ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আমিরুল বাসার

অনন্য নজরুল

প্রকাশিত: ১৩:১০, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯

অনন্য নজরুল

পৃথিবীতে এমন কিছু কিছু মানুষ আছে যাঁরা খুব ছোটবেলা থেকেই মনের মধ্যে একটি গেরুয়া-পরা মানুষকে লালন করে রাখেন। পরে সময় হলে, সেই মনের আড়ালের গেরুয়া পরা মনটিই তাঁকে যোগী করে তোলে, দেশের মানুষ যাঁর অমৃত-নিঝর বাণী শুনবে, এমনি কণ্ঠস্বর আর ব্যক্তিত্বের অধিকারী করে তোলে। যে মানুষেরা অনেক আলোর সামনে থেকেও অন্ধকারকে ভোলেন না। অফুরন্ত হাসি-আনন্দের মধ্যেও থাকে তাঁদের দুঃখের অনুভূতি, আর অযুত জনারণ্যের মাঝখানেও হারান না মনের গভীর নিঃসঙ্গতা। বিদ্রোহী নজরুল এমনই একজন মানুষ ছিলেন। অনেক আলোর মাঝখানে থেকেও যিনি অনেকের আঁধারের সঙ্গী হয়েছিলেন, শত আনন্দের মধ্যেও দুঃখকে কোনদিন ভোলেননি, আর বহু মানুষের ভিড়ের মধ্যেও যিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ, একা নির্লিপ্ত। তৎকালীন ভারতবর্ষের অবশিষ্ট অংশের বাংলা যখন ব্রিটিশ উপনিবেশিক শোষণ-শাসনের অধীন। এবং যে শাসন জন্ম দিয়েছিল অর্থনৈতিক, সামাজিক, বুদ্ধিবৃত্তিক দুষ্টক্ষত। সেই দুঃশাসনের চরম সময়ে বজ্র বিদ্যুতের মতো বাংলা সাহিত্য জগতে আবির্ভূত হন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুল ইসলামের ব্যক্তিগত ও সাহিত্য জীবন সম্পর্কে ছোট্ট নিবন্ধে আলোচনা করা সম্ভব নয়। তাই আজ তাঁর আলোচনা হতে বিরত থেকে ভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করব তাঁরই জীবন নিয়ে। নজরুল ইসলাম তাঁর সৃষ্টিশীল জীবনে শ্রেণী ভেদাভেদ ভুলে সবার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে গেছেন। আর তাই নজরুলের নিকট-সান্নিধ্যে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা কোনদিনই ভুলবেন না তাঁর জ্যোতির্ময় মূর্তি, ভাস্বর ভানুত্ব। কবির সেই হিমালয়-নির্ঝর গুরু গুরু কণ্ঠস্বর আজো তাদের কানে বাজে। মনে পড়ে মানুষ দরদী কবি নজরুলের নিত্যদিনের কত ঘটনার স্মৃতিচিত্র। এমনি অনেক কবি সাহিত্যিক ও সমাজ সেবকের মধ্যে কয়েকজন মনীষীর স্মৃতিতে নজরুলের জীবনালেখ্য তুলে ধরা যেতে পারে। নজরুল সম্পর্কে সুভাস চন্দ্র বসু বলেছেন, ‘স্বাধীন দেশে জীবনের সঙ্গে সাহিত্যের স্পষ্ট সম্পর্ক আছে। কিন্তু আমাদের দেশে তা নেই। নজরুলকে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। নজরুল নিজে যুদ্ধের ঘটনা নিয়ে কবিতা লিখেছেন। তিনি বন্দুক ঘাড়ে করে যুদ্ধ করেছিলেন, কাজেই নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সব কথা লিখেছেন তিনি। আমাদের দেশে ঐরূপ খুব কম। এতেই বুঝা যায় যে, নজরুল একটা জীয়ন্ত মানুষ’। তিনি বলেন, ‘আমরা যখন যুদ্ধে যাব, তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা কারাগারে যাব তখনও তাঁর গান গাইবো। নজরুল যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেটা শুধু তাঁর নিজের স্বপ্ন নয়-সমগ্র বাঙালী জাতির স্বপ্ন।’ প্রফুল চন্দ্র বলেছিলেন, ‘আজ আমি এই ভেবে আনন্দ লাভ করছি যে, নজরুল ইসলাম শুধু মুসলমানদের কবি নন তিনি বাংলার কবি, বাঙালীর কবি। কবি মাইকেল মধুসূদন খ্রীস্টান হয়েছিলেন। কিন্তু বাঙালী জাতি তাকে শুধু বাঙালী রূপেই পেয়েছিল। আজ নজরুল ইসলামকেও জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলে শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন। কবিরা সাধারণত ভীরু, কিন্তু নজরুল তা নন। কারাগারে শৃঙ্খল পরে বুকের রক্ত দিয়ে তিনি যা লিখেছেন, তা বাঙালীর প্রাণে এক নতুন স্পন্দন জাগিয়ে তুলেছে’। নজরুলের প্রতি বিপিনচন্দ্র পাল বলেছিলেন, তাঁহার কবিতার সঙ্গে পরিচিত হইয়া দেখিলাম এ তো কম নয়। এ খাঁটি মাটি হইতে উঠিয়াছে। আগেকার কবি- যাহারা ছিলেন তাঁহারা দোতলা প্রাসাদে থাকিয়া কবিতা লিখিতেন। নজরুল কোথায় জন্মিয়াছেন জানি না, কিন্তু তাঁহার কবিতায় গ্রামের ছন্দ, মাটির গন্ধ পাই।’ কবি সমালোচক বুদ্ধদেব বসু তার সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসে তিনি এক আকর্ষণীয় বর্ণাঢ্য পুরুষ। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের অর্থই ছিল তাঁকে ভালবাসা। তিনি ছিলেন বোহিমিয়ান, বলতে গেলে তিনি তাঁর জীবন কাটিয়েছেন বন্ধুদের উৎফুল্ল করে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি হারমোনিয়াম নিয়ে গান গেয়ে যেতেন, চা আর পান খেতেন বারবার। আর শ্রোতাদের ধরে রাখার জন্য সুকণ্ঠের মাধুর্যের চেয়ে তাঁর গানে সঞ্চারিত আনন্দ ধারা ভূমিকা পালন করত অধিক। কখনও কলকাতার ফুটবল মাঠে খেলা দেখতে দেখতে জোরে চিৎকার করতেন আবার মৌনী ঘণ্টাগুলো পেরিয়ে যেত দাবার ছকের সামনে বসে। সমালোচক এবং শিক্ষাবিদ কাজী আবদুল ওদুদ নজরুল একবার ঢাকায় এলে যে ঘটনা ঘটেছিল তার বর্ণনা দিয়েছেন- ‘প্রায় বিশ বছর পূর্বে কয়েকজন খ্যাতনামা খান বাহাদুর নজরুলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার আয়োজন করেছিলেন। ঠিক হয়েছিল বুড়িগঙ্গায় এক বজরায় তারা কবির সঙ্গে মিলিত হবেন। নির্দিষ্ট সময়ে খান বাহাদুররা সেই বজরায় গিয়ে উপস্থিত হলেন। কিন্তু কবির দেখা নেই। অনেক কষ্টে কবিকে উদ্ধার করা গেল এক বন্ধু-সম্মেলন থেকে। তাঁর উচ্চ হাসি হয়ত দিয়েছিল সন্ধান। কিন্তু যখন বলা হলো, সম্মানিত খান বাহাদুররা অনেকক্ষণ ধরে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছেন, তখন কবি বলেছেন- আমি দেশের কবি, খান বাহাদুররা আমার জন্য অপেক্ষা করবেন না তবে কি করবেন? আমি রাজপথ দিয়ে হেঁটে চলব, দেশের খান বাহাদুর, রায় বাহাদুররা রাস্তার দুই পাশ থেকে আমাকে কুর্নিশ জানাবেন, আমি সেই কুর্নিশ গ্রহণ করতে করতে এগিয়ে যাব এইত আমাদের মধ্যকার সম্পর্ক। নিঃস্বগুণীর এমন আত্ম মহিমাবোধের ইতিহাস বিশ্রুত দৃষ্টান্ত বেটোফেন। আমাদের দেশে নজরুল ভিন্ন আর কোন দরিদ্র গুণী এমন কথা বলতে পেরেছেন বলে আমার জানা নেই। ‘আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারেও