ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাহমান ওয়াহিদ

অভয়ারণ্য

প্রকাশিত: ১৩:১১, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯

অভয়ারণ্য

‘মাথার সামনের দিকে সামান্য চুলটুকুই শুধু নাই, আর সবই তো ঠিক আছে। তাহলে আপত্তি ক্যানো বলতো মা?’ ‘চুল তো কোন ফ্যাক্টর না মা। অনেক কষ্ট করে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফাইনালে উঠেছি। এখন বিয়ে হলে পড়াশোনার কতটা ক্ষতি হবে ভেবেছ একবারও? পড়াশোনার চাপে তিন বেলা খাওয়ার সময়টুকু পর্যন্ত পাই না। তোমার জামাইবাবুকে সময়টা দেব কখন?’ ‘কিন্তু জানাশোনার মধ্যে এমন ভালো ছেলে কি আর পাব, বল? তোর বাবারও খুব পছন্দ।’ ‘না পেলে আমি কী করবো? তোমারই তো স্বপ্ন-আমি যেন ইঞ্জিনিয়র হই। এখন এই শেষ সময়ে আমাকে ঝামেলায় ফেলতে চাও কেন বল তো?’ ‘ক্যানো, বিয়ে করে কেউ কি লেখাপড়া করছে না? মিঠু তো আমাদের নিজেদেরই ছেলে। নিজেও ইঞ্জিনিয়ার। তোকে হেল্পও করবে।’ ‘ওহ্ মা, নিজেদের ছেলে বলে কি সে চুপটি করে বসে থাকবে ভেবেছ? জ্বালিয়ে মারবে। আর তখন আমার মাথা গরম হয়ে গেলে চড় থাপ্পরও মেরে বসতে পারি। তখন?’ ‘বলিস কি? জামাই এর গায়ে হাত তুলবি? কি সর্বনেশে কথা!’ ‘অবাক হচ্ছো ক্যানো? তোমার মেয়ের রাগ ক্যামন- জানো না? রাগ হলে দ্যাখো না-কত কী ভেঙ্গে ফেলি? অপুটা অঙ্ক না বুঝলে ক্যামন পিটাই সেটা তো দেখেছ।’ ‘তারপরও বলি-মেয়েরা অনেক কিছুই ম্যানেজ করতে জানে। তুই বুদ্ধিমতী। তুই আরও ভালো পারবি’। প্রেমা এবার একটু ভাবে। মায়ের মুখটা হাতে নিয়ে বলে, ‘একটা কথা সত্যি করে বল তো মা। তুমি জেনে বুঝেও এমন উঠে পড়ে লেগেছ ক্যানো বল তো? মাত্র তো দুটো বছর। মিঠু ভাইয়ের চেয়ে ভালো ছেলে কি আমি পেতে পারি না?’ ‘অবশ্যই পারিস। কিন্তু মেয়েদের মন-কখন কোথায় ডুব দিয়ে বসে সে ভয়টা কি মায়েদের হয় না?’ ‘না হয় না। অন্তত আমার মা সেই রকম মা না। আর আমিও ডুবে যাবার মেয়ে না। সো ডোন্ট ওয়্যারি।’ ‘ক্যানো তোর মামা ফজল না গজল কি একটা নাম বলছিল তোকে নাকি খুব ইয়ে টিয়ে করে. তোর ফেসবুক দেখেই তো বললো’ ‘ও...এই কথা! তুমি ভেবেছ আর দশটা মেয়ের মতো আমিও ডুবে ডুবে জল খাচ্ছি? কী যে বল না মা। আজব! এক সঙ্গে পড়লে বন্ধুত্ব হতে পারে না?.’ ‘বন্ধুত্ব থেকেই তো ইয়ে টিয়ে হয়। তোর তো কোন ছেলে বন্ধুও ছিল না। এখন আবার এগুলো কী?’ ‘প্লিজ মা শোন,ওই রকম কোন বন্ধুত্ব না। লেখাপড়ার জন্য যতটুক দরকার ততটুকুই। সেই ক্লাস নাইন থেকে কতজনই তো হাত বাড়িয়েছে, বাসা পর্যন্ত ফলো করেছে, ফুলের মধ্যে চিঠি লিখে ভয় দেখিয়েছে- কই ডুবেছি? সবই তো তুমি জানো মা।’ মা শায়লা বেগম এরপর আর কোন কথা খুঁজে পান না। তবে সন্তুষ্টও হতে পারেন না। ০২. ‘তোমাকে নিয়ে আমি কী করি বল তো? বলদ চেন বলদ?’ ‘কেন, কী হয়েছে? বলদ চিনতে হবে কেন।’ ‘ওইটাকে না চিনলে তো তোমার হুঁশ হবে না। কতবার বলেছি ফেসবুকে এমন কিছু লিখো না যাতে আমার সমস্যা হয়। ফেসবুক এখন সবাই দ্যাখে। মা তো দ্যাখেই, আমার যে মামাটা ফেসবুক চিনতোই না সে-ও এখন ফেসবুক চষে বেড়ায়। তুমি কোথায় কী লিখেছ আমার নামে সেটা মামা তো দেখেছেই, মার কান পর্যন্তও গ্যাছে। ক্যানো, ইনবক্সে লিখতে পার না?’ ‘আমি তো কিছু লিখি নি। প্রেমা নামে সুন্দর একটা কবিতা পড়েছিলাম এক কাগজে। সেটাই পোস্ট করেছি। আফটার অল আমার প্রেমাকে নিয়ে কবিতা। সবাই একটু দেখবে না?’ খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথাটা বলে সজল। ‘আমার প্রেমা মানে? আমি আবার তোমার হলাম কবে? আজব! এটা কেমন কথা? আমি তো তোমাকে এখনই রিজেক্ট করে দিতে পারি। কি, পারি না?’ ‘না পারো না। কারণ তোমার ওই স্টোন হার্টের ভেতরে খুব নরোম একটা স্পেস আছে। সেটা এই আমি। বুঝেছ?’ সজলের মুখে দুষ্টুমির হাসি। ‘আহা, কি আমার অন্তর্যামি রে! প্রেমা যে কতটা হার্ড হতে পারে সেটা জানো? রেজাল্টটা যদি আমার চেয়ে খারাপ হয়, তখন বুঝবে মজাটা। আর নতুন যে জ্বালাটা শুরু হয়েছে সেটা শুনলে তো তোমার ওই স্পেস ছেড়ে এখুনি পালাবে। ’ ‘সেটা আবার কী?’ ‘মেয়ে বড় হলে মায়েদের কী হয় জানো না? কন্যা বিদায়। বোঝা গেল?’ ‘সে কি! তোমার মা তো তোমাকে ফাইনালের আগে বিয়েই দেবে না শুনেছি। এখন আবার ওসব ক্যানো’? ‘ক্যানো, তার আমি কি জানি? আমার এক কাজিন মিঠুভাইকে মা’র খুব পছন্দ। এক চুল ছাড়া তাকে রিজেক্ট করার কোন অজুহাত নেই। সে আমার পড়াশোনা চালাতে দেবে- এই এ্যাসুওরেন্স পেয়েই মা মহাখুশি। এখন বোঝ ব্যাপারটা কত ক্রিটিক্যাল?’ ‘তো মত দিয়ে দিলেই তো পারো। সমস্যা কী?’ ‘সমস্যা কী মানে? ও কি আমাকে পড়তে দেবে? বউ পেলেই তো তোমরা ছেলেরা পাগোল হয়ে যাও। তাছাড়া ওর পড়াশোনার ক্যারিয়ার তো আমার চেয়ে অনেক ডাউনে। আমি ওর চেয়ে ভালো রেজাল্ট করি সেটা তো ও অবশ্যই চাইবে না। এটা সেটা বলে ডোমিনেট করবে। বোঝ এসব কিছু?’ ‘বুঝলাম। তুমি যে মানবে না সেটাও বুঝি। কিন্তু চুল নিয়ে কি যেন বলছিলে...?’ ‘হ্যাঁ, ওটা তো মাথার অর্ধেকটাতেই নেই। অবশ্যই বড় একটা ইস্যু বাট আমি জানি মা আমার পড়াশোনাকেই সবচেয়ে বেশি প্রায়রিটি দেয়। সে জন্যে ওটাকেই ঢাল বানিয়ে আপাতত ঠেকিয়েছি কিন্তু ফাইনালে কী হবে জানি না।’ হঠাৎ সজলের চুলের দিকে চোখ রাখে প্রেমা। কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, ‘সজল, চুলগুলোর এ অবস্থা কেন? দু’এক জায়গায় ফাঁকা ফাঁকা দেখছি। কোন সমস্যা?’ সজল একটু থতমত খেয়ে বলে, ‘না তেমন কিছু না। ভালো করে আঁচড়ানো হয়নি তো। সেজন্যেই হয়তোবা।’ সজল কি ঠিক বললো? না লুকালো? নিশ্চিত হতে পারে না প্রেমা। ০৩. মা শায়লা বেগম উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। মেয়ের জন্য এ্যাতো ভালো একটি সম্বন্ধকে কিছুতেই তিনি হাতছাড়া করতে চান না। নিজের খালাতো বোনের ছেলে মানে ঘরেরই ছেলে। কোনদিক থেকেই সে প্রেমার অযোগ্য নয়। সবচেয়ে বড় যে প্রেমার লেখাপড়া- সেটার নিশ্চয়তাটুকু পাওয়া গেছে। রাজশাহীতেই ছেলের চাকরি। প্রেমাও রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। বলতে গেলে মায়ের কোলেই থাকবে সে। কিন্তু প্রেমাটা বুঝছে না কেন? নিজের পছন্দ করা কেউ যে নেই সে ব্যাপারে শায়লা বেগম নিশ্চিত। কারণ ছেলেদের নিয়ে কিছু হলে মাকে বলতে দ্বিধা করে না প্রেমা। ফেসবুকে বন্ধু টন্ধু কেউ কেউ থাকতে পারে, সেটা কোন ব্যাপার না। কিন্তু মেয়েটার হার্ট বলে কি কিছু নেই? তারুণ্যের আবেগ উচ্ছ্বাস, অকারণ বিষণœতা? এসব কিছুই তো চোখে পড়ে না ওর মুখে। শুধু পড়া আর পড়া, অবসর পেলে বাচ্চাদের মতো গেমস খেলা, নয়তো ছোট ভাই অপুটার সঙ্গে খুনসুটি। মেয়েটা কি বড় হচ্ছে না? ম্যাচুরিটিতে কি কোন ঘাটতি থেকে যাচ্ছে? কিন্তু লেখাপড়াতে তো কোন ঘাটতি নেই। এ পর্যন্ত সবগুলো ক্লাসেই সে ফার্স্ট পজিশন ধরে রেখেছে। স্কুল কলেজ ইঞ্জিনিয়ারিং-সবখানেই সবার ভালোবাসা পেয়ে আসছে। মেয়ের এই দিকটি নিয়ে শায়লা বেগম বরাবরই হ্যাপি। কিন্তু বয়সের এই আবেগ উচ্ছ্বাসমাখা সময়টিতে মেয়েটি এ্যাতো নিস্পৃহ ক্যানো? পনেরোতে যেমন ছিল, এখন বাইশেও তেমনি। ছেলেদের নিয়ে এ রয়সের মেয়েদের যে স্বাভাবিক কৌতুহল, সেটা থাকবে না? এটা ক্যানো হবে? ছেলেদের ব্যাপারে ওর ধারণাটা আবার নেগেটিভ না তো! ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে হলেও বিয়ে হয়তো দেয়া যাবে কিন্তু ছেলেটাকে যদি ও ভালোবাসতে না পারে? তাহলে? নাহ্, এটা হতে দেয়া যায় না। একটা সিদ্ধান্তে এলেন তিনি। রাতে মেয়েটার সঙ্গে আবারো মুখোমুখি হয়ে যতটা সম্ভব খোলাখুলি কথা বলবেন। সমস্যা কী? নিজেরই তো মেয়ে। রাত ন’টার পরে প্রেমার ডাক পড়ে মা’র ঘরে। ‘ডাকছিলে মা? জরুরী কোন কিছু?’ ‘না মা। জরুরী তেমন না। এমনি একটু আলাপ করতাম। তোর বাবাটা হঠাৎ বিদেশে চলে যাবার পর খুব একা লাগে রে। তোর তো সময়ই হয় না।’ ‘ঠিক আছে, এই আমি বসলাম। বল কী বলবে।’ ‘তেমন কিছু না মা। সকালে বিয়ের কথা বলে তোর মনটা খারাপ করে দিলাম। তারপর থেকে ভালো লাগছিল না।’ ‘তো কী ভাবলে, মাথা থেকে ওটাকে তাড়িয়েছ?’ ‘না, ওটা কিছু না। তোর সঙ্গে তো অনেক কিছুই শেয়ার করি। তুইও করিস। তবু একটা ব্যাপার এখনও বুঝে উঠতে পারছি না রে।’ ‘কী সেটা?’ ‘আচ্ছা মা, এখন তো যথেষ্ট বড় হয়েছিস। ছেলে টেলেদের নিয়ে ভাবিস কিছু?’ ‘ওদের নিয়ে আবার ভাবাভাবির কী আছে? ওরা কি মেয়েদের কোন সম্মান দেয়? একটু ভালো করে কথা বললেই পেয়ে বসে। বান্দরের মতো মাথায় উঠতে চায়।’ ‘তেমন কেউ উঠেছে নাকি তোর মাথায়?’ শায়লা বেগম মৃদু হাসেন। ‘জানি তো এটা বলবে। শোন মা, তোমার কাছে আজ পর্যন্ত কোন কিছু হাইড করিনি। আজও করব না। কিন্তু ব্যাপারটা এমন যে বলতেও ঘেন্না হয়। হয়তো আমাকে ভুলও বুঝতে পারো।’ ‘তবুও বল। আমি কিছু মনে করবো না। আমি তো আমার মেয়েকে চিনি।’ ‘ওকে। শোন তাহলে। রাকিব নামের একটা ছেলে। বেশ ভদ্র। আমার দু’বছরের সিনিয়র। মাঝেমধ্যে ওনার কাছ থেকে পড়াশোনার ব্যাপারে সাজেশন নিতাম। যথেষ্ট শ্রদ্ধাও করতাম। তো একদিন রাকিব ভাই বললেন প্রেমা, এখন তো তোমার ক্লাস নেই, একটা নতুন টপিকস নিয়ে আলাপ করতে চাই। তো আমরা কি ওই লেকের পাড়ে একটু বসতে পারি? আমি বললাম-ক্যানো, এই লিচু গাছটার নিচেই তো বেশ নিরিবিলি। সমস্যা কী? উনি বললেন-না আসলে এখানে চেনাজানা অনেকেই আছে কেউ এভাবে দেখলে কিছু মনে করতে পারে। আমি আর আপত্তি না করে লেকের দিকে হাঁটতে লাগলাম। লেকের কাছে যেতেই দেখি জায়গাটা বেশ ঢালু। আগে এমনটা ছিল না। আমি নামবো কিনা ভাবছিলাম-হঠাৎ রাকিব ভাই আমার হাতটা ধরে বললেন-কী ভয় পাচ্ছো? এবার নামো। পড়বে না। আমার তো রাগে ভেতরটা জ্বলছে। নেমেই হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম। ভেবেছিলাম ওখানেই হয়তো বসা হবে। কিন্তু না। তিনি এগোচ্ছেন। সামনে মন্দিরের মতো ছোট্ট উঁচু একটা ঘর। সিঁড়িটা বেঁকে বেঁকে ওই ঘরটার দিকে উঠে গেছে। রাকিব ভাই বললেন- এখানে মনে হয় কখনো আসোনি। অনেক পুরোনো একটা মন্দির। দুজন প্রেমিক প্রেমিকা বাবা মার অমতে বিয়ে করে ভয়ে এখানে পালিয়ে থেকেছিল। পরে তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এরপর কারা যেন এটাকে প্রেম মন্দির নাম দিয়ে মন্দিরের মতো করে বানিয়ে রেখেছে। যারা নতুন প্রেমে পড়ে তারা একবার করে আসে এখানে দেখতে। আমি বললাম তো আমরা এসেছি ক্যানো? আমরা কি প্রেমে পড়েছি? রাকিব ভাই যেন আকাশ থেকে পড়েন। বলেন-ক্যানো...