ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নাজনীন বেগম

ইট-পাথরের অন্তরালে নরম প্রকৃতি

প্রকাশিত: ১৩:০৬, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯

ইট-পাথরের অন্তরালে নরম প্রকৃতি

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দ্বীপরাষ্ট্র সিঙ্গাপুর। মালয় উপদ্বীপের নৈকট্যে এমন চমৎকার রাষ্ট্রটি অপরূপ মাধুর্যের লীলাভূমি। নয়নাভিরাম এই অভাবনীয় সমরোহ দেখার আগ্রহ ভ্রমণপিয়াসীদের এক সহজাত আকাক্সক্ষা। ফলে এই ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্রটি পর্যটন শিল্পের সামগ্রিক আবেদনে সমৃদ্ধই শুধু নয় বিশ্বসীমায় এক অনন্য উচ্চতায়ও অভিষিক্ত হয়। শুধুমাত্র সারা দেশে অতি কষ্টে পাওয়া বৈষয়িক এবং প্রাকৃতিক মনোরম দৃশ্যে বিমুগ্ধ হওয়া ছাড়াও দেশটি মানবিকতা, নীতি-নৈতিকতা, স্বদেশ প্রেম ও সততার এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত। দুর্নীতি মুক্ত এই দেশটি বিভিন্ন জরিপে উঠে আসে এশিয়ার মধ্যে সততার দিকে থেকে একেবারে শীর্ষে। সেটা প্রশাসনিক আঙিনা থেকে, সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্যই শুধু নয়, সাধারণ শ্রমজীবী মানুষরাও সততার বলয়ে আধুনিক সমস্ত কর্মযোগকে মুক্ত ও অবারিত করেছে। সহায়-সম্পদ হারানোর কোন শঙ্কা নেই, নাগরিক অধিকারে সবাই তার ন্যায্য পাওয়াটাও পেয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রীই সরকারপ্রধান হিসেবে তার ক্ষমতাকে প্রয়োগ করেন। তবে রাষ্ট্রপতি হিসেবে যিনি অধিষ্ঠিত থাকেন তার ভূমিকা শুধু নামসর্বস্ব। সব নিয়ন্ত্রণ থাকে প্রধানমন্ত্রী আর অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মকর্তার হাতে। আইন, শাসন, নির্বাহী বিভাগ স্ব-স্ব মর্যাদায় অধিষ্ঠিত থাকলেও ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে প্রধানমন্ত্রীর হাতে। পুরো দেশটি চলে নিয়মানুগ এক নৈতিক দায়বদ্ধতায়। শক্তিশালী বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে এই দ্বীপরাষ্ট্রটির অভ্যন্তরীণ প্রতিবেশ শান্ত, বিবাদ মুক্ত এবং কোন ধরনের সাংঘর্ষিক অপতৎপরতা নেই। অন্যায় করে পার পাওয়ারও কোন অযৌক্তিক নির্দেশনা দৃশ্যমান হয় না। প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো যে দলটিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত তা মূলত সিঙ্গাপুরের পিপলস এ্যাকশান পার্টি হিসেবেই চিহ্নিত। অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে নিয়মবিধিকে আইনানুগ পন্থায় জোরদার করেই দেশটি দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গার পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় এই দ্বীপটি দেখা এবং উপভোগ করার যে আকাক্সিক্ষত স্বপ্ন মূলত তারই আগ্রহে সবাই সিঙ্গাপুরে আসে। সেভাবে আমি আর কন্যা নমি দেশটি ভ্রমণ করার উদ্দেশে বাংলাদেশ বিমানে চেপে বসলাম জুনের ৯ তারিখ। