ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জলি রহমান

উচ্চ প্রবৃদ্ধির দেশ বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১২:১৪, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯

উচ্চ প্রবৃদ্ধির দেশ বাংলাদেশ

বাংলাদেশ এখন অনেক দেশেরই উন্নয়নের রোল মডেল। ক্রমশ অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় এগিয়ে চলছে এ দেশের অর্থনীতি। একটি দেশ উন্নয়নের কোন স্তরে রয়েছে তার চিত্র ফুটে ওঠে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) থেকে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনেকগুলো স্তর বিবেচনা করে আমরা জিডিপি পরিমাপ করি। এবার দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৮ দশমিক ১ শতাংশ । বর্তমান সরকারের পরিকল্পনা ২০২৩-২৪ সালে এই প্রবৃদ্ধির হারকে ডবল ডিজিটে নিয়ে যাওয়া। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সারা বিশ্বে সবার ওপরে ২০০৯ থেকে ২০১৯ এই দশ বছরের বৈশ্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া যায়। কারেন্ট প্রাইস মেথডে (চলতি বাজার মূল্য পদ্ধতি) গত ২৯ আগস্ট ২০১৯ এ ‘দ্য স্পেক্টেটর ইনডেক্স’ কর্তৃক প্রকাশিত বিশ্বের ২৬টি শীর্ষ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশের তথ্যের ভিত্তেতে অর্থমন্ত্রী এ বিষয়টি তুলে ধরেন। যেখানে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি শতকরা ১৮৮ ভাগ এবং অন্যান্য দেশের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চীনের প্রবৃদ্ধি ১৭৭, ভারত ১১৭, ইন্দোনেশিয়া ৯০, মালয়েশিয়া ৭৮, অস্ট্রেলিয়া ৪১, ব্রাজিল ১৭, যুক্তরাষ্ট্র ৪৭, যুক্তরাজ্য ১৭, দক্ষিণ আফ্রিকা ২৪ ও মেক্সিকো ৩৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। তালিকার অন্যান্য দেশের মধ্যে জার্মানি ১৫ শতাংশ, তুরস্ক ১০, নাইজিরিয়া ৪৯, পাকিস্তান ৬৫, মিসর ৫১ ও ফ্রান্সে ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে নেতিবাচক ধারায় রয়েছে স্পেন ও ইতালি। এর মধ্যে স্পেনের অর্জন ঋণাত্মক ৫ শতাংশ এবং ইতালির ঋণাত্মক ৮ শতাংশ। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, সামষ্টিক অর্থনীতি বিশেষ করে রফতানি, বিনিয়োগ, রেমিটেন্স প্রবাহ এবং ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে অবস্থা ভাল থাকায় উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন সহজ হয়েছে। আগামী চার বছরে প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন। বেসরকারী খাতকে প্রবৃদ্ধির ‘ইঞ্জিন’ উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, বিনিয়োগ সম্প্রসারণে সরকার সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে, যাতে বিনিয়োগকারীরা অধিকতর বিনিয়োগে উৎসাহী হন। তিনি জানান, চলতি অর্থবছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় দাঁড়াবে ১ হাজার ৯০৯ ডলার। গত অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৭৫১ ডলার। এছাড়াও সরকারের ১০০টি অর্থনৈতিক জোনের অধিকাংশের কাজ শুরু হয়েছে। যা কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যপক ভূমিকা পালন করছে। আসছে বিপুল বৈদেশিক বিনিয়োগ। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন। ২০১৭ সাল থেকে দেশটির অর্থনীতি ৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। পুরো এশিয়াজুড়ে সবচেয়ে বেশি আধিপত্য রয়েছে দেশটির। চীনের পর ১০ দশমিক ৩৮ ট্রিলিয়ন ডলার এশিয়ার দ্বিতীয় শীর্ষ অর্থনীতি রয়েছে ভারতের দখলে। গত বছরের চেয়ে ভারতের অর্থনীতি বৃদ্ধি পেয়েছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ‘২০১৮ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উঠতি বাজারের বৃদ্ধি ও উন্নয়নশীল অর্থনীতি আরও বৃদ্ধি পাবে। তারপর বৃদ্ধি থেমে যাবে। তাই নীতিনির্ধারকদের উচিত এই সুযোগের সঠিক ব্যবহার করা। আইএমএফ বহুদিন ধরে বলে আসছে যে, ভাল সময় বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কিন্তু সুষম নীতিমালা টিকে থাকে। ফিলিপিন্সের বর্তমান জিডিপি দাঁড়িয়েছে ৯৫৫ দশমিক ২ বিলিয়নে। একের পর এক দেশ ফিলিপিন্সের জিডিপি ছাড়িয়ে গেছে। তবুও দেশটি তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। বর্তমানে এশিয়ার শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে ফিলিপিন্স। অর্থনীতিবিদদের বিবেচনায়, মালয়েশিয়া বেশ সাবলীল ও শক্তভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, ইন্দোনেশিয়া বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে উঠতি বাজারগুলোর একটি। থাইল্যান্ড নতুন শিল্পোন্নত দেশ ও বেশ দ্রুত গতিতে উন্নতি করছে। ২০১৭ সাল থেকে দেশটির জিডিপি বৃদ্ধি পেয়েছে ৬ শতাংশ। বাংলাদেশ এখন এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ১৩তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকারে গত দুই যুগে সিঙ্গাপুর ও হংকংকে ছাড়িয়ে বাংলাদেশ এই অবস্থানে উঠল। এই অঞ্চলের দেশগুলোর মানুষের ক্রয়ক্ষমতার সমতা (পিপিপি) বিবেচনা করে প্রতিটি দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) কত হয়েছে, সেই হিসাব করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। সেই হিসাবে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে মোট ৭০ হাজার ৪১৬ কোটি ডলারের সমপরিমাণ পণ্য উৎপাদন ও সেবা সৃষ্টি হয়েছে। এডিবির ‘কি ইনডিকেটরস ফর এশিয়া এ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের এই চিত্র উঠে এসেছে। ক্রয়ক্ষমতার সমতা (পিপিপি) অনুসারে হিসাব করলে বিভিন্ন দেশের আর্থিক সক্ষমতার তুলনামূলক প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায়। এ বিষয়ে বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘এটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি ইতিবাচক বার্তা দেবে। সেই বার্তা হলো বাংলাদেশ দ্রুত উন্নয়ন করছে, সামষ্টিক অর্থনীতি শক্তিশালী অবস্থায় আছে, বিনিয়োগের সুযোগও বাড়ছে।’ এডিবির প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০০ সালে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে ছিল সিঙ্গাপুর। ওই বছর বাংলাদেশে মাত্র ১৫ হাজার ১৮০ কোটি ডলারের পণ্য উৎপাদন ও সেবা সৃষ্টি হয়েছিল। তখন সিঙ্গাপুরে সৃষ্টি হয়েছিল ১৬ হাজার ৭১৮ কোটি ডলারের পণ্য উৎপাদন ও সেবা। এরপর বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে। পরের ১০ বছরেই সিঙ্গাপুরকে ছাড়িয়ে যায় বাংলাদেশ। ২০১০ সালে বাংলাদেশের জিডিপির আকার দাঁড়ায় ৩৬ হাজার ৪০৫ কোটি ডলার। ওই বছরই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে পড়ে সিঙ্গাপুর। তখন সিঙ্গাপুরে পণ্য উৎপাদন ও সেবা সৃষ্টির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৬ হাজার ৩৩২ কোটি ডলার। এরপর বাংলাদেশের শুধু এগিয়ে যাওয়ার গল্প। ২০১৮ সালে সিঙ্গাপুরের চেয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ শতাংশ বেশি। একইভাবে হংকংকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশ। এই দেশটিও ২০০০ সালে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে ছিল। কিন্তু ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো হংকংকে পেছনে ফেলে দেয় বাংলাদেশ। গত বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বেড়ে হংকংয়ের চেয়ে প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি হয়েছে। তবে উন্নয়নের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ওই দুটি দেশের চেয়ে অনেক পেছনে। সরকারী তথ্যানুযায়ী দেশের প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ১ শতাংশ । প্রবৃদ্ধিতে দুটি বিষয় লক্ষণীয়। একটি হলো, এই প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে কি না। অন্যটি হলো প্রবৃদ্ধির সুবিধা সবাই পাচ্ছে কি না। অর্থনীতিতে রূপান্তর আনা দরকার। কেননা বাংলাদেশে এখনও ৩ কোটি ৯০ লাখ লোক দরিদ্র। তাদের মধ্যে ১ কোটি ৯০ লাখ অতি দরিদ্র। এছাড়া মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ অপুষ্টির ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সমাজে মুষ্টিমেয় কিছু লোকের হাতে অঢেল সম্পদ। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বাড়ছে প্রতিনিয়ত। একারণে প্রবৃদ্ধি টেকসই করা কঠিন। আগে রফতানিনির্ভর প্রবৃদ্ধি ছিল। এখন অভ্যন্তরীণ চাহিদানির্ভর প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। আশার কথা হলো বর্তমানে বাংলাদেশে বর্ধিত জনসংখ্যার অভিশাপ সত্ত্বেও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এর মূল কারণ হচ্ছে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে ধান উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়। বাংলাদেশের চাষাবাদের জমি সাধারণত ধান ও পাট চাষের জন্য ব্যবহৃত হলেও সাম্প্রতিক সময়ে গমের চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের যোগাযোগ, পরিবহন ও বিদ্যুত খাতে ব্যাপক উন্নতি হচ্ছে । এসব কাজে নিয়োজিত থাকে অসংখ্য সাধারণ মানুষ। যা দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশাল খনি রয়েছে এবং কয়লা, খনিজ তেল প্রভৃতির ছোটখাটো খনি রয়েছে। বাংলাদেশের শিল্প-অবকাঠামো দুর্বল হলেও এখানে দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা অঢেল এবং মজুরিও সস্তা। এদেশের অর্থনীতি এখন কৃষিনির্ভর নয় শিল্পনির্ভর। শিল্পখাতে এসব দক্ষ শ্রমিকদের কাজে লাগালে প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে বলে আশা করা যায়। যেসব শিল্পখাত দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ওষুধ শিল্প, জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি, চামড়া শিল্প, স্টিল শিল্প ও আলোক শিল্প। এসব শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকার ইতোমধ্যে অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। কিছু শিল্পের অবস্থা খুবই চাঙ্গা।
×