ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শুভ্রেন্দু শেখর ভট্টাচার্য

মুক্ত গদ্য ॥ হ্যাপি বার্থডে

প্রকাশিত: ১৩:১২, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯

মুক্ত গদ্য ॥ হ্যাপি বার্থডে

বয়স যত বাড়ছে জীবনের সময় তত ফুরিয়ে যাচ্ছে। এখন জন্মদিনে কেউ যধঢ়ঢ়ু নরৎঃয ফধু বললে খুব একটা সুখী ভাব অনুভব হয় না, একটা বিষণœতাবোধ থেকেই যায়। বরং ঁহযধঢ়ঢ়ু নরৎঃয ফধু বললে মনের অবস্থার সঙ্গে কিছুটা মানান্ সই হয়। ঐধঢ়ঢ়ু নরৎঃয ফধু যে কেন বাংলায় শুভ জন্মদিন হলো তার কোন কারণ আমি খুঁজে পাই না। এটা বাংলায় প্রতিশব্দ সুখী জন্মদিন হওয়ার কথা। যাই হোক, কেউ কেউ আবার যধঢ়ঢ়ু নরৎঃয ফধু বলেই ক্ষান্ত হন না- সঙ্গে সধহ সুহু যধঢ়ঢ়ু ৎবঃঁৎহং ড়ভ ঃযব ফধু ইত্যাদি যোগ করে আবেগের পূর্ণতা প্রকাশ করেন। অবশ্য। যোগ করা কথাটি আবার শুনতে খারাপ লাগে না। কারণ জীবনের বাকি ক’টা দিন যদি বার বার সুখ নামক অধরা পাখিটা ফিরে আসে তাহলে মনে কিছুটা আশার সঞ্চার হয়, বেঁচে থাকার সাধ জাগে। সৃষ্টির আদিকাল হতে কেউ কি আর ইচ্ছা করে এ সুন্দর পৃথিবীকে বাই বাই বলেছে। মানব মনের এটা সম্মিলিত আর্তি, ‘মরিতে চাহি না আমি এ সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’ এরপরও এই সুন্দর পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়। তবে শেষ অধ্যায়টা যেন সুন্দর ও স্বাভাবিক হয়। প্রত্যেকে জীবনের এই শেষ বিকেলে সুস্থ দেহ, সুস্থ মনে বেঁচে থাকার আশা করে। জীবন সায়াহ্নে সব চাইতে বড় চাওয়া ও পাওয়া মনে হয় আমি যেন হেসে খেলে জীবন নদীর ওপারে চলে যেতে পারি। মৃত্যু যন্ত্রণায় দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী না থেকে আমার শেষ চাওয়া বেদনাহীন থেকে এক অনন্ত সুখ নিদ্রায় নিজেকে সমর্পণ করা। আমি যেন টের না পাই খাঁচার পাখিটা কখন আমাকে ছেড়ে গেল। আসলে মানুষের জীবনে সব চেয়ে ইপ্সিত চাওয়া বোধ হয় একটা স্বাভাবিক মৃত্যু। আশপাশে কত লোককে যখন দেখি স্ট্রোক করে, নার্ভ নিষ্ক্রিয় হয়ে, ক্যান্সারের অসহনীয় যন্ত্রণা বা জানা না জানা অন্য কোন রোগে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এক অসহায় পক্ষাঘাত গ্রস্থ রোগীর মতো শয্যাশায়ী থেকে ব্যাড সোর হয়ে জীবন কাটাচ্ছে তখন এক গভীর আতঙ্কে মন শিহরে উঠে। জীবন্মৃত লোকটা অহরহ মৃত্যু কামনা করে একদিকে যেমন নিজের মুক্তি চায় অন্যদিকে আপন জনদেরকেও তাঁর বোঝা বহে চলা থেকে মুক্ত করতে চায়। স্বজনরাও অবচেতন মনে ব্যাধিগ্রস্ত লোকটার দুঃসহ অবস্থা সহ্য করতে না পেরে একপর্যায়ে জরাগ্রস্ত দেহ খ-ের কখন প্রাণ বায়ুর শেষ নিঃসরণ হবে তাঁর জন্য আকুল হয়ে অপেক্ষার প্রহরগুনে। সাধে কি আর যুবরাজ সিদ্ধার্থ রাজ প্রাসাদের আরাম আয়াস, সুন্দরী স্ত্রীর বাহুপাশ ছিন্ন করে নির্বাণের অন্বেষণে বের হয়েছিলেন। সকল জরা, ব্যাধি, মৃত্যু হতে জগতের মানুষের চির শান্তির খোঁজে রাজকুমার রাজ্যসুখকে তুচ্ছ জ্ঞান করে গৃহ ত্যাগী হয়েছিলেন। কবি গুরুই মরণকে আলিঙ্গন করতে, মৃত্যুর কাছে সমর্পণ করে বলতে শিখিয়েছেন, ‘মরণরে তুহু মম শ্যাম সমান।’ কিন্তু সে ভাগ্য আর মানসিক সাম্যাবস্থা অর্জনের ক্ষমতা ক’জনের হয়! আমরা গান গাই, গানের মাঝে শক্তি সঞ্চয়ের আপ্রাণ চেষ্টা করি, কিন্তু প্রাণে সে শক্তির আঁধার না থাকলে গানের আবেগে ত আর শক্তি সৃষ্টি হয় না; কষ্টের মাত্রা তখন আরও বেড়ে যায়, লাখো কোটি মানুষের মাঝে কয়জন কবি গুরু হতে পারে। মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এই যে আমরা বন্ধু, প্রিয়জনদের জন্মদিনে শুভ কামনা করি তাঁর একটা পটভূমি রয়েছে। ইংরেজী ১৮৯৩ সালে আমেরিকার কেনটাকিতে পেটি ও জে, হিল ভগ্নিদ্বয় স্কুলের শিশুদের গাওয়ার উপযোগী, এড়ড়ফ সড়ৎহরহম ঃড় ধষষ কথাকলিকে সুর দিয়ে স্কুলে গাওয়ানো শুরু করেন। পেটি ছিলেন কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রিন্সিপাল এবং হিল ছিলেন গীতিকার। ঐধঢ়ঢ়ু নরৎঃযফধু ঃড় ুড়ঁ কথাকলির মেলোডি ১৯১২ সালে এড়ড়ফ সড়ৎহরহম ঃড় ধষষ-এর মেলোডিতে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে হ্যাপি বার্থ ডে রূপে ব্যবহারের প্রচলন হয়। প্রেক্ষিত বিবেচনায় হ্যাপি বার্থ ডে মূলত শিশুরদের পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে গুড মর্নিং এরই রূপান্তর। কালক্রমে শিশুদের স্তর পেরিয়ে বয়োবৃদ্ধ, বন্ধুবান্ধব, আপন জনদের মধ্যে জন্মদিনের শুভেচ্ছা প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম রূপে ইহার প্রসার লাভ করে। বস্তুতপক্ষে জীবন সায়াহ্নে এসে যদিও মানুষের মাঝে নেতিবাচক চিন্তাই প্রাধান্য বিস্তার করে, তথাপি সমাজে আবালবৃদ্ধবনিতা নির্বিশেষে কিছু বিষয় বেঁচে থাকার প্রেরণা হিসেবে কাজ করে, মানুষকে এত অস্তিরতা, ব্যস্ততা, হতাশা, উদ্দেশ্যহীনতার মাঝে উজ্জীবিত রাখে, শেষ দিন পর্যন্ত এগিয়ে চলতে গতির সঞ্চার করে। কারণ গতিই তো জীবন, থেমে যাওয়ার মাঝে জীবন থাকে না, থেমে যাওয়া মৃতের সামিল। পক্ষান্তরে হ্যাপি বার্থ ডের মাধ্যমে বন্ধুবান্ধব, আপনজন একে অন্যের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করে, অন্তরের একাত্মতা জানায়, হৃদয়ের অভিন্নতার বহির্প্রকাশ ঘটে। যুব বুড়ো নির্বিশেষে জন্মদিনে আপনজনের শুভেচ্ছা পেয়ে মানুষটা ভাবে সে নিঃসঙ্গ নয়, চারপাশে তাঁর হিতাকাক্সক্ষী আছে। বয়স যত বেশিই হোক বছরের এই দিনটাতে সে নতুন ভাবে আবার শুরু করার পরিকল্পনা করে। সাময়িকভাবে হলেও সে মৃত্যুর কথা ভুলে যায়, আর মনে আসলেও নব উদ্যমে ভাটা পড়ে না। আসলে একদিকে বয়সের অনুষঙ্গে মানুষের মধ্যে যখন শারীরিক ও মানসিক অবসাদ আসে তখন জীবনের এ যাবত কালের সকল অর্জনকেই অর্থহীন মনে হয়, যা হয়নি সেগুলোই প্রকট হয়ে উঠে, ব্যর্থতার গ্লানিই মনকে হতাশাগ্রস্ত করে ফেলে। তা ছাড়া অবসর জীবনের কর্মহীনতা শরীর মন দুটোকে অবসন্ন করে দেয়। সব কিছুতেই নেতিবাচক দিকগুলোই আগে ধরা পড়ে। সূচনা পর্বে এই আনহেপি বার্থ ডে বিষয় আসলে আমার মনের স্বাভাবিক অভিব্যক্তি নয়। আমিও উজ্জীবিত হই জন্মদিনে যখন আপনজন আমাকে শুভ জন্মদিন বলে শুভেচ্ছা জানায়, আমাকে ঘিরে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, ছেলে, মেয়ে নাতি, নাতনিরা উল্লাসে মশগুল হয় তখন মনে হয় জীবনে বেঁচে থাকার একটা অর্থ আছে, সার্থকতা আছে। আবার চাঙ্গা হয়ে উঠি। মনে হয় আনন্দই জীবন, ভালবাসাই জীবন, মানুষের ভালবাসা, শুভেচ্ছার মধ্যে একটা সঞ্জীবনী শক্তি আছে। ভালবাসায় সিক্ত হয়ে সবকিছু ভুলে আমারও মনে হয় আগামীকাল হতে আবার নতুন উদ্যমে, নতুন আশায় বাঁচতে শুরু করব। ইউলিসিসের মতো দীপ্ত শপথ নিয়ে আবার অন্ধকার সমুদ্রে ভেলা ভাসানোর আগে বলব, Made weak by time and fate, but strong in will To strive to seek, to find, and not to yield.
×