ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দশ বিলিয়ন ডলার ॥ এবার বিনিয়োগ আসছে আমিরাত থেকে

প্রকাশিত: ১০:৪৮, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯

দশ বিলিয়ন ডলার ॥ এবার বিনিয়োগ আসছে  আমিরাত থেকে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশের বিদ্যুত, জ্বালানি, বন্দর ও অবকাঠামো খাতে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (৩৭ দশমিক ৭ বিলিয়ন দিরহাম) বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিনিয়োগকারীরা। বাংলাদেশী মুদ্রায় যা প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশে কয়েকটি প্রকল্পসহ পাঁচটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলবে সংযুক্ত আরব আমিরাত। রবিবার দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ইকোনমিক ফোরামের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন দেশটির স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। সম্মেলনে প্রায় ২৫ নতুন বিনিয়োগ প্রকল্প উপস্থাপন করা হয়। এতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারী শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) এবং বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের (বিএইচটিপিএ) কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত ২০ সদস্যের সরকারী প্রতিনিধিদল অংশ নেন। অনুষ্ঠানে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাংলাদেশের তিন শ’র বেশি সরকারী কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী নেতা, বিনিয়োগকারী এবং উদ্যোক্তা উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে মূল বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারী শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক স্থানীয় ও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের আগ্রহ দেখে আমি অত্যন্ত খুশি।’ ‘আমরা সব সময় চীন, জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বড় ধরনের বিনিয়োগ দেখে আসছি। এখন আমরা বিশ্বাস করি জিসিসিভুক্ত দেশগুলো বিশেষ করে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ মাধ্যমে স্বল্প ব্যয়, অপারেশনস এবং উচ্চতর রিটার্নের সুবিধা নেয়া উচিত।’ তিনি বলেন, ‘সংযুক্ত আরব আমিরাত ও জিসিসিভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগের প্রধান উৎস হতে পারে। দেশের ভবিষ্যত অর্থনীতি গঠনে সহায়তা করতে এ বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।’ বাংলাদেশ সরকার ও বেসরকারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে বাংলাদেশ ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও ২৮টি হাইটেক পার্ক নির্মাণ করছে। মুক্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলের ধারণা বাস্তবায়ন করতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিনিয়োগকারীদের জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ একটা সুযোগ। সালমান এফ রহমান আরও বলেন, ‘সংযুক্ত আরব আমিরাত আমাদের সর্বনিম্ন শ্রমিক খরচ ও স্বল্প পরিচালনা ব্যয় থেকে লাভবান হতে পারে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও উপসাগরীয় অঞ্চলের বিনিয়োগকারী বন্ধুরা বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্রমবর্ধমান সুযোগ নিয়ে লাভবান হতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘আগামী বছরগুলোতে আমরা ইউএইর বিশাল কর্পোরেট কমিউনিটির সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য কাজ করে যাব যেন এই খাত থেকে বিনিয়োগের সুযোগ বের করা যায় এবং বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়ানো যায়।’ সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মুহাম্মাদ ইমরান বলেন, বাংলাদেশের বিদ্যুত, জ্বালানি, বন্দর ও অবকাঠামো খাতে আমিরাতের ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণায় দুই দেশের সম্পর্ক এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। এই বিনিয়োগ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে তুলতে সহায়তা করবে। এই বিনিয়োগ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করে তুলবে এবং কৌশলগত অংশীদারিত্বের যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক তা আরও গভীর হবে। রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, গত বছর বাংলাদেশের অর্থনীতি ৭ দশমিক ৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে এবং আমরা আশা করছি এই বছর নাগাদ তা ৮ দশমিক ৩ শতাংশে পৌঁছাবে। এটা বাংলাদেশকে