অরূপ স্কুলে যাবে। সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃকৃত্য সেরে খাবার টেবিলে গেল। টেবিলে নাস্তা নেই। ও মায়ের ঘরের দিকে তাকাল। ঘরের দরজা বন্ধ। মায়ের ক’দিন ধরে শরীর খারাপ। জ্বর জ্বর ভাব, সারাক্ষণ শীত শীত লাগে। সম্ভবত মায়ের হিমোগ্লোবিন কমে গেছে। এমন আগেও হয়েছে। বাবা ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট পাচ্ছেন না। এটা কেমন কথা, মানুষ অসুস্থ হলে ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট পাওয়া যাবে না! পেলেও ৮-১০ দিন পর। ওই অতদিন রোগী কি বিনা চিকিৎসায় থাকবে? অরূপের শিশুমনে এমন নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। দেশের হসপিটালগুলোর চিকিৎসা যদি ভাল হতো, তাহলে বড় ডাক্তারের পেছনে মানুষকে এত ছুটতে হতো না। আর বড় ডাক্তাররা এপয়েন্টমেন্টের নামে রোগীদের ঘুরাতেও পারত না।
মা বোধ হয় ঘুমিয়ে আছেন। ঘুম হয় না মায়ের। ঘুমের জন্য ছটফট করে করে বাধ্য হয়ে ঘুমের ওষুধ খান। তাই উঠতে দেরি হয়। অরূপ ফ্রিজ খোলে। ও জানে, কিছু না কিছু ব্যবস্থা করেই রেখেছেন মা। এমন কোনদিন হয়নি যে ও না খেয়ে স্কুলে গেছে। মায়েরা এত ভাল এত ত্যাগী এত নিঃস্বার্থ হয় কেন? অরূপের চোখ ছল ছল করে। মাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে ইচ্ছে করে ওর।
ফ্রিজ খুলে দেখে যা ভেবেছে তাই। মা নুডসল আর ডিমটোস্ট বানিয়ে রেখেছেন। ও বাটিতে নুডলস আর ডিসটোস্ট নেয় গরম করার জন্য। তখনই খুট করে মায়ের ঘরের দরজা খুলে যায়। রাত জাগার ক্লান্তি চোখে নিয়ে মা বেরিয়ে আসেন।
: ওঠো না, ওঠো না মা। আমি গরম করে নিচ্ছি। তুমি শুয়ে থাক ।
: আমি গরম করে দি, উঠেছি যখন।
মা কোন কথা শোনেন না। খাবার গরম করে ডিসটোস্ট টিফিনবক্সে ভরে দেন। অরূপ খায়, মা পাশে বসে থাকেন। অরূপ দ্রত খাচ্ছিল। মা বলেন,
: আস্তে খা। গলায় আটকে যাবে। খেতে হয় আস্তে আস্তে, চিবিয়ে।
খাওয়ার পর মা পানির গ্লাস এগিয়ে দেন।
অরূপ বলে,
: তুমি সবসময় বল নিজের কাজ নিজে করতে। তা তুমিই তো আমার কাজ সব করে দিলে।
: হ্যাঁ নিজের কাজ নিজে করবি। এখন করে দিচ্ছি, তোর জন্য করতে ভাল লাগছে তাই। সবসময় যে করে দেব তাও না। শুধু যে নিজের কাজ করবি তা না। অন্যের কাজও করবি । দুস্থ অসহায় প্রতিবন্ধী মানুষের পাশে দাঁড়াবি। তাদের সাহায্য করবি।
অরূপ মাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়। মা ওকে জড়িয়ে ধরে রেখেই বলেন,
: তোর ব্যাগটা আজ এত ভারি লাগছে কেন? বই বেশি নিয়েছিস? পিঠ যে বেঁকে যাচ্ছে। দুই চারখানা বই রেখে গেলে হয় না?
অরূপ হাসে। ভাবে, মা কেমন করে সব বুঝে যায়! বলে,
: কিচ্ছু হবে না মা। আসি
: সাবধানে যা, সাবধানে আসিস!
অরূপ রাস্তার মোড়ে দাঁড়ায়। একটা রিক্সা আসে। অরূপ উঠে বসে।
: কি ব্যাপার কই যাবেন? আমি যাবো কি যাব না, দামদর ঠিক করলেন না। উঠে পড়লেন যে?
: ভাই আপনি তো কোথাও না কোথাও যাবে। আমাকেও যেতে হবে। তাই উঠলাম। আমি যদি আপনাকে না ঠকাই, ন্যায্য ভাড়া দিই আপনি যাবেন না কেন? ধানমন্ডি বয়েজ স্কুল যাও
রিক্সাওয়ালা আর কিছু বলে না। ও চলতে থাকে। প্রচন্ড গরম। এবারের গরম রাজস্থানের গরমকেও হার মানিয়েছে। দরদর করে ঘামছে অরূপ। ততধিক ঘামছে রিক্সাওয়ালা। আহারে বেচারাকে তো এই গরমে অরূপকে তার ব্যাগসহ টানতে হচ্ছে!
রিক্সাওযালার জন্য কষ্ট হচ্ছে অরূপের। পাশেই শো শো করে কত গাড়ি চলে যাচ্ছে। এই তাপের প্রকোপ ওরা বুঝতে পারছে না এসির ঠান্ডা হাওয়ায়। কিন্তু এই রিক্সাওয়ালা, ওই ফলওয়ালা, ওই জুতো সেলাইওয়ালা, ওই হকার বা দিনমজুর! ওরা যে এই গরমের তাপে জ্বলছে!
