ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

যুদ্ধকালীন উপদেষ্টা পরিষদ

প্রকাশিত: ০৯:১৬, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯

যুদ্ধকালীন উপদেষ্টা পরিষদ

১৯৭১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর দিনটি ছিল শুক্রবার। মতিগঞ্জে গেরিলা পাকসেনাদের একটি ক্যাম্পে অতর্কিত আক্রমণ করে একজন অফিসারসহ ১১ জন পাকসেনাকে হত্যা করে। পাকসেনাদের ক্যাম্প থেকে প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র দুটি মোটর সাইকেল, ৩টি রেডিও এবং তিন বাক্স ঔষধ উদ্ধার করে। মুক্তিফৌজের একজন যোদ্ধা এই সংঘর্ষে শহীদ হয়। মুক্তিফৌজের অপর একটি দল রাত ১০টায় নয়াপাড়ার শত্রুঘাঁটি আক্রমণ করে তাদেরকে সেখান থেকে বিতাড়িত করে। এখানেও মুক্তিফৌজের গেরিলারা বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নেয়। অপর একটি গেরিলা দল ফেনীর কাছে ফতেপুর রেলসেতু ডিমোলিশন লাগিয়ে উড়িয়ে দেয়। ফলে ৫০ ফুটের একটি খাদের সৃষ্টি হয় এবং লাকসাম-ফেনীর মধ্যে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া ফেনী শহরেও মুক্তিফৌজের গেরিলারা গ্রেনেড নিক্ষেপ করে পাকসেনাদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। গেরিলারা ফেনী থেকে ফুলগাজী পর্যন্ত পাকসেনাদের টেলিফোন লাইন কেটে তাদের টেলিফোন যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ফেনী থেকে পাকসেনারা তাদের অগ্রবর্তী অবস্থানগুলোতে ট্রলির সাহায্যে রসদ সরবরাহ করত। তাদের এই সরবরাহ বন্ধ করবার জন্য চিতলিয়ার কাছে ঘানিমোড় রেলসেতুটি উড়িয়ে দেয়ার জন্য মুক্তিফৌজের পাইওনিয়ার প্লাটুন পাঠানো হয়। এই প্লাটুনটি বিপদের ঝুঁকি নিয়ে রাতে পাকসেনাদের অবস্থানের পেছনে অনুপ্রবেশ করে। পরদিন সকালে তারা সেতুটি সম্পর্কে তথ্যানুসন্ধান চালিয়ে জানতে পারে পাকসেনারা সেতুটিকে কড়া প্রহরার ব্যবস্থা করেছে। অতি কষ্টে তারা মুহুরী নদী সাতরিয়ে রাতের অন্ধকারে সেতুটির নিচে ডিমোলিশন লাগিয়ে এই গুরুত্তপূর্ণ সেতুটি উড়িয়ে দেয়। ফলে ফেনী এবং বিলুনিয়াতে পাকসেনাদের ট্রলির সাহায্যে সরবরাহ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়। পাকহানাদার বাহিনী ময়মনসিংহ থেকে খাদ্য সম্ভার বোঝাই করে পাঁচটি বড় বড় নৌকায় ভালুকার দিকে অগ্রসর হলে কোম্পানী কমান্ডার চাঁন মিয়ার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদল ঝালপাজা গ্রামে তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এতে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা নৌকাসহ ৫৭০ মন আটা ও ২০ মন চিনি হস্তগত করে। এই আটা ও চিনি পরে রাজৈর ইউনিয়নের গরীব-দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। চাঁদপুরের হাজিগঞ্জে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা দল পাকবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। গেরিলা যোদ্ধারা পাকসেনাদের দুদিক থেকে আক্রমণ চালিয়ে পর্যুদস্ত করে। এতে ৩০ জন পাকসৈন্য নিহত হয় এবং বাকী সৈন্য অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে যায়। গেরিলা যোদ্ধারা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করে। ‘ডি’ কোম্পানীর ক্যাপ্টেন পাটওয়ারীর নেতৃত্বে কামালপুরের ১ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত ঘাসিপুর গ্রামে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। শত্রুপক্ষের দুই কোম্পানী সৈন্য মর্টার নিয়ে ঘাষিপুর আক্রমণ করে। ‘ডি’ কোম্পানী অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে এ আক্রমণ প্রতিরোধ করে ও তাদের আক্রমণকে ব্যর্থ করে দেয়। শত্রুপক্ষের প্রায় ৪০ জন সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিফৌজের পক্ষে তিনজন শহীদ এবং ৮ জন আহত হন। মুক্তিযোদ্ধারা পটিয়া থানার মালিয়া পাড়া গ্রামে ১১ জন মুসলিম লিগের দালাল কে হত্যা করে। ঢাকার সামরিক আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহিতা, অস্ত্রাগার লুন্ঠন, অননুমোদিত অস্ত্র বিতরণ, রাষ্ট্রবিরোধীদের ট্রেনিং প্রদান প্রভৃতি অভিযোগে আওয়ামী লীগের ১৪৫ জন এম.পি.