ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

-সাবিনা পুঁথি

লড়াই করে নিজেকে তৈরি করতে হয়েছে

প্রকাশিত: ১৩:০৫, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯

লড়াই করে নিজেকে তৈরি করতে হয়েছে

রক্ষণশীল সমাজের অসহায় ও নির্বিত্ত শ্রেণীর অবস্থা দৃষ্টিকটু। শুধু শ্রেণী বিভাজনই নয়, নারী-পুরুষের বিস্তর ফারাকও পশ্চাৎপদ সমাজ ব্যবস্থার বিদগ্ধ চিত্র। শহর, নগর কিংবা গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের ব্যবধান এখনও পুরো সমাজ ব্যবস্থার দুঃসহ অভিযাত্রা। বেঁচে থাকার তাগিদে, অস্তিত্বের প্রয়োজনে যাপিত জীবনের সংগ্রামী পরিক্রমা বর্তমানে কমে আসলেও তেমন যাত্রাপথ আজও নির্বিঘœ কিংবা নিরাপদ হয়নি। বিশেষ করে মেয়েদের বেলায় তো নয়ই। কিন্তু শত প্রতিবন্ধকতাকে দৃপ্ত পায়ে অতিক্রম করে সাহসিক মনোবলে জীবন প্রবাহ ও যথার্থ কর্মদ্যোতনায় অংশ নেয়া নারীরা আজ নতুন সূর্যের কিরণে আলোকিত। সেই আলোর দ্যুতি ছড়াচ্ছে সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তিক অঞ্চলেও। শেকড়ের গভীরে প্রোথিতই শুধু নয় তেমন অপসংস্কারকে দৃঢ়চিত্তে এগিয়ে যাওয়ার নারীর সংখ্যা হাতেগোনা হলেও আগামীর বাংলাদেশে তা আরও বেড়ে যাবে তেমন সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত আজ সবার সামনে উন্মোচিত। সংবাদ মাধ্যমের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জিং পেশায় নারীর যাত্রা পথ ছিল বিঘœ আর বিপত্তিতে ভরা। বরঞ্চ শিক্ষক হওয়ার মহান পেশাকে জীবনের ব্রত বলে ধরে নিতে সিংহভাগ নারীর আগ্রহ এবং ইচ্ছে ছিল পর্বত প্রমাণ। আর পরবর্তীতে চিকিৎসক হতেও মেয়েদের তেমন কোন আপত্তি ছিল না। মানব সেবামূলক এমন মহৎ কর্মযোগে নারীদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতোই। এর পরে সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মজীবী নারীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। শুধু তাই নয় উর্ধতন কর্মকর্তার আসনে অভিষিক্ত হওয়া নারীর সংখ্যা আজ হাতেগোনার অবস্থায় নেই। আর উদ্যোক্তা হিসেবে নারীর সাহসী অভিগমন দেশের অর্থনৈতিক বলয়কে নিয়মই জোরদার করছে। তবে নারীদের সাংবাদিকতায় অনুপ্রবেশের ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। স্বল্প সংখ্যক নারী সাংবাদিকতার পেশায় আসতে থাকেন ’৪৭-এর দেশ বিভাগের পর। তবে ’৮০-এর দশকে যথার্থ গোড়া পত্তনের মধ্য দিয়ে সাহসী এই পেশা নারীদের আগ্রহ তৈরি করতে সচেষ্ট হয়, আর ’৯০-এর দশকে তা একেবারে জোয়ারে মতো এগিয়ে যেতে থাকে। তার পরেও সব ক্ষেত্রে এমন সাফল্য আসতে নারীদের আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হয়। বিশেষ করে গ্রামে-গঞ্জে অজ পাড়া গাঁয়ে নারীরা গণমাধ্যমে সম্পৃক্ত হবে তা যেন কল্পনা বিলাস। সেই স্বপ্নের বিলাসীতাও আজ হাতের মুঠোয়। শুরুতে বলছিলাম সাবিনা ইয়াসমিন পুঁথির কথা। শোনা যাক সেই সংগ্রামী ইতিরও। রাজশাহী জেলার নওগাঁর এক প্রত্যন্ত অঞ্চল দাউলবাক বারপুর। সেখানে বসতি