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান থেকে আমাদের যাত্রার সময় ছিল সাড়ে দশটায়। আনুষঙ্গিক নিয়মকানুন সেরে সময়মতো বিমানে উঠলাম। শুধু তাই নয় যথাসময়ে বিমান আকাশ পথেও তার গন্তব্য শুরু করে। ৪ ঘণ্টার নিরাপদ ভ্রমণের পর চাঙ্গী বিমানবন্দরে অবতরণের সময় যে নৈসর্গিক শোভা এবং সাজানো গোছানো প্রতিবেশ প্রত্যক্ষ করলাম তাতে শুধু অবাক বিস্ময়ে মুগ্ধ হওয়ার ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেও পারলাম না। মেয়ে নমি বলে যাচ্ছিল মা, সিঙ্গাপুরের কোন ঐতিহ্য কিংবা ঐতিহাসিক পটভূমি নেই। যা কিছু অভাবনীয় দৃশ্য দেখছ সবাই এদেশের মানুষরাই কষ্ট করে গড়ে তুলেছে। পরিশ্রম এবং সততায় তারা আজ বিশ্বের দরবারে নিজেদের অবস্থানকে শক্ত করেছে। এই যে গাছপালা, বিভিন্ন রকমের উদ্ভিদের সমারোহ সবই তারা বাইরে থেকে নিয়ে এসেছে। তাদের মাটিও অত উর্বর নয়। সেই মাটি অন্য দেশ থেকে এনে নিজের ভূমিকে ওরা ফলনের উপযোগী করেছে। সত্যিই আশ্চর্য হতে হয় প্রকৃতির দান ছাড়াই এভাবে নৈসর্গিক সম্পদ গোছানো সিঙ্গাপুরীদের বিরল কীর্তি। তারপরে যৎসামান্য যা কিছু ঐতিহ্য ছিল তাও তারা অত্যন্ত সযতেœ সংরক্ষিত রেখে দেশের পর্যটন শিল্পকে আরও শোভনীয় করে তুলেছে। চাঙ্গি বিমানবন্দর থেকে অভিজাত হোটেল পার্ক রয়েলে আসতে প্রায়ই ঘণ্টাখানেক লেগে গেল। দু’পাশে বৃক্ষরাজির মিলন মেলা, সুশোভিত পুষ্পের ডালি সাজানো রাস্তা দিয়ে গন্তব্যে যেতে যেতে চারদিকের অতুলনীয় সৌন্দর্য উপভোগ করা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারিনি। তবে রাস্তায় ট্রাফিকের আইনগত পর্যায়টি এত সুশৃঙ্খলভাবে দৃশ্যমান যে নিয়ম ভাঙ্গার বিষয়টি ঘটতে দেখা যায় না। ভাবতে অবাক লাগল রাস্তায় কোন ট্রাফিক সার্জেন্টের অনুপস্থিতিতে যান চলাচল নিয়মভিত্তিক কোন ব্যত্যয় ঘটাচ্ছে না। হোটেলের সামনেই বিরাট শপিং মল। সেখানে সিনেমা দেখারও ব্যবস্থা আছে। ঈদে সালমান খানের মুক্তি পাওয়া ‘ভারত’ ছবিটি দেখে মনে হলো ভিন্ন সংস্কৃতির নান্দনিক চর্চাও এখানে মুক্ত এবং অবাধ ভাবে প্রচলিত আছে। হোটেলের পেছনে মোস্তফা মার্কেট। যেখানে প্রচুর বাংলাদেশী, ভারতীয় এবং চৈনিকদের কর্মপরিচালনা লক্ষণীয়। সব ধর্মের মানুষ মিলে মিশে এক হয়ে সে দেশের অর্থনীতি, পর্যটনসহ আরও বহুবিধ সামাজিক কর্মপ্রবাহে এগিয়ে নিচ্ছে। সম্প্রীতির এই দেশটিতে দুর্নীতি কিংবা চৌর্যবৃত্তিও অন্তর্ধান হয়েছে। পরের দিন অর্থাৎ ১০ জুন থেকে শুরু হয় আমাদের ভ্রমণ পরিকল্পনায় দর্শনীয় স্থানগুলো দেখা। প্রথমেই প্রবেশ করলাম সিঙ্গাপুর ন্যাশন্যাল ইউনিভার্সিটির সম্প্রসারিত আঙ্গিনায়। দেশের অন্যান্য সমৃদ্ধ খাতের মতো শিক্ষা ব্যবস্থাও একেবারে বিশ্বমানের। র‌্যাঙ্কিংয়ে এশিয়ার মধ্যে শীর্ষস্থানে থাকা এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বিশ্বসভায়ও তার জায়গা করে নিয়েছে ২১তম হিসেবে। দর্শনীয় এই বৃহদাকার ক্যাম্পাসটি আধুনিক বিশ্বমানের বিভিন্ন কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণে। এখানে সিঙ্গাপুরী ছাড়াও এশিয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে শিক্ষার্থীরা উচ্চ ডিগ্রী অর্জন করতে আসে। মেডিক্যাল সেন্টার, প্রকৌশল অনুষদ থেকে শুরু করে অন্যান্য শিক্ষা বিষয়ক অনুষদ আর ব্যবস্থাপনার উচ্চ শিক্ষার এই পাদপীঠটি সারা বিশ্বে নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে। এর পরেও দর্শনীয় চমক ছিল সিঙ্গাপুরের রিভার ভ্যালি। ইঞ্জিন চালিত ছোটখাটো লঞ্চের আদলে তৈরি যানে আমাদের পুরো নদী ঘুরে ঘুরে সিঙ্গাপুর শহরটাকেই দেখার সৌভাগ্য হলো। সিঙ্গাপুরের যে জাতীয় ঐতিহ্য মৎস্যসিংহের মুখ থেকে পানির ধারা বহমান হওয়া তাও আমরা নদীর চারপাশ দেখতে দেখতে উপভোগ করলাম। যেন এক নজরে সিঙ্গাপুরকে কিছুটা হলেও ভেবে নেয়া। সত্যিই এমন দৃশ্য মনোমুগ্ধকর এবং আবেগে তাড়িত হওয়ার মতোই। এরপর আমরা গেলাম ‘গার্ডেনস বাই দ্য বে’। সেখানকার অপূর্ব দৃশ্য আরও মনোহর এবং উপভোগ্য। ক্লাউড ফরেস্ট এবং ফ্লাওয়ার ডুম- এই অনবদ্য বাগানটির শোভাবর্ধনের এক অভাবনীয় নান্দনিকতা। মেঘে ঢাকা বনে ঢুকে যে নৈসর্গিক শোভা দর্শন করলাম মনে হচ্ছে প্রকৃতির অনাবিল আনন্দের এক মহামিলনযজ্ঞ। সারি সারি বৃক্ষরাজির সুরম্য নিকেতন দর্শকপ্রিয়তা তো বটেই তার চেয়েও বেশি এক কঠোর পরিশ্রমী জাতির নিজের হাতে গড়া এক অবর্ণনীয় সৌন্দর্যের মহিমা। এমন বন তৈরিতে সিঙ্গাপুরীরা শুধু গাছ-গাছালির বীজই বাইরে থেকে আনেনি তার প্রয়োজনীয় মাটি আমদানি করেও দেশটির নান্দনিকতাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া আছে পুষ্পের অবারিত সমারোহে থরে থরে ফুলের ডালি সাজানো। ফ্লাওয়ার ডুম- সে মাত্রারই এক নন্দনকানন যা পর্যটকপ্রেমীদের উৎসাহ ও আগ্রহকে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে নেয়। রিসোর্ট ওয়ার্ল্ড সেনতোসা এবং মারলিয়েন পার্কে গিয়ে আমরা সরাসরি সেই মৎস্য সিংহের মুখোমুখি হলাম। কাছ থেকে সিংহের মুখ থেকে অনবরত নির্গত জলধারাকে উপভোগ করার যে অপরিমেয় স্নিগ্ধতা তাও যেন কানায় কানায় অনুভব করলাম। দেখার মতো নান্দনিক দৃশ্যে মনে হচ্ছিল কোন শিল্পীর রঙের বর্ণিল আলপনায় পুরো সেনতোসা যেন শৈল্পিক শৌর্যের মহিমান্বিত সুষমা। পর্যটনের এমন সমৃদ্ধ ঐশ্বর্যকে একান্ত আপনার করে নিয়ে সাময়িক আনন্দের যে অনুভূতি তৈরি হলো তা বিভিন্ন সময় তৃপ্ত মনকে সেখানেই ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
×