ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড এক রক্তক্ষয়ী কাব্য

প্রকাশিত: ১৩:১০, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯

সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড এক রক্তক্ষয়ী কাব্য

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ বিশ্বের ইতিহাসে আজও বিভীষিকাময় একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। ১৯৭১ এ বিশ্বের সেরা পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সাপোর্ট দিলেও পিছপা হয়নি বাংলাদেশ তথা বিশ্বের মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ববর্গ। কবি আরউইন এ্যালেন গিন্সবার্গ তাদের মধ্যে একজন। যিনি সর্বাপরি চেষ্টা করেছিলেন যুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কর্তৃক অসহায় বাঙালীদের ওপর হত্যাযজ্ঞের চিত্র বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিতে। এ্যালেন গিন্সবার্গ। একজন মার্কিন কবি, গীতিকার, আলোকচিত্রী এবং মঞ্চ অভিনেতা। তিনি ১৯২৬ সালে ৩ জুন নিউ জার্সিতে জন্মগ্রহণ করেন। আর মৃত্যুবরণ করেন ৫ এপ্রিল ১৯৯৭ সালে। গ্রিন্সবার্গ মানবতার কবি। লিখেছেন মানবতা রক্ষায়। বিশ্বকে জানিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন মানবতার চরম লঙ্ঘন করেছে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী । ’৭১-এর এ নিরস্ত্র বাঙালীদের ওপর চলা অন্যায়, নির্যাতন এবং বর্বরতার বিরুদ্ধে সরব ছিলেন এই মহান সমাজকর্মী। ছিলেন যুদ্ধবিরোধী। ১৯৭১ এর সেপ্টেম্বরে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন এসেছিলেন বাংলাদেশে। নিজ চোখে বাঙালীদের দুর্দশা দেখে লিখে ফেলেন বিখ্যাত কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড।’ এই কবিতাটি সর্বকালের সেরা কবিতার একটি হয়ে আজও বেঁচে আছে। তার কবিতাটি ছুঁয়ে যায় হাজারো মানুষের হৃদয়। নিপীড়িত মানুষের হাহাকার মেশানো, যুদ্ধের বাস্তবচিত্র কবিতার অক্ষরে অক্ষরে জানান দিয়ে যায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যার দৃশ্য। তার কবিতা শুনে ও পড়ে অশ্রুসজল হয়ে পড়েন হাজারও মানুষ। গিন্সবার্গ তার সাহিত্যিক বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ভয়াবহতা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার সংগ্রামে নেমেছিলেন। মুখোশ উন্মোচন করতে চেয়েছিলেন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীদের তারা কিভাবে অন্যায় ভাবে রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠেছিল। তৎকালীন গিন্সবার্গ এই দেশে এসেছিলেন ভারত-বাংলাদেশের সংযোগস্থল যশোর রোড হয়ে। যুদ্ধে অসহায় বাঙালী পশ্চিমবঙ্গের যশোর রোডের চারপাশে আশ্রয় শিবির তৈরি করেছিল। গিন্সবার্গ এসেছিলেন যুদ্ধাহতদের নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে। কিন্তু বাঙালীদের দুর্দশা দেখে তিনিও প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটি লেখার অনুপ্রেরণা এখান থেকেই পাওয়া। কলকাতায় গিন্সবার্গের সঙ্গে ছিলেন তাৎকালীন বিবিসির রিপোর্টার গীতা মেহতা। কলকাতার কয়েক শিল্পী-সাহিত্যিকের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রে তিনি বিখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে থাকার সুযোগ পান। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অন্যদেরসহ গিন্সবার্গকে নিয়ে ঘুরে বেড়ান যশোর রোডের শরণার্থী শিবিরগুলোতে। তখন বাংলাদেশ থেকে অনেক শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গ ও সীমান্তবর্তী অন্যান্য শহরে আশ্রয় নিয়েছিল। ব্রিটিশ রাজ্যের সময় পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের সংযোগকারী সড়ক হিসেবে কাজ করত ‘যশোর রোড’। বাংলার ইতিহাসে যশোর রোড বিখ্যাত স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য। এই যশোর রোডের দু’পাশে আজও সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে শত শত গাছ। যাদের বয়স দু’শ’ বছরেরও বেশি। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা এলেই যশোর রোডের কথা আসবেই। আশ্রয়ের খোঁজে অসহায়, নির্যাতিত বাঙালী এই রোড ধরেই ভারতে গিয়েছিল। গিন্সবার্গ স্বচক্ষে অনুধাবন করেছিলেন যশোর রোডের চিত্র। যশোর রোডের পাশে গড়ে ওঠা যুদ্ধাহত বাঙালীদের শরণার্থী শিবির এবং এপার থেকে ওপারে যাত্রা করা হাজার হাজার নিরীহ মানুষের নির্মম হাহাকারের প্রতিধ্বনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি তার ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতায়। গিন্সবার্গের ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটি ১৯৯৯ সালে প্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ তাঁর মুক্তির গান চলচ্চিত্রে ব্যবহার