সামসুদ্দিন ম-ল নামে এক জনকল্যাণমুখী, মানবিক, দরদী মানুষের। যিনি ইতোমধ্যে ৩০ লাখ গাছের চারা রোপণ করে শুধু নিজ গ্রামে নয় সারা বাংলায় অনেকের নজরে চলে আসেন। এমন মহতী আর কর্মোদ্যাগী সাদা মনের মানুষকে পুরস্কারেও সম্মানিত করা হয়। যার উদ্যোক্তা ছিলেন এটিএন নিউজির মুন্নী সাহা। মানুষের জন্য বড় ধরনের কোন কাজ করতে গেলে নিজের প্রতি যেমন কোন খেয়াল থাকে না তেমনি সংসারের ব্যাপারে নজর দেয়াটাও কঠিন হয়ে যায়। ফলে খেয়ালী, উদাসীন এই অভাবনীয় ব্যক্তিত্ব মানব কল্যাণেই জীবন উৎসর্গ করে যাচ্ছেন। তারই কন্যা সাবিনা ইয়াসমিন পুঁথি। বাবা ও মা নূরজাহান বেগমের ৩ সন্তানের মধ্যে সাবিনা একমাত্র কন্যা এবং কনিষ্ঠতম। দুই ভাই বড়। সাবিনা বাবার কথা বলতে গিয়ে নিজেকে এই কৃতী মানুষের সন্তান হিসেবে গর্ব করে। জীবনে এগিয়ে চলার পথে পিতা সেভাবে খেয়াল রাখতে পারতেন না অন্য মানুষের কথা ভাবতে গিয়ে। বরং মাকেই সব সময় সন্তান আর সংসারের দায়-দায়িত্ব একাই সামলাতে হতো। এ নিয়ে পুঁথির কোন আক্ষেপও নেই। জনদরদী বাবার প্রতি তার অপরিসীম শ্রদ্ধা আর সম্মান। মা পশ্চাদপদ সমাজ আর উদাসীন স্বামীর সংসার সামলাতে গিয়ে মেয়েকে সেভাবে কোন ধরনের তালিম দিতে না পারলেও পুঁথির সামনে চলার পথে কোন প্রতিবন্ধকতাও তৈরি করেননি। আপন ইচ্ছা আর অন্তর্নিহিত বোধ থেকে সাবিনা একাই নিজের চলার পথের গন্তব্য নির্ধারণ করতে অন্য কোন দিকে তাকাবার প্রয়োজনও মনে করেনি। সেই অদম্য মনোসংযোগ, অনমনীয় চেতনায় লেখাপড়া চালিয়ে যেতে থাকে। মাধ্যমিকও উচ্চ মাধ্যমিক পর্বে মানবিক বিভাগের ছাত্রী হিসেবে বোর্ড পরীক্ষায় মেধা ও মননের পরিচয় দেয়। তবে বড় ভাই তাকে সব সময়ই নজরদারিতে রাখতেন। তিনিই মূলত করেছেন পিতার দায়িত্ব। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পৌঁছে দেয়া, নিয়ে আসা সবই করতেন নৈতিক দায়বদ্ধতায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরীক্ষায় সময় বড় ভাই সমস্ত কর্তব্য সম্পাদন করে বোনকে মেসে রেখে ফিরে যায়। ভর্তি পরীক্ষায় সফল কাম হয়ে গণযোগাযোগ বিভাগে পড়াশোনা সুযোগ পায়। এর পর ভবিষ্যত গন্তব্য ঠিক করতে আর ভাবতে হয়নি। আবাল্য সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের সঙ্গে সংযুক্ত সাবিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে তার কর্মের পরিধি আরও বাড়াতে থাকে। স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নেয়া শেষ হলে চলে আসে ঢাকায়। মাঝ পথে স্নেহময়ী মার অকাল মৃত্যু তাকে সাময়িকভাবে মুহ্যমান করলেও তেমন শোক কাটিয়ে এক সময় ঘুরে দাঁড়ায়। তখন অবধি বিয়ের পিঁড়িতে বসা হয়নি। একা সাহস করে ঢাকায় চলে আসে। প্রথমে এটিন নিউজ, পরে একুশে টিভি এবং এখন ডিবিসি বাংলায় সাংবাদিক হিসেবে নিজের কর্ম দক্ষমতা শাণিত করে যাচ্ছে। এখানে সংবাদ পাঠ থেকে শুরু করে প্রতিবেদন প্রস্তুত করা সব কিছুতে নিজেকে প্রমাণ করতে হচ্ছে। সদ্য বিবাহিত পুঁথির স্বামীও একজন সাংবাদিক। তাদের কর্ম ও সংসার জীবন সফল হোক।
×