মা মাঝে মাঝেই অরূপের সঙ্গে গল্প করেন। বলেন,
: বুঝলি বাবা, শেখাপড়া শিখে বড় চাকরি পাবার চেয়ে বড় কথা বড় মানুষ হওয়া। মানুষের পাশে দাঁড়ানো। মানুষকে ভালবাসা। দেখ যারা পৃথিবীতে বড় মানুষ, তারা কিন্তু ছেলেবেলা থেকেই মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। আমাদের বঙ্গবন্ধুর কথা ভাব। নিজের গায়ের জামা গরিব বন্ধুকে খুলে দিয়েছে। হাতের ছাতা দিয়ে এসেছে দিনের পরদিন। মানুষের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। নেতাজী সুভাস বসুর কথা ভাব। ছোঁয়াচে বলে মানুষ যখন যক্ষ্মা রোগীর পাশে দাঁড়াত না তিনি নিজে তার সেরা করেছেন। নিজ হাতে মানুষের সৎকার করেছেন। জাতপাত বিভেদ, হিন্দু মুসলিম মানেননি তিনি। এরা সবাই অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। ধর্মের চেয়ে মানুষকে বড় করে দেখেছেন। তাই এরা মহান। এরা বড় মানুষ।
অরূপ পৃথিবীর বড় বড় মনীষীর জীবনী পড়েছে । বাবা বলেন, পড়বে, যত পড়বে তত জানবে। প্রকৃতিকে ভালবাসবে। পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখবে। নিজের ঘর পরিষ্কার রাখালেই হবে না। চারপাশটা পরিষ্কার রাখতে।
জ্যামে আটকে ছিল রিক্সা। এ ভাবনা শেষ হবার আগেই ও দেখে পাশের রিক্সা থেকে একটা ছেলে খাবার খেয়ে পলিথিন রাস্তায় ফেলছে। ও চেঁচিয়ে বলে,
: ওভাবে ফেল না ভাই, হাতে রাখ। নিচে নেমে ডাস্টবিনে ফেল ।
ছেলেটা কটকট করে তাকায় অরূপের দিকে। তবে পলিথিনটা ফেল না।
অরূপ বলে,
: ধন্যবাদ ভাই। আমার কথা রাখার জন্য।
রিক্সা চলতে শুরু করেছে। তাপ আরও বাড়ছে। এই সকালে এত তাপ। হাঁপরের মতো উঠা নামা করছে রিক্সাওয়ালার বুক। ওর কি জলতেষ্টা পেয়েছে। অরূপ বলে,
: ভাই রিক্সাটা একটু পাশে রাখেন।
: কেন? কোন কিছু আনতে যাওয়া যাবেনা কিন্তু। আমি দেরি করতে পারব না।
: ওসব কিছু না। আপনি রিক্সাটা একটু রাখেন।
রিক্সাওয়ালা অসন্তুষ্টভাবে রিক্সা দাঁড় করায়। কিন্তু দাঁড় করানোর পর মনে হয় ও যেন বেঁচে যায়। ও বুক ভরে লম্বা একটা শ্বাস নেয়।
: আমি কোথাও কিছু আনতে যাব না। আমি বুঝতে পারছি আপনার কষ্ট হচ্ছে। তাই দাঁড়াতে বললাম। আমার স্কুলের একটু দেরি আছে। দুই চার মিনিট দাঁড়ালে কিছু হবে না। আপনি একটু জিরিয়ে নিন। এ সময়ের টাকা আমি আপনাকে দিয়ে দেব।
রিক্সাওয়ালা অবাক হয়ে তাকায়। লজ্জাও পায়। এমন যাত্রী সে আর দেখেনি।
: পানি খাবেন? আমার কাছে আছে।
অরূপ ব্যাগ থেকে এক বোতল পানি বের করে রিক্সাওয়ালার হাতে দেয় । বলে,
: খান। যদি পেটে ক্ষুধা থাকে এক টুকরো ডিমটোস্টও খেতে পারেন। মা দু’টুকরো দিয়েছে। আমি হিন্দু। কিন্তু খাবারে তো আর হিন্দু মুসলিম লেখা থাকে না। আর যদি থাকতও তাতেই বা কি। সবই তো মানুষ। সেই একই রক্ত, একই শিরা উপশিরা।
: না না আপনিই খান। এক টুকরোতে কি খাওয়া হয়?
: আরে ভাই, খান না। আমার ভাল লাগবে।
রিক্সাওযালা পরম পরিতৃপ্তি ভরে ডিমটোস্ট খেয়ে ঢকঢক করে আধ বোতল পানি খেয়ে নেয়।
: আরে আরে অত খাবেন না। একবারে অত খেতে নেই। বোতলটা রেখে দেন। পরে খাবেন। আমি রোজ দুই বোতল পানি নিয়ে বের হই। যদি কারও লাগে।
রিক্সাওয়ালার চোখ ছলছল করে। ও প্যাডেলে বাড়ি মারে। স্কুলের সামনে অরূপকে নামায়। অরূপ ওর হাতে বাড়তি টাকা দেয়। বাড়তি টাকাটা অরূপকে ফিরিয়ে দিয়ে রিক্সাওয়ালা বলে,
: আপনার মাথায় একটু হাত দিতে পারি বাবা?
অরূপ মাথা নিচু করে। রিক্সাওয়ালা ওর মাথায় হাত রাখে। তারপর এক ঝটকায় রিক্সায় ওঠে প্যাডেলে বাড়ি মারে। ওর পায়ে যেন অফুরান শক্তি। সেদিকে তাকিয়ে অরূপের তপ্ত দিনটা হঠাৎ করেই যেন ঠা-া হয়ে যায়!
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: