ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সারদায় শিক্ষানবিস পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী

জনগণ পুলিশকে যাতে বন্ধু ভাবতে পারে সেভাবে নিজেকে গড়ুন

প্রকাশিত: ১০:৪৯, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯

 জনগণ পুলিশকে যাতে বন্ধু ভাবতে পারে সেভাবে নিজেকে গড়ুন

মামুন-অর-রশীদ, রাজশাহী ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষানবীস পুলিশ কর্মকর্তাদের এমনভাবে নিজেকে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন যাতে বিপদে জনগণ তাদের বন্ধু ভাবতে পারে। যারা নবীন পুলিশ কর্মকর্তা এবং আজ মৌলিক প্রশিক্ষণ শেষে (এক বছরের) কর্মজীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন তাদের এটাই বলব যে, বিপদে জনগণের বন্ধু, এভাবেই নিজেকে গড়ে তুলবেন। তিনি বলেন, আপনাদের ওপর যে দায়িত্ব তা যথাযথভাবে পালন করবেন। সমাজের যেসব কালো বিষয় যা দেশ ও সমাজকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে, যুবসমাজকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে তার বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে। রবিবার দুপুরে রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির ঐতিহাসিক প্যারেড গ্রাউন্ডে ৩৬তম বিসিএসের সহকারী পুলিশ সুপারদের (এএসপি) শিক্ষা সমপানী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ আজ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে সমাদৃত মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বর্তমান সময়ে প্রতিনিয়ত অপরাধের ধরন বদলাচ্ছে। গতানুগতিক অপরাধের পাশাপাশি সাইবার ক্রাইম, মানিলন্ডারিং, মানবপাচার ইত্যাদি বৈশ্বিক অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ ও মাদকের মতো অশুভ সামাজিক ব্যাধি। সমাজ থেকে এসব অপকর্ম নির্মূলে এবং সমসাময়িক সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, জঙ্গীবাদ দমনে বাংলাদেশ পুলিশের অব্যাহত সাফল্য শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ব্যাপকভাবে প্রশংসিত। এদেশের মাটিতে আর কোনভাবেই জঙ্গী, সন্ত্রাসী ও যুদ্ধাপরাধীদের ঠাঁই হবে না। তিনি বলেন, প্রযুক্তির অপব্যবহার করে একটি স্বার্থান্বেষী মহল বিভিন্ন সময় গুজব রটিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। এসব গুজব রটনাকারীদের আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি মানুষকে সচেতন করার কর্মসূচী নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সরকার বিগত ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর এদেশের সার্বিক উন্নয়ন ও জনমানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নসহ সেবাপ্রাপ্তি সহজতর করার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কৃষি শিক্ষা স্বাস্থ্য বিদ্যুত জ্বালানি বৈদেশিক নীতি ও সম্পর্ক, গ্রামীণ অবকাঠামো, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সামজিক নিরাপত্তা প্রতিটি সেক্টরেই আজ কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে মহাকাশেও আমাদের অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে। যোগাযোগ খাতে আমাদের যুগান্তকারী উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। মেট্রোরেল এবং নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতুর নির্মাণ কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। ইতোমধ্যে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ঘোষণা করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিগত দশ বছরে আমরা পুলিশের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছি। এরমধ্যে, পুলিশের প্রায় ৪৯ হাজার ২০০ পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। বর্ধিত জনবলের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় যানবাহন ও সরঞ্জামাদি সরবরাহ করা হয়েছে। গাজীপুর ও রংপুরে নতুন মেট্রোপলিটন পুলিশ গঠন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, জঙ্গী ও সন্ত্রাস নির্মূলে পুলিশের ‘এ্যান্টি টেররিজম ইউনিট’, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), ট্যুরিস্ট পুলিশ, নৌ পুলিশ, দুটি স্পেশাল সিকিউরিটি এ্যান্ড প্রটেকশন ব্যাটালিয়ন গঠন করা হয়েছে। গার্ড এ্যান্ড প্রটেকশন পুলিশ গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসআই/সার্জেট পদ তৃতীয় শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর ইন্সপেক্টর পদ প্রথম শ্রেণীতে উন্নীত করা হয়েছে। জাতির পিতা প্রদত্ত আইজিপি র‌্যাঙ্ক ব্যাজ পুনঃপ্রবর্তন করে আইজিপি পদকে সিনিয়র সচিব পদমর্যাদায় উন্নীত করা হয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। আরও চারটি ট্রেনিং সেন্টার স্থাপনের কাজ চলছে। ঝুঁকিভাতা প্রবর্তন, ‘৯৯৯’ বিডি পুলিশ হেল্পলাইন এবং অনলাইন পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্ভিস চালু করা হয়েছে। পুলিশের বিভিন্ন স্তরে নারীদের