ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

এক নিঃ স্বার্থ হকিপ্রেমী মনিরুলের স্বপ্ন ও পরিকল্পনা ...

প্রকাশিত: ০৯:৩০, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯

এক নিঃ স্বার্থ হকিপ্রেমী মনিরুলের স্বপ্ন ও পরিকল্পনা ...

স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ হকি খেলতে বিভিন্ন সরঞ্জাম লাগে। এগুলো কিনতে অনেক অর্থ প্রয়োজন। পৃষ্ঠপোষক ছাড়া এগুলোর সংস্থান করা মুশকিল। বাহফে তাই বিভিন্ন সময় পৃষ্ঠপোষক সংগ্রহ করে সরঞ্জামগুলো কিনে থাকে। কিন্তু এক হকিপাগল ব্যক্তি আছেন, যিনি অনেক বছর ধরেই বিনা স্বার্থে, স্রেফ হকিকে ভালবেসে জাতীয় দল ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার হকি দলগুলোকে নিয়মিত হকি সামগ্রী উপহার দিয়ে আসছেন। নীরবে-নিভৃতে কাজ করা এই ব্যক্তির নাম মনিরুল ইসলাম। তাকে নিয়ে দৈনিক জনকণ্ঠ একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল ‘হকিকে ভালবেসে প্রবাসী মনিরুলের উদ্যোগ’ শিরোনামে, যা প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৮ সালের ২৩ মার্চ। ২৮ বছর বয়সী মনিরুল মালয়েশিয়ায় একটি কোম্পানির স্টোরে চাকরি করেন। পাশাপাশি ব্যবসাও করেন। বিভিন্ন খেলার ক্রীড়াসামগ্রী বিক্রি এবং ডেলেভারির ব্যবসা। এগুলোর মধ্যে ফুটবল, ক্রিকেট ও হকির সরঞ্জামের ক্রেতাই বেশি। এই ক্রীড়া সামগ্রীর বেশিরভাগই নিজেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেই তৈরি করে থাকেন। এই ব্যবসার জন্য বৈধ ট্রেড লাইসেন্সও আছে তার। ২০১৫ সাল থেকে এই ব্যবসা শুরু। বিকেএসপির শিক্ষার্থী ছিলেন মনিরুল। ছিলেন হকি খেলোয়াড়। খেলতেন রাইট হাফ এবং উইং ব্যাকে। ২০০৬ সালে বিকেএসপিতে আয়োজিত যুব চ্যাম্পিয়নশিপ হকিতে অংশ নিয়েছিলেন। গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন ক্রীড়া সংস্থাকে হকি স্টিক, শিংগার্ড, হকি শু, হকি ট্রেনিং বল, বাস্কেটবলের কেডস, ফুটবল বুট, বাঁশি ও জার্সি দিয়েছেন মনিরুল। শুধু তাই নয়, জাতীয় হকি দলের অনেক খেলোয়াড়কেও তিনি বিনামূল্যে হকি সরঞ্জাম দিয়েছেন। মনিরুল ব্যবসায়িক কাজে দেশে এসেছি গত ৩১ আগস্ট। থাকবেন ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত। এয়ার এশিয়া ওমেন্স জুনিয়র এএইচএফ কাপ হকিতে অংশ নিতে বাংলাদেশ অ-২১ নারী জাতীয় হকি দল এখন সিঙ্গাপুরে। দলটাকে ন্যুনতম কিছু টাকা দিয়েছেন মনিরুল। স্বল্প পরিসরে কিছু পৃষ্ঠপোষকতাও করেছেন টিথ গার্ড, স্টিক, গ্রিপসহ বিভিন্ন সরঞ্জামাদি দিয়ে। দলের এক খেলোয়াড়কে পুরোপুরি স্পন্সর করেছিলেন, তবে তিনি সিঙ্গাপুরে যেতে পারেননি। এছাড়া সিঙ্গাপুর থেকে ফিরলে মহিলা দলের পাঁচ খেলোয়াড়কে বিভিন্ন হকি সরঞ্জাম দেবেন। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে বাকিদেরও দেবেন। জনকণ্ঠের সঙ্গে একান্ত আলাপনে মনিরুল জানান, ‘এছাড়া অ-১৮ পুুরুষ জাতীয় দল এই মাসের ১৮ তারিখে ভারতে যাবে খেলতে। দলের কোচ মামুনুর রশীদ। তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। সিদ্ধান্ত নিয়েছি তিনি এই দলটির চূড়ান্ত স্কোয়াড ঘোষণা করার পর আমি দলটাকে স্পন্সর করবো।’ অনেক আগে থেকেই জাতীয় দল ও জাতীয় বয়সভিত্তিক খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত এবং অ-আনুষ্ঠানিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে আসলেও এখনও বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের (বাহফে) সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতার ব্যাপারে কোন চুক্তিতে আবদ্ধ হননি মনিরুল। বাহফের সাধারণ সম্পাদক একেএমে মমিনুল হক সাঈদ দেশে ফিরলেই তার সঙ্গে দেখা করে এ বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করবেন তিনি। ঢাকায় এই উদ্দেশ্যে আসবেন আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর। এখন আছেন নিজের গ্রামের বাড়ি নাটোরে। তবে বাহফের সঙ্গে স্পন্সরশিপ নিয়ে আলোচনা করলেও এখনই চুক্তি করতে চান না মনিরুল। এই প্রসঙ্গে তার ভাষ্য, ‘আগামী ২০২০-২১ সালে বাংলাদেশে তিনটি বড়মাপের আন্তর্জাতিক হকি টুর্নামেন্ট হবে। ঠিক সেই সময়টাতেই বাহফের সঙ্গে আমার চুক্তি করাটা হবে উপযুক্ত সময়।’ মালয়েশিয়াতে মনিরুল ইসলামের ক্রীড়া সরঞ্জাম বিক্রির প্রতিষ্ঠানের নাম ‘এমজেএ স্পোর্টস।’ এম-এ মনিরুল, সেটা না হয় বোঝা গেল। কিন্তু ‘জে’ এবং ‘এ’ অক্ষর দিয়ে কি বোঝায়? উত্তরে মনিরুল যা বললেন, তা বেশ মজার, “‘এ’ দিয়ে বোঝায় আয়েশা, যিনি আমার স্ত্রী। আর হকি স্টিকটা দেখতে অনেকটা ইংরেজি অক্ষর ‘জে’-এর মতো, তাই ‘জে’ অক্ষরটা রেখেছি, আসলে এখানে ‘জে’ অক্ষর দিয়ে কিছু বোঝায় না!’ বিয়েটা কি লাভ ম্যারেজ, না এ্যারেঞ্জ ম্যারেজ ছিল? লাজুক কণ্ঠে মনিরুলের জবাব, ‘দুটোই।’ কতদিনের প্রেম ছিল? প্রথমে বললেন, ‘একটু ছিল’। পরে ভালমতো চেপে ধরতেই বেরিয়ে এল আসল ব্যাপার-একটু না, অনেক বেশিই ছিল! ২০০১ সাল। হাই স্কুলে পড়ার সময় থেকেই পরিচয় সহপাঠী আয়েশা আক্তারের সঙ্গে। প্রথমে ভাল লাগা, তারপর ভালোবাসা। ২০০৭ সালে জীবিকার প্রয়োজনে পাড়ি জমাতে হয় মালয়েশিয়ায়। পরিচিতজনরা ধরেই নিয়েছিলেন প্রেমের ইতি এখানেই। কিন্তু মোবাইল, ফেসবুক এবং মাঝে মাঝে ছুটিতে দেশে এসে দীর্ঘ দশ বছর সম্পর্কটা ভালভাবেই টিকিয়ে রাখেন মনিরুল ইসলাম (তার মানে ১৭ বছরের প্রেমপর্বে ১০ বছরই ছিলেন দেশের বাইরে!)। সেই সঙ্গে নিজের ও আয়েশার পরিবারকে ‘ম্যানেজ’ করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। তাতে সফলও হন। ২০১৭ সালের ৩ মার্চ বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন দুজন। এমজেএ স্পোটর্স শুধু মালয়েশিয়াতেই ব্যবসা করছে না, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্পোর্টসের দোকান এবং বিভিন্ন ক্রীড়া ফেডারেশনের এবং বিভিন্ন ফুটবল ও হকি খেলোয়াদের সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করে ব্যবসা করে। ফেডারেশন এবং খেলোয়াড়রা উন্নত ক্রীড়া সরঞ্জাম কিনতে চাইলে শরণাপন্ন হয় মনিরুলের এমজেএ স্পোটর্সের। ভবিষ্যতে ঢাকায় একটি শোরুম খোলার পরিকল্পনা আছে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মনিরুলের। স্ত্রী আয়েশা মনিরুলের ব্যবসাকে পুরোপুরি সমর্থন করেন, উৎসাহও দেন। মনিরুলও ইতোমধ্যেই আয়েশাকে তার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। মনিরুলের মতো এমন নিঃস্বার্থ হকিপ্রেমী-দাতা আরও এগিয়ে আসবেন হকির উন্নয়নে, এটাই হকিপ্রেমীদের নিগুঢ় প্রত্যাশা।
×