করার কথা ব্যক্ত করেন। গিন্সবার্গের কাছে গিয়ে অনুমতি নিতেও সফল হোন তিনি। প্রথমে খান মোহাম্মদ ফারাবীর অনুবাদ করা কবিতাটি গান হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন কিন্তু কবিতা থেকে গান করাটা অনেক কঠিন ছিল তাই এটাকে গান করার দায়িত্ব পড়ে তারেক মাসুদের বন্ধু প্রখ্যাত গায়িকা মৌসুমী ভৌমিকের ওপর। মৌসুমী ভৌমিক কবিতাটি গান হিসেবে গেয়েছেন এবং জয় করে ফেলেন শ্রোতার মন। কিন্তু পরবর্তীতে তারেক মাসুদের চলচ্চিত্র মুক্তির গান থেকে গিন্সবার্গের কবিতাটি বাদ পড়ে যায়। গিন্সবার্গ শুধু যে সাহিত্যিক ছিলেন তা নয়। তিনি ছিলেন সুন্দর মনের অধিকারী। সত্যিকার অর্থে একজন সমাজকর্মী, মানবতার সেবক। স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতা লিখেও তিনি ক্ষান্ত হননি। যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে তার বন্ধু বব ডিলান ও অন্যদের সহায়তায় এই কবিতাটিকে গানে রূপান্তর করেন। কনসার্ট ফর বাঙালী নামে গানের প্রোগ্রাম করেন। কনসার্টে এই গান গেয়ে তারা বাংলাদেশী শরণার্থীদের সহায়তার জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন। গিন্সবার্গের এই মহৎ উদ্যোগে এগিয়ে আসেন অনেকেই। এই কনসার্টে জর্জ হ্যরিসন, বব ডিলান, জোয়ান বায়েজসহ আমেরিকার আরও অনেক জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী সঙ্গীত পরিবেশন করেন। পণ্ডিত রবি শংকর ও অপর ভারতীয় কিংবদন্তি গায়ক আলি আকবর খানও গান পরিবেশন করেন এই কনসার্টে এবং এখান থেকে প্রায় আড়াই লাখ ডলার সংগৃহীত হয়। যা সব যুদ্ধাহত বাঙালীদের সাহায্যের জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়। বাংলাদেশ থেকে দূরে থেকেও বাঙালীদের জন্য গিন্সবার্গের সহমর্মিতা ও ভালবাসা কমেনি। তিনি তার কবিতা ও গানের মাধ্যমে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন পূর্ববাংলায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচার ও বর্বরতার চিত্র। আর তিনি তা পেরেছিলেন এতে সন্দেহ নেই। গিন্সবার্গের করা এই কনসার্ট সারাবিশ্বকে একটা নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছিল। সবার কাছে পৌঁছে গিয়েছিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বর্বরতার কথা এবং আমাদের গৌরবান্বিত স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা। গিন্সবার্গ প্রথমে পরিচিতি পান ১৯৫৬ সালে তার লেখা ‘হাউল’ মহাকাব্যের কারণে। যেখানে তিনি তুলে ধরেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদের ধ্বংসাত্মক শক্তির কথা। গিন্সবার্গের এই হাউল কবিতাটি যুক্তরাষ্ট্রে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তিনি সর্বদা পুঁজিবাদ, বস্তুবাদ, সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন। তার কবিতায় যা স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। গিন্সবার্গ ছিলেন আমেরিকার প্রথম সারির একজন সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক অধিকারকর্মী। ১৯৫৫ সাল থেকে আমেরিকা ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে দেশটির রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মীরা এই যুদ্ধের বিরোধিতায় নামেন। আমেরিকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ। অনেকের কাছেই এই আন্দোলন হিপ্পি মুভমেন্ট নামেও পরিচিত। ১৯৬৫ সালে এই আন্দোলনের কর্মীরা একটি বড় সমস্যার সম্মুখীন হন। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিরোধ রুখতে অসম্ভব হয়ে পড়ছিল তখন এই সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ হিসেবেই কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ সৃষ্টি করেন ‘ফ্লাওয়ার পাওয়ার’। বন্দুকের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দেন ফুলকে! আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন গিন্সবার্গ নিজেও। ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনে ফুল হয়ে ওঠে প্রধান হাতিয়ার। ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধীর অন্যতম নেতা ছিলেন গিন্সবার্গ। পড়ালেখার পাশাপাশি তিনি নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন বিভিন্ন আন্দোলন এবং পত্রিকা আর ম্যাগাজিনের কাজে। ইহুদি পরিবারে জন্ম হলেও বাঙালীদের প্রতি ছিল অগাধ ভালবাসা। তাই ভারতে থাকাকালীন তিনি কলকাতায় অবস্থান করতেন বেশি। ব্যক্তিগত জীবনে সমালোচিত হলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে গিন্সবার্গের অবদান কখনো ভোলার নয়। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার গিন্সবার্গকে সম্মানিত করেছে। স্বাধীনতার যুদ্ধে অবদান রাখায় পুরস্কৃত করেছে। বাংলাদেশ চিরকাল অকৃত্রিম বন্ধুর মতো গ্রিন্সবার্গকে স্মরণে রাখবে।
×