধভাবে বালু উত্তোলনই নয়, বালু ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমত বালুর মূল্য বৃদ্ধি করে বিক্রি করছে। যাতে করে একদিকে ফসলী জমি হারানোর ভয়ে রয়েছে কিছু মানুষ, অন্যদিকে জিম্মি হয়ে পড়েছে বালু বহনকারী ট্রাক্টর মালিক-শ্রমিকসহ সাধারন মানুষ। ফুলবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলার ছোট যমুনা নদীর রাজারামপুর মৌজার বেলতলী ঘাট ও গোপালপুর ঘাট বালুমহাল হিসেবে ইজারা নিয়েছেন ইমরুল হুদা চৌধুরী ইনু নামের এক ব্যক্তি। অথচ বালু উত্তোলন করা হচ্ছে বেলতলী ঘাট, গোপালপুর ঘাট, শিবনগর মৌজার গঙ্গাপ্রসাদ ঘাট, মৎস্যর বিল, খয়েরবাড়ী মৌজর মহদিপুর ঘাট, জমিদারপাড়া ঘাট, দৌলতপুর বারাইপাড়া ঘাট, জানিপুর ঘাট এলাকা থেকে। আর এসব ঘাট থেকে বালু উত্তোলনে বেশিরভাগ এলাকায় ব্যবহৃত হচ্ছে অবৈধ ড্রেজার মেশিন। এসব ঘাট ইজারা না নিয়েও সাব ইজারা হিসেবে তিনি অন্য ব্যক্তিদের দিয়ে বালু উত্তোলন করছেন। এদিকে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করায় নদী গর্ভে বিলীন হতে চলেছে নদীর বাধসহ ফসলী জমি। উপজেলার খয়েরবাড়ী গ্রামের আফছার আলী বলেন, নদী গর্ভে জমি চলে যাচ্ছে। বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনকে অবহিত করা হয়েছে। রাজারামপুর গ্রামের আবু বকর বলেন, ইতিমধ্যেই তার প্রায় এক বিঘা জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বালু উত্তোলন কার্যক্রম বন্ধ করা না গেলে যে জমিটুকু আছে সেটিও চলে যাবে। বালু উত্তোলনের কারনে গত বছরে বন্যায় তাঁর প্রায় এক একর ফসলী জমি নদিতে বিলিন হয়ে পড়েছে, এই বিষয়ে তিনি উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর লিখিত অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পাননি বলে অভিযোগ করছেন শিক্ষক হামিদুল হক। বারাইপাড়া ঘাট থেকে বালু উত্তোলন করছেন বাবলু মিয়া। তিনি বলেন, প্রতিমাসে ৪০ হাজার টাকা চুক্তিতে বালুমহল ইজারাদার ইনুর কাছ থেকে তিনি এই ঘাটটি সাব-ইজারা নিয়েছেন। জমিদারপাড়া ঘাটের বালু উত্তোলনকারী মতিয়ার রহমান বলেন, জমিদার পাড়া ঘাট থেকে বালু উত্তোলনের জন্য প্রতিমাসে ৩০ হাজার টাকা করে দিতে হয় বালুমহলের ইজারাদার ইমরুল হুদা চৌধুরী ইনুকে। অর্থের বিনিময়ে সাব ইজারা গ্রহনের কথা জানিয়েছেন মহদিপুর ঘাটের বালু উত্তোলনকারী মুরাদ হোসেনও। ইজারা না নিয়েও অতিরিক্ত স্থান থেকে বালু উত্তোলনের ব্যাপারে বালুমহল ইজারাদার ইমরুল হুদা চৌধুরী বলেন, মাত্র দুটি ঘাট থেকে বালু উত্তোলন করে ইজারা মূল্য পরিশোধ করা কঠিন, তাই তিনি ওইঘাট গুলো সাব-ইজারা প্রদান করেছেন। এদিকে জেলার বোচাগঞ্জ উপজেলার টাঙ্গন নদীতে সুকদেবপুর মৌজার পারঘাটা ব্রীজ সংলগ্ন এলাকায় সরকারি নির্দেশনা না থাকার পরও অবৈধভাবে ড্রেজার ও বোমা মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করছে। স্থানীয়রা জানিয়েছে, এভাবে বালু উত্তোলন করায় হুমকীর মুখে পড়েছে পারঘাটা ব্রীজ ও চলাচলের রাস্তা। জানা গেছে, বোচাগঞ্জ উপজেলাধীন টাঙ্গন নদীর পারঘাটা বালুমহালটি ইজারা দেয়া হয় বিরল উপজেলার পাইকপাড়া গ্রামের আলাউদ্দীনকে। বোচাগঞ্জ উপজেলার কুকুড়াডাঙ্গী, কোদালকাঠী ও সাদামহল মৌজার কয়েকটি অংশ থেকে বালু উত্তোলন করার কার্যাদেশ দেওয়া হয় উক্ত কাজের ঠিকাদার আলাউদ্দীনকে। কিন্তু ঠিকাদার হযরত আলী নামে একজনকে সাব লিজ প্রদান করেন। বর্তমানে সাব ঠিকাদার হযরত আলী নিজ ক্ষমতা বলে পারঘাটা ব্রীজ সংলগ্ন স্থান থেকে অবৈধভাবে ৩ টি ড্রেজার মেশিন ও ১টি বোমা মেশিনের মাধ্যমে বালু উত্তোলন করছেন। এলাকাবাসীর অভিযোগে, এতে করে ব্রীজটি যেমন হুমকীর মুখে পড়েছে একইসাথে হুমকীর মুখে পড়েছে সুকদেরপুর বাধ ও পাকা সড়কটি। এছাড়া অবৈধভাবে বোমা মেশিন ও ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করার ফলে নদীর ভূগর্ভস্থ দেবে গিয়ে ফসলী জমি নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এলাকার সিরাজুল ইসলাম জানান, এভাবে বালু উত্তোলন করা হলেও এ ব্যাপারে কেউ কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। এই বালু উত্তোলনের ফলে বাধ ও রাস্তার ক্ষয়ক্ষতি হলে দূর্ভোগে পড়তে হবে সাধারন মানুষকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান, এই কার্যক্রমের ফলে আবাদি জমিরও ক্ষতি হতে পারে। ব্রীজটিও সমস্যায় পড়তে পারে। সকলেই বিষয়টি অবগত কিন্তু কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও কোন পদক্ষেপ নেই। এ ব্যাপারে বালু উত্তোলনকারী হযরত আলীর সাথে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার ব্যবহৃত মোবাইলটিও বন্ধ পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে বোচাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফকরুল হাসানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমরা দেখছি। কোন অনিয়ম পাওয়া গেলে বালু উত্তোলন বন্ধ করে দেয়া হবে।’ এদিকে বালু ব্যবসায়ীরা তাদের ইচ্ছামত বালুর দাম নির্ধারণ করে জিম্মি করে ফেলেছে বালু বহনকারী ট্রাক্টর মালিক শ্রমিকদের। ফুলবাড়ী উপজেলা ট্রাক্টর মালিক সমিতির সাধারন সম্পাদক মকলেছার রহমান সরকার জানান, কিছুদিন আগে এক ট্রাক্টর বালুর দাম ছিল ৩৫০ টাকা। কিন্তু এখন নেয়া হচ্ছে ৭০০ টাকা। ট্রাক্টর মালিক শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা অধ্যক্ষ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রতি মাসেই ইজারাদাররা তাদের ইচ্ছেমত বালুর মূল্য বৃদ্ধি করলে। যাতে করে আমমরা জিম্মি হয়ে পড়েছি। অবৈধভাবে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলন ও বালুমহল ইজারাদারের দৌরাত্মর বিষয়ে ফুলবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুস সালাম বলেন, অল্প সময়ের মধ্যে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন কার্যক্রম বন্ধ করা হবে। দিনাজপুর জেলা প্রশাসক মাহমুদুল আলম বলেন, কেউই অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করতে পারবে না। যারা এসব কর্মকান্ড করছেন সেসব বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
×