নিয়োগের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ’৭৪ সালে জাতির পিতা প্রথম নারীদের পুলিশে নিয়োগ দেন। তিনি বলেন, পুলিশের আবাসন, রেশন, চিকিৎসাসেবা বৃদ্ধি, উন্নত প্রশিক্ষণ, লজিস্টিক সাপোর্ট, যানবাহন সরবরাহের পাশাপাশি অবকাঠামো নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকা- বাস্তবায়ন অব্যাহত রেখেছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ধাপে ধাপে ৯৫ হাজার ১৫৬ পুলিশ নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অতিসম্প্রতি বাংলাদেশ পুলিশের দশ হাজার কনস্টেবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নবীন পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণের সমস্যাকে দেখতে হবে একান্ত আন্তরিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে। জনগণের মনে পুলিশ সম্পর্কে যেন অমূলক ভীতি না থাকে সেজন্য জনগণের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। সমাজের নারী, শিশু ও প্রবীণদের প্রতি সংবেদনশীল আচরণ করতে হবে। সমাজ থেকে অপরাধ নির্মূলে জনসম্পৃক্ততার মাধ্যমে জনবান্ধব পুলিশ গঠনে আপনাদের অগ্রপথিকের ভূমিকা পালন করতে হবে। পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় জনগণের মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার ও আইনের শাসনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু তার বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্বের মাধ্যমে সর্বদাই এ দেশের পুলিশকে জনগণের পুলিশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অনুপ্রাণিত করতেন। বঙ্গবন্ধু পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে বলতেন- আপনারা স্বাধীন দেশের পুলিশ। আপনারা বিদেশী শোষকদের পুলিশ নন, জনগণের পুলিশ। আপনাদের কর্তব্য জনগণের সেবা করা, জনগণকে ভালবাসা, দুর্দিনে জনগণকে সাহায্য করা।’ আমি আশা করি আপনারা জাতির পিতার সেই প্রত্যাশা পূরণে আপনাদের ওপর অর্পিত পবিত্র দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে সর্বদা সচেষ্ট থাকবেন। ভাষণের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও বিশ্ববন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। তিনি জাতীয় চার নেতা ও মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে জীবন উৎসর্গকারী ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ নির্যাতিত মা-বোনকেও শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথমে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের নির্ভীক পুলিশ সদস্যরা। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে পুলিশ একাডেমিরও গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামে পুলিশের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ আমরা বাংলাদেশ পুলিশকে ‘স্বাধীনতা পদকে (২০১১)’ ভূষিত করেছি। তিনি দৃঢতার সঙ্গে বলেন, পুলিশের নবীন কর্মকর্তারাও তাদের পূর্বসূরীদের ন্যায় দেশপ্রেম, পেশাদারিত্ব ও অসীম সাহসীকতার সঙ্গে দেশের কল্যাণে কাজ করে যাবেন। ১৯৭২ সালের ৯ মে সারদা পুলিশ একাডেমিতে প্রথম প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে জাতির পিতার অংশগ্রহণের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মাধ্যমে এ দেশের পুলিশকে জনগণের পুলিশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অনুপ্রাণিত করতেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে দেশে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে চাই। আশা করি, আপনাদের প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ‘রূপকল্প-২০২১’ এবং ‘রূপকল্প-৪১’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট থাকবেন। এর আগে সকাল সাড়ে দশটায় হেলিকপ্টারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারদা পুলিশ একাডেমিতে পৌঁছেন। পরে প্যারেড মাঠে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। প্রধানমন্ত্রী অভিবাদন মঞ্চে গিয়ে নবীন পুলিশের সশস্ত্র সালাম গ্রহণ করেন। পরে একটি খোলা জিপে চড়ে তিনি নবীন পুলিশ কর্মকর্তাদের সমাপনী কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেন। প্রধানমন্ত্রী একটি সুসজ্জিত খোলা জীপে চড়ে বর্ণাঢ্য প্যারেড পরিদর্শন ও অভিবাদন গ্রহণ করেন। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনকারীদের (এএসপি) মাঝে পুরস্কার বিতরণ করেন। প্যারেডে ১৭ নারী অফিসারসহ ১১৭ শিক্ষানবিস সহকারী পুলিশ সুপার অংশ নেন। অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, ওমর ফারুক চৌধুরী এমপি, আয়েন উদ্দিন এমপি, প্রকৌশলী এনামুল হক এমপি, ডা. মনসুর রহমান এমপি, আদিবা আনজুম মিতা এমপি, রাজশাহী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী সরকার, নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শাহীন আকতার রেনী ছাড়াও পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তা, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
×