ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নারী অভিবাসন শ্রমশক্তির অধিকার বনাম নির্যাতন

প্রকাশিত: ১৩:০৪, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯

নারী অভিবাসন শ্রমশক্তির অধিকার বনাম নির্যাতন

মানব সভ্যতার ইতিহাসের ক্রমবিকাশের ধারায় বহুকাল অতিক্রান্ত করার পর্বটিই ছিল বন্য থেকে বর্বর মানুষদের এক স্থান থেকে অন্য জায়গায় বসতি গড়ে তোলা। সভ্যতা সূর্য যখন তার রশ্মি বিশ্বময় বিতরণ করার সুবর্ণ সময়ে তখন যাযাবর বৃত্তির অবসান ঘটলেও সদ্য সভ্য হওয়া মানুষদের ঘুরে বেড়ানোর দীর্ঘ সময়ের পর্যায়টি নতুন আঙ্গিকে নবরূপে মোড় নেয়া সেও ইতিহাসের এক অনন্য ঘটনা পরম্পরা। বিভিন্ন সময় দেশান্তর হওয়ার সামাজিক চাহিদাও ছিল নির্দিষ্টকাল ও যুগের এক অনিবার্য গতিবিধি। আর এভাবেই মানব ইতিহাসে শ্রম অভিবাসন প্রত্যয়টি তার আবেদন নিয়ে সংশ্লিষ্টদের নজর কাড়ে। ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপীয় রেনেসাঁস আর অষ্টাদশ শতকে শিল্প বিপ্লবের এক অবিস্মরণীয় সন্ধিক্ষণে পাল্টে যায় সারা পৃথিবীর আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জগতটি। মানুষে মানুষে বিভাজনের ভিত্তিতে নতুন অর্থনৈতিক উৎপাদন কাঠামো সিংহভাগ গোষ্ঠীর জীবনকে শুধুমাত্র শ্রমবিনিয়োগকারী শ্রেণী হিসেবে এক দোদুল্যমান অবস্থায় দাঁড় করায়। নিজ দেশে যখন শ্রমশক্তির অপচয় কিংবা কর্মসংস্থানের অভাবে অন্য দেশে পাড়ি জমানোর তাড়না ও শ্রমজীবীদের নানামাত্রিকে আগ্রহান্বিত করে তোলে। তেমন বোধ আর অভিব্যক্তিতে গড়ে ওঠে অভিবাসন প্রক্রিয়াটি। অন্য দেশে যেতে হলে আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনের সঙ্গে মাতৃভূমি আর পরবাসের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতাও সামনে চলে আসে। অসহায়, নির্বিত্ত, পশ্চাদপদ শ্রেণী তাদের কর্মস্পৃহায় শ্রমশক্তি বাইরের দেশে প্রয়োগ করতে চাইলে তা এক সময় স্বীকৃত আর প্রতিষ্ঠিত হতেও বেগ পায়নি। আর পৃথিবীর অভিবাসী শ্রমশক্তির একটা বড় অংশ এশিয়া থেকেই উদ্ভূত। সেই পালাক্রমে সমাজের অর্ধাংশ নারীরাও ক্রমান্বয়ে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে থাকে। বাংলাদেশও এমন আন্তর্জাতিক অভিবাসন প্রক্রিয়ায় অধিভুক্ত হতে খুব বেশি সময় নেয়নি। বাঙালী নারীরা তাদের ক্ষমতা ও কর্মদক্ষতা নিয়ে বিদেশ পাড়ি দিতে থাকে। অন্য দেশে শ্রমশক্তির বিনিময়ে একটি নিশ্চিত কর্মজীবন গড়ে তুলতেও সাধ্যমতো সব ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের ক্রমবর্ধমান ধারায় সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া একটি সম্ভাবনাময় অঞ্চল। সঙ্গত কারণে নারীরাও বিভিন্ন কর্মযোগে সমৃদ্ধির বহমান ধারায় নিজেদের অংশীদারিত্ব প্রমাণ করেই যাচ্ছে। কখনও স্বদেশে কিংবা বিদেশের অর্থনৈতিক কোন বলয়ে। এসব ক্ষেত্রে মূলত আর্থিকভাবে সমস্যাকবলিত নারীরা যারা যথার্থই সিংহভাগ তারা অন্য দেশে পাড়ি দেয় অত্যন্ত নিম্নমানের কর্মসংযোগে। তবে কিছু মহিলা চিকিৎসক, শিক্ষক এবং উচ্চ মানের পদমর্যাদায় আসীন হয়ে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলও করছে। নিজেরা শুধু প্রতিষ্ঠিতই হচ্ছে না বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও সহযোগী শক্তির