এ কে সামরিক আদালতে হাজির হবার নির্দেশ দেয়। লেঃ জেনারেল নিয়াজী গাজীপুর অস্ত্র তৈরীর কারখানা পরিদর্শন করে অস্ত্রের প্রথম চালান তৈরী করার জন্য কারখানার শ্রমিক কর্মচারীদের ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, এতো শ্রমের তৈরী অস্ত্র দেশের শত্রুদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার হবে। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ২১ নং সামরিক আদেশকে পুর্ণগঠন করে ২৪ নং সামরিক আদেশ জারি দৈনিক নিউ স্টেটসম্যান ‘বাংলাদেশকে স্বাধীন করতেই হবে’ শিরোনামের সংবাদ থেকে জানা যায়, পিটার শোর যিনি সদ্যই ভারত সফর করে ফিরেছেন তিনি বলেন, বাংলার গুরুতর সঙ্কটের মূলে রয়েছে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাঙন। দুঃখজনক হলেও সত্য, গত বছরের নির্বাচন, যেটিতে বাংলা-ভিত্তিক আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয়ী হয় এবং এর পরবর্তীকালে সুদুর-পরাহত স্বায়ত্ত্বশাসন নিয়ে শেখ মুজিব এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের মধ্যকার আলোচনা, একক পাকিস্তান রক্ষার একটি শেষ সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। এই সুযোগটি নষ্ট হয়ে যায় শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য নয়, বরং এর আগেই প্রেসিডেন্টের তাঁর সামরিক বাহিনীকে দেয়া আওয়ামীলীগকে ধ্বংস করার এবং যা তারা জীবনেও ভুলতে পারবে না । টিক্কা খানের সৈন্যদের হিংস্রতা এমন এক শক্তিকে মুক্ত করেছে যা আজ হোক বা কাল শুধু ওদেরকেই নয় বরং পাকিস্তানকেই ধ্বংস করে দেবে। এখন বিশ্বের কাছে মূল প্রশ্ন, এটা নয় যে পাকিস্তান কিভাবে টিকে থাকবে বরং কিভাবে, অন্যান্য পরাশক্তির সাথে বিরোধের ইন্ধন না জুগিয়ে এবং বাংলার উপর আরো অসহ্য দুর্দশা না হেনে, বাংলায় তার শাসনের অবসান ঘটাবে। দমনপীড়ন এমন নিষ্ঠুরতার সাথে এবং এতো দীর্ঘ সময় ধরে চালানো হয়েছে যে মানুষ পালিয়ে গেছে, শুধু তাদের বাড়িঘর থেকে নয় বরং তাদের দেশ থেকে অবিশ্বাস্য হারে গত ৫ মাস ধরে প্রতিমাসে ১৫ লক্ষ করে এবং এখনো যা কমার কোনো লক্ষন নেই। পাকিস্তান সীমান্তের অনেক বাইরেও এক ক্রমবর্ধমান চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। এতেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে বিশেষ করে ভারত, অপেক্ষা করছে এবং নজর রাখছে অস্বাভাবিক নিবিড়তার সাথে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে পারস্পরিক নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষরের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে। দেশের ভেতরে এবং বাইরে পাকিস্তানের সরকারী প্রচারণা বাংলার পুরো সমস্যাটিকে গুটিকয়েক বিশ্বাসঘাতক রাজনীতিকের অপচেষ্টা হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছে। ইতোমধ্যে ভারতকে নজিরবিহীন সংখ্যক শরণার্থী আগমনের কষ্ট এবং খরচ এবং অসংগতি মেনে নিতে হচ্ছে, যা প্লাবিত করছে পশ্চিম বঙ্গ, ত্রিপুরা এবং আসাম এবং পুরো ভারতীয় অর্থনীতির স্বল্পমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণভাবে ম্লান করে দিচ্ছে। এক পর্যায়ে এরকম মনে হচ্ছে যেন তারা ভয়াবহ এক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে এটাই প্রতিষ্ঠা করতে যে পাকিস্তানের আঘাত হানার ক্ষমতা ভারতের যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতার চেয়ে বেশি না কম। এখন পর্যন্ত ভারত নিজেকে রক্ষা করে আসছে এবং পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সরাসরি আক্রমণের আশঙ্কা কিছুটা কমে গেছে ভারত-সোভিয়েত চুক্তি স্বাক্ষরের পর। কিন্তু প্রতিযোগিতা এখনও শেষ হয়নি। যে ৮০ লক্ষ মানুষ প্লাবিত করেছে পশ্চিম বঙ্গ এবং ভারতের অন্যান্য প্রদেশকে তারা দুর্ভিক্ষের শরণার্থী নয় বরং তারা দমন এবং আতঙ্কের শরণার্থী। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে যখন পূর্ব বঙ্গে খাদ্যাভাব ছড়িয়ে পড়বে তখন মানুষের দ্বিতীয় ঢল, এবার দুর্ভিক্ষের শরণার্থীরা, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এমন সংখ্যায় আসতে পারে যা কল্পনা করাও কঠিন।...