পৃথিবীতে দ্রুত বর্ধমান অর্থনীতির দেশে পরিণত করবে এবং এটা থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতও লাভবান হবে বলে আমি আশা করি। এটা খুবই উৎসাহজনক যে এই দুই দেশের সম্পর্ক একদম সঠিক দিকে পরিচালিত হচ্ছে যেখানে উভয়দেশই একে অপরের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, এশিয়ান ইনফ্রাক্টাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) এর মতে, ২০২১ সালের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশে অবকাঠামো খাতে বার্ষিক ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন। এআইআইবি তথ্য অনুসারে, ২০১৭ সালে অবকাঠামোগত কাজে বিনিয়োগ দিগুণেরও বেশি হয়ে ৩১ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে হয়েছে। যা ২০১৮ সালে আরও বেড়ে ৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। বাংলাদেশকে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম ৩০তম দেশে পরিণত হতে হলে শুধু অবকাঠামো খাতে ৩২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রয়োজন। সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগকে (এফডিআই) ত্বরান্বিত করতে বাংলাদেশ এক শ’ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও ২৮টি হাইটেক পার্ক নির্মাণ করছে। ফলে গত বছরে বিনিয়োগের পরিমাণ ৬৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে তিন দশমিক ৬১ মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে।’ এতে আরও বলা হয়, ২০১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭.৯ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। বাংলাদেশের এই প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে কিছু বছরের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতি ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছাড়িয়ে যাবে যা বাংলাদেশকে পৃথিবীতে দ্রুত বর্ধমান অর্থনীতির দেশে পরিণত করবে। ৮ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে বাংলাদেশের প্রচুর বিদেশী ও স্থানীয় বিনিয়োগ প্রয়োজন যা প্রচুর কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করবে এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করবে। বিশ্ব ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে বিদ্যুত, সড়ক ও পানি সরবরাহে বাংলাদেশকে ২০২০ সাল নাগাদ প্রায় ৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন থেকে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হবে। বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ইউএই ও জিসিসিভুক্ত দেশগুলো প্রধান উৎস হতে পারে। সময় এসেছে বাংলাদেশের ইউএই থেকে অনুকূল বিনিয়োগের সুযোগগুলো নিয়ে দেশের ভবিষ্যত নির্মাণ করার। জানা গেছে, বাংলাদেশীরাই আমিরাতের অর্থনীতিতে প্রধান বিনিয়োগকারী যেখানে ৫০ হাজার ব্যবসা বাংলাদেশী প্রবাসী মালিকানাধীন ও তাদের দ্বারা সফলভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এসব ব্যবসা থেকে প্রায় দেড় লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এ লক্ষ নিয়ে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে বাংলাদেশ ইকোনমিক ফোরাম। সম্মেলনে ফোরামের সদস্য ও একজন বিনিয়োগ পরামর্শদাতা শেখ আব্দুল কারিম বলেন, একটি বেসরকারী পরামর্শক দল হিসেবে বাংলাদেশ ইকোনমিক ফোরাম বাংলাদেশী প্রকল্প অধিকারী ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দূরত্ব ঘোচাতে সদাপ্রস্তুত রয়েছে। এটা সরকারী খাতে বিভিন্ন সংস্থা ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও দূরত্ব দূর করে সকল ধরনের বিনিয়োগ উদ্যোগকে সহায়তা দিতে চায়। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তিন দিনের সফরে গিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে একটি বন্দর স্থাপন, শিল্প উদ্যান, সরবরাহ ও একটি তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনাল, বিদ্যুতকেন্দ্র এবং একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের বিষয়ে চারটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছিলেন। এছাড়া তখন আবুধাবির ক্রাউন প্রিন্স শেখ মুহাম্মাদ বিন জায়েদ এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সশস্ত্র বাহিনীর ডেপুটি সুপ্রীম কমান্ডার শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাত করে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্ক আরও এগিয়ে নিতে আলোচনা করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুবাইয়ের সেন্ট রেজিস হোটেলে এসব নথির স্বাক্ষর প্রত্যক্ষ করেন।
×