পড়িনি! আমি তো ভেবেছিলাম আমার মতো তুমিও...’তাকে কথাটা শেষ করতে দিলাম না। বললাম-স্যরি রাকিব ভাই, ভালোবাসার নষ্টামিটা এখনও আমার মধ্যে ঢোকে নি। আপনি ভুল মানুষের হাত ধরেছেন। চলুন ফিরে যাই।’ প্রেমা থামে। চোখদুটো ততক্ষণে ছলছল করছে প্রেমার। মাকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, বল মা আমি কি ভুল করেছি? ছেলেরা এমন ক্যানো মা? একটু হেল্প চাইলেই হাত ধরে ফ্যালে। একটু কাছাকাছি এলেই হা করে গিলে খেতে চায়। এর নাম কি ভালোবাসা মা? এমন ভালোবাসাকে কিভাবে শ্রদ্ধা করব বল?’ অনেকক্ষণ এভাবে কাঁদার পর মা শায়লা বেগম প্রেমার মুখটি তুলে ধরে বলেন, ‘তুই ঠিক করেছিস মা। আমার প্রেমাই তো এমন করে ভাববে। না হলে তুই প্রেমা কেন। আজ আমার সব দুর্ভাবনাই কেটে গেল। বিয়ে নিয়েও তোকে আর জোর করবো না। তুই নিজেই সব চিনতে শেখ মা। সে-ই ভালো।’ ০৪. প্রায় পাঁচ দিন হলো সজল লাপাত্তা। সেলফোনটাও বন্ধ। বাসায় খোঁজ নিয়ে শুধু জানা গেছে সপ্তাহখানেক আগে কি এক জরুরী কাজে ঢাকায় গেছে সে। সেই থেকে সবার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ। কোথাও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ হলো কী ছেলেটার। আলাদা এক স্বভাবের ছেলে সজল। ভীষণ চঞ্চল। আর মেধাবিও। চুটিয়ে আড্ডা দিয়ে সারা ক্যাম্পাস মাতিয়ে রাখে। শুধু প্রেমার সামনে এলেই একেবারে সুবোধ শান্ত ছেলে। আর এমন অনুগত যে প্রেমা চাইলে সে পাহাড়ও কেটে এনে দিতে পারে। ওর এই ছেলেমি স্বভাবটিকে খুব এনজয় করে প্রেমা। একটা মুগ্ধ করা ভালোলাগাও জন্মে গেছে ওর অজান্তে। তবে ওইটুকুই। এর চেয়ে বেশি কিছুর ভাবনা আপাতত নেই ওর। সজল হয়তো সেটা পারেনি। না পারুক। বাড়াবাড়ি করার মতো ছেলে ও না প্রেমা জানে। তো যে সজল সবকিছুই শেয়ার করে প্রেমার সঙ্গে সেই ছেলে প্রেমাকে কিছুই না জানিয়ে উধাও হতে পারলো কি করে! উদ্বেগের সাথে তখন একটা অভিমানও জমতে শুরু করে বুকের ভেতর। প্রেমা তারপরেও ভাবে- কোন ট্র্যাপে পড়লো না তো! কিংবা গুম টুম কিছু! এসব টেনশনে ঘুম, পড়াশোনা সবই গ্যাছে প্রেমার। কারো সাথে শেয়ারও করতে পারছে না ব্যাপারটা। সারাক্ষণ ফেসবুক সেলফোনে চোখ রাখছে-যদি কোন খবর মেলে। অবশেষে নিখোঁজের সপ্তম দিনে একটা মেসেজ আসে প্রেমার ফোনে। সজলের মেসেজ। ‘আমি ধানম-ির একটা ক্লিনিকে আছি। ভালো আছি। চিন্তা করো না। শিগগিরই আসছি।’ ওহ্, একটা দমবদ্ধ হওয়া অবস্থা থেকে যেন মুক্তি মেলে প্রেমার। সজলের সেলফোনটি তখনও বন্ধ পেয়ে রাগে অস্ফুট স্বরে বলে, ‘উহ্, এ্যা-ত্তো কষ্ট দিতে পারো তুমি সজল!’ দিন তিনেক পর। প্রেমা ক্লাসশেষে দোতলা থেকে নামছিল। সেলফোন বেজে ওঠে। সজল। ‘রাগ করো না প্রেমা। চুলগুলো উঠতে উঠতে মাথাটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিল। ভয় পাচ্ছিলাম তোমার সামনে যেতে। তুমি তো টাকুদের পছন্দ কর না। তো সোজা চলে এলাম ঢাকায় আর্মা এক পরিচিত কসমেটিক সার্জারির ক্লিনিকে। মাথার পেছন থেকে চুল এনে সামনের পার্টে ছোট ছোট হোল করে চুলগুলো ধানের চারার মতো রোপণ করার কাজ চলছে। দারুণ লাগছে দেখতে চুলগুলো। আরেকটু বাকি আছে। এটাকে বলে ‘হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট’। কী, ঠিক করি নি?’ ‘না করনি। ফার্স্টলি- আমাকে ভয় পাবার কোন কারণ ছিল না। কারণ, আমি এখনও তোমার কেউ নই। সেকেন্ডলি- সবাইকে এভাবে টেনশনে রেখে একদম ভালো করনি। সামনে আসো। তোমাকে ফাইনালি রিজেক্ট করে দেব। ইয়াহ, আই মীন ইট।’ প্রেমার গলা থেকে সবটুকু ক্ষোভ ঝরে পড়ে। ‘পারবে না প্রেমা। তুমি ভালোবাসতে ভয় পাও। আমিই তোমার ভালোবাসার অভয়ারণ্য। জানো কি সেটা?’ ‘বাজে বকো না সজল। এসব কথায় আমি ভিজি না। আসছো কবে ?’ ‘আমার এখন সেকেন্ড সেশন চলছে। সুঁচ দিয়ে ছোট ছোট হোল করে চুল ট্রান্সপ্লান্ট করা হচ্ছে। একটু ব্যথা লাগছে। কিছু রক্তও ঝরছে। অলমোস্ট সারা মাথাই এখন রক্তে লাল। তুমি এখন আমাকে দেখলে ভয়ে শিউরে উঠতে।’ এরপর ফোনে অনেকক্ষণ কথা নেই প্রেমার। দ্রুত নিঃশ্বাসের সঙ্গে ফোঁপানির শব্দ পায় সজল। ‘কী হলো প্রেমা? কথা বলছো না কেন? তুমি কি কাঁদছো?’ ‘না কাঁদবো ক্যানো, হা হা করে হাসছি। তুমি আমার জন্য কেন এ্যাতো কষ্ট করতে গেলে সজল? ক্যানো? ক্যানো? কে আমি তোমার?’ চেপে রাখা কান্নাটাকে আর ধরে রাখতে পারে না প্রেমা। ‘যাতে রিজেক্টেড না হই সেই ভয়েই তো। আমি যে তোমার মতো কঠিনেরেই ভালোবাসতে চাই প্রেমা, যাতে আমার এই উড়নচন্ডি মনটাকে সামাল দিতে পারো ...।’ ‘তুমি আসো আগে। তুমি আমাকে অনেক কাঁদিয়েছ। তোমাকে দেখে ছাড়বো। তোমার সব ক’টা চুল আমি একটা একটা করে উপড়ে ফেলবো। তখন তোমার এই মিষ্টি মিষ্টি ভালোবাসা কোথায় থাকে দেখবো।’ ফোনটা নামিয়ে রাখার পরেও ফোঁপানো কান্নায় চোখ মুছতে থাকে প্রেমা। এ যেন নতুন এক উপলব্ধি ওর। বুকের ভেতরেও চাপ চাপ পাথর ভেঙে পড়ার এক মোহনীয় শব্দ। এ শব্দ তার অচেনা। তবুও অপূর্ব সে শব্দ! কান পেতে শুনতে ইচ্ছে করে প্রেমার। ভয় হয়। তবুও ইচ্ছে করে শুনতে। অবুঝ এক মুগ্ধতায়...।
×