দি স্টেটসম্যান হিন্দুস্তান টাইমস এর প্রতিনিধির পাঠানো একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে লিখেন, আওয়ামী লীগ এবং অন্য আরো চারটি দলের প্রতিনিধিদের মধ্যে দুই-দিনব্যাপী বৈঠক শেষে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা করার জন্য আট-সদস্য বিশিষ্ট একটি যুদ্ধকালীন উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়েছে। এই পরিষদের সদস্যরা হচ্ছেন, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, মিঃ মনি সিংহ, মিঃ মনোরঞ্জন ধর, মিঃ মুজাফফর আহমেদ, মিঃ তাজউদ্দীন আহমেদ, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, মিঃ খন্দকার মোস্তাক আহমেদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, এবং আওয়ামী লীগের আরো দুইজন সদস্য যাদের নাম পরে জানানো হবে। বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্রের ভাষ্য অনুযায়ী এই পরিষদ গঠন করার উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বাধীনতা যুদ্ধে সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণের অনুভূতি নিশ্চিত করা এবং বাংলাদেশে যারা ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শোষকদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করছে তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া। এই মুখপাত্র আরো বলেন, এই পরিষদ গঠন শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব, আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রতি বাংলাদেশের সর্বস্তরের মুক্তিকামী জনগণের দৃঢ় বিশ্বাসের প্রকাশ যা একাই বাংলাদেশে এই পরিষদের আইনগত বৈধতা প্রদান করার জন্য যথেষ্ট। গতকাল শেষ হওয়া এই পাঁচ-দলীয় বৈঠকে অনেকগুলো সিধান্ত গৃহীত হয়। তার মধ্যে একটি হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা কর্তৃক শেখ মুজিবকে বেআইনিভাবে বিনা বিচারে বন্দী করে রাখার বিষয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ এবং শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ‘হাস্যকর ও জঘন্য” মামলা পরিচালনা করার “লজ্জাজনক প্রচেষ্টার’ তীব্র নিন্দা জানানো। এই বৈঠকে বিশ্বের সকল পরাশক্তি এবং জাতিসংঘের প্রতি তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য আবেদন জানানো হয় যাতে করে এই “জঘন্য মামলা” বন্ধ এবং শেখ মুজিবের মুক্তি নিশ্চিত হয়। বাংলাদেশ সরকারকে তাৎক্ষণিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করতে এবং সেইসাথে স্বাধীনতা যুদ্ধের বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিতে। নেতারা ভারতের সরকার এবং জনগণের প্রতি তাঁদের ‘গভীর কৃতজ্ঞতা’ প্রকাশ করেন। নেতারা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের প্রতি বাংলাদেশে তাদের ভ্রাতৃবর্গের স্বাধীনতা যুদ্ধে ‘পূর্ণ সহযোগিতা’ প্রদান করার আবেদন জানান। নেতারা সিদ্ধান্ত নেন যে, পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া বাংলাদেশ বিষয়ে আর কোনো রাজনৈতিক প্রস্তাব তাদের কাছে কখনই গ্রহণযোগ্য হবে না। দি স্টেটসম্যান এর অপর রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মুশতাক আহমেদ সম্প্রতি এক বিশেষ টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন আপোসরফার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। ‘আপোসরফার সুযোগ সবসময়ই রয়েছে, কিন্তু আপোসরফার মাধ্যমে নিষ্পত্তির খাতিরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিকিয়ে দেয়ার কোন সুযোগ নেই’, তিনি বলেন। এই টিভি সাক্ষাৎকারটি আজ রাতে ‘সংবাদ পরিপ্রেক্ষিত’ নামক একটি পাক্ষিক অনুষ্ঠানে প্রচারিত হয়। সাপ্তাহিক জয় বাংলার সংবাদ থেকে জানা যায়, ইয়াহিয়ার রক্ত খেকো সামরিক জান্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন জন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, বাংলা একাডেমীর একজন গবেষক, ১৩ জন সিএসপি এবং ৪৪ জন ইপিসিএস অফিসারকে তাদের সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার ফতোয়া জারী করেছে। সামরিক আদালতে হাজির অন্যথায় অনুপস্থিতিতে তাঁদের বিচারের হুমকি দেয়া হয়েছে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×