কুর্নিশ’। এটি তাঁর এক খেয়ালী কথা নয়। তাঁর ভেতরকার একটি স্থায়ী ভাব-প্রধান ভাব, বলা বাহুল্য এমন আত্মমহিমাবোধ দুর্লভ-খুব উচ্চ দরের প্রতিভার মধ্যেই এর সন্ধান মেলে। নজরুল ইসলামের সাহিত্য জীবনে সবচেয়ে বেশি চমক সৃষ্টি করেছিল তাঁরই সাপ্তাহিকী ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা। এই ‘ধূমকেতু’র মাধ্যমে তিনি আলোচিত হন অনেক কবি সাহিত্যিকের কাছে। কিন্তু এই ‘ধূমকেতু’র প্রকাশনার ঘটনা আমাদের অনেকের জানা নেই। এখানে সেই ঘটনা তুলে ধরছি। কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি ‘মোসলেম ভারত’ ও ‘বিজলী’ পত্রিকাতে প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তৎকালীন বাঙালী সমাজ একেবারে টগবগ করে ফুটে উঠেছিল। সকলের মধ্যে তখন সেই মনোভাব ছড়িয়ে পড়েছিল- ‘আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ।’ ঠিক এই সময়ে ঘটে ধূমকেতুর ঘটনা। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন: ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশের পর কলকাতার কলেজ স্ট্রীটের আড্ডা আরও সরগরম হয়ে ওঠে। আমরা যারা আগে থেকে ছিলাম, তাদের সঙ্গে আরও এসে জুটল খান মঈনুদ্দীন, গোলাম মোস্তফা, মঈনুদ্দীন ও তরুণ রেজাউল করিম। এছাড়া কত পরিচিত-অপরিচিত যুবক আসছে যাচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। এই সময়ে কে যে নজরুলের মাথায় ঢুকিয়ে দিল-পত্রিকা বার করতে হবে। মতলবটা নজরুলের মাথায় চেপে বসতেই তাতে তালিম দিয়ে উঠল আর সবাই। এক পয়সা দামে ফুলস্কেপ চার পাতা সাপ্তাহিক পত্রিকা বেরুবে ‘ধূমকেতু’। কিন্তু পয়সা কোথায় সবার-পকেট ঢু-ঢু, তবু মনে সংশয় নেই। স্থির বিশ্বাস, কাগজ বেরুবেই। কয়রিম কাগজ বাকিতে সংগ্রহ করা গেল, মেটকাফ প্রেসের মালিক মনি ঘোষ ‘ধূমকেতু’ ছাপার দায়িত্ব সানন্দে গ্রহণ করলেন। কাগজ একপিঠ ছাপা হয়ে গেছে এমন সময়ে এল কবিগুরুর আশীর্বাণী। পয়লা পৃষ্ঠায় তা বসিয়ে দেয়া হলো। ‘আয় চলে আয়রে ধূমকেতু আঁধারে বাঁধ আগ্নিসেতু দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন, অলক্ষণের তিলক রেখা রাতের ভালে হোক্না লেখা জাগিয়ে দে রে চমক্ মেরে আছে যারা অর্ধচেতন।’ সেদিন সারা শহর উদ্বেল হয়ে পড়ল। ঘণ্টা দু’য়ের মধ্যে দু’হাজার কাগজ উবে হেল, নিঃশেষ হলো। হকারের দল এসে হাজির হলো ছাপাখানায়, বত্রিশ নম্বরে-আরও কাগজ (ধূমকেতু) চাই। চার পাঁচ হাজার ছেপে দিলেও তারা তা নিতে রাজি। ‘দে গরুর গা ধুইয়ে’। সাপ্তাহিক পত্রিকার দ্বিতীয় মুদ্রণ হয় না। সংখ্যার পর সংখ্যা বেরিয়ে যেতে লাগল। বিক্রির সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যেতে লাগল। মোড়ে মোড়ে তরুণের দল জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকে-হকার কতক্ষণে নিয়ে আসে ধূমকেতুর বান্ডিল। তারপর হুড়োহুড়ি কাড়াকাড়িতে কয়েক মিনিটের মধ্যে তা নিঃশেষ হয়ে যায়। এক কপি কাগজ নিয়ে চায়ের দোকানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক্তৃতা চলে। ছাত্র-হোস্টেল, রোয়াকে বৈঠকখানায় তার পরদিন পর্যন্ত একমাত্র আলোচ্য বিষয় থাকে ধূমকেতু। জাতির অচলায়তন মনকে অহর্নিশি এমন করে ধাক্কা মেরে চলে ধূমকেতু। কিন্তু ‘ধূমকেতু’ বেশি দিন চলেনি। আর এ ধরনের পত্রিকা বেশি দিন চলতেও পারে না। শাসকগোষ্ঠী তছনছ করে দিল ধূমকেতুর অফিস ও ছাপাখানা। শুধু তাই নয় ধূমকেতুর প্রকাশক ও সম্পাদক হওয়ায় নজরুলকে গ্রেফতার করা হলো রাজদ্রোহীতার অভিযোগে। পরে ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে জবানবন্দীতে নজরুল যা বলেছিলেন, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তা অতুলনীয়। জবানবন্দীর একাংশ যেমন- ‘আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি আজ রাজ-কারাগারে বন্দী এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত। এক ধারে রাজার মুকুট; আরেক ধারে ধূমকেতুর শিখা। একজন রাজা, হাতে রাজদণ্ড আর জন সত্য, হাতে ন্যায়দণ্ড। রাজার পক্ষে নিযুক্ত রাজ-বেতন ভোগী রাজকর্মচারী। আমার পক্ষে সকল রাজার রাজা, সকল বিচারকের বিচারক, আদি অনন্তকাল ধরে সত্য জাগ্রত ভগবান’। অন্যখানে বলেছেন, ‘আমি কবি, অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করবার জন্য, অমৃত সৃষ্টিকে সৃষ্টিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন। আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা, ভগবানের বাণী। সে বাণী রাজ বিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায় বিচারে সে বাণী ন্যায়-বিদ্রোহী নয়, সত্যদ্রোহী নয়। সে বাণী রাজদরবারে দণ্ডিত হতে পারে। কিন্তু ধর্মের আলোকে, ন্যায়ের দুয়ারে তাহা নিরাপরাধ, কুলুষ, অম্লান, অনির্বাণ, সত্য-স্বরূপ। সত্য স্বয়ং-প্রকাশ, তাহাকে কোন রক্ত আঁখি রাজদণ্ড নিরোধ করতে পারে না। আমি সেই চিরন্তন স্বয়ং প্রকাশের বাণী যে বীণায় চির সত্যের বাণী ধ্বনিত হয়েছিল। আমি ভগবানের হাতের বীণা, বীণা ভাঙলেও ভাঙতে পারে। কিন্তু ভগবান ভাঙবে কে? একথা ধ্রুব সত্য যে, সত্য আছে ভগবান আছেন- চিরকাল ধরে আছে এবং চিরকাল থাকবে। যে আজ সত্যেরে বাণী রুদ্ধ করছে। সত্যের বাণীকে মূক করতে যাচ্ছে, সেও তাঁরই এক ক্ষুদ্রাদপ্তি ক্ষুদ্র সৃষ্টি অণু। তাঁরই ইঙ্গিতে আভাসে ইচ্ছায় যে আজ আছে, কাল হয়ত থাকবে না। নির্বোধ মানুষের অহঙ্কারের আর অন্ত নেই। সে যাহার সৃষ্টি তাহাকেই যে বন্দী করতে চায়। শাস্তি দিতে চায়। কিন্তু অহঙ্কার একদিন চোখের জলে ডুববেই ডুববে’। যে আন্তরিকতা আর দৃঢ় আস্থা নিয়ে তিনি এই জবানবন্দী পড়েছিলেন তাতে এমন একটি ভীতিকর প্রভাব হয়েছিল যা বাংলায় সন্ত্রাসবাদীদের দৃঢ় বিশ্বাসের সাহসিকতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নজরুল তাই শুধুমাত্র একজন কবিই নন, তিনি আমাদের দেখা অনেক মানুষের মধ্যে অন্যতম একজন। তাঁর সৃষ্টিশীল জীবনে তিনি যা দিয়ে গেছেন আমরা তা বুকে ধারণ করি পরম মমতায়, শ্রদ্ধায় আর ভালবাসায়।
×