ভূমিকায় দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। আবার অনেক নারীর করুণ আখ্যানও লুকিয়ে থাকে তাদের কর্মজগতের হিংস্র বলয়ে। বলছি যারা স্বল্প দক্ষতাসম্পন্নœ, শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিতই শুধুই নয় তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিক জগত সম্পর্কেও প্রায় অজ্ঞ। তারা বিদেশে মূলত, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ গৃহপরিচালিকা কিংবা বড় শপিংমলের পরিচ্ছন্নতা কর্মী এবং অতি সাধারণ কর্মে নিযুক্ত হয়ে প্রতিদিনের অসহনীয় জীবনকে অতি কষ্টে পার করে নিচ্ছে। শুধু তাই নয় অবৈধ, নীতিবহির্ভূত অভিবাসন প্রক্রিয়ায় প্রতারণারও শিকার হয়ে সহায় সম্বল হারাতে সময় লাগছে না। অভিবাসন প্রক্রিয়ায় যখন আন্তর্জাতিক সীমানায় অবাধ ও মুক্ত হয় সেখানে শ্রম আইনের অনেক বিধিনিষেধ যেমন থাকে পাশাপাশি দেশ ছাড়া এবং অন্য দেশে বসতি গড়ার ব্যাপারেও নিয়মকানুন বলবত হয়। কিন্তু সবচেয়ে মর্মান্তিক এবং দুঃখজনক অতি সাধারণ গ্রামীণ নারীরা ‘শিশু দিবা যতœ’ কেন্দ্র থেকে শুরু করে বয়স্কদের রক্ষণাবেক্ষণ এবং দোকানের বিক্রয় সহযোগী ছাড়া ও পোশাক শিল্প-কারখানা ও নার্সিং পেশায় নিজেদের নিয়োজিত করে যাচ্ছে। ত্বক পরিচর্যার আঙিনায়ও বাংলাদেশের নারীরা বিদেশের পার্লারে কর্মদক্ষতা প্রমাণ করছে। এমন সব সাধারণ কর্মক্ষেত্রে উপসাগরীয় অঞ্চল, মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার বিভিন্ন জায়গায় বাঙালী মেয়েদের চাহিদা স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। নিজেদের উপার্জিত আয়ের সিংহভাগ দেশে পাঠিয়ে রেমিটেন্সের অঙ্ক যেমন ভারি করছে ঠিক সেভাবে স্বাভাবিক এবং নির্বিঘœ জীবন তারা প্রবাসে কোনমতেই আয়ত্তে আনতে পারছে না, প্রথমত বিদেশে পাচার করা দালালদের জঘন্য শিকারে পরিণত হওয়া এমন সব দুস্থ নারীর সম্ভ্রমহানিতার ব্যাপারটিও নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। অসহায় এবং নির্যাতিত নারীরা জানে না তাদের নিরাপত্তা বলয় সুরক্ষিত রাখতে আন্তর্জঅতিক অভিবাসন শ্রম আইনে বিধিনিষেধ উল্লেখ করা থাকলেও কেউ তা মানছে না। বিশ্বের শ্রম বাজারে দক্ষ নারীর চাহিদার তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে পড়া মহিলাদের সংখ্যা বেশি হলেও তারা অত্যাচার আর নৃশংসতার আবর্তে পড়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পথটিও খুঁজে পায় না। বিদেশে দেশীয় দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগে অক্ষম এসব নারীর যন্ত্রণা আর বঞ্চনার বার্তা ঠিক জায়গায় পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়ে যায়। বর্তমানে তা আরও বীভৎস এবং মারাত্মক অবস্থায় পৌঁছে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের জীবনের ঝুঁকিও ক্রমান্বয়ে বাড়তেই থাকে। অনেকে অত্যাচার-ব্যভিচার সহ্য করতে না পেরে মৃত্যুর পথে চলে যায়। যারা কষ্টে-যন্ত্রণায় বেঁচে থাকে তারাও দেশে ফিরতে অনেক সময় পার হয়ে যায়। কোন মতে স্বদেশ ভূমিতে পা রাখলেও আঘাতের ক্ষত-বিক্ষত চিহ্নে যে বিপর্যস্ত অবস্থার তৈরি হয় তা সত্যিই এক ভয়াবহ করুণ দৃশ্য। বিভিন্ন সময়ে তা গণমাধ্যমেও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। কিন্তু পরবাসে অত্যাচার-অবিচারের মাত্রা কমে না।
×