১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করে সামরিক শাসক আইয়ুব খান দেশের সকল রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক ইনস্টিটিউশনগুলোকে ধ্বংস করতে উঠেপড়ে লাগলেন। রাজনৈতিক দল ও নেতাদের সবদিক দিয়ে অবরুদ্ধ রাখার জন্য ‘এবডো’, ‘প্রোডো’ প্রভৃতি নব আবিষ্কৃত রাজনৈতিক অস্ত্র প্রয়োগ করা হতে লাগল। এছাড়া সকল প্রকার রাজনৈতিক কর্মকা-ের ওপর নিষেধাজ্ঞা তো ছিলই। পরিনামে গোটা পাকিস্তানজুড়েই সৃষ্টি হলো এক বিশাল রাজনৈতিক শূন্যতা এবং অসহনীয় পরিস্থিতি।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রতি প্রথম দিকে সাধারণ মানুষের কোন বিরুদ্ধ মনোভাব ছিল না। তবে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সামরিক শাসনের প্রতি সাধারণভাবে বিরূপ মনোভাব প্রকাশ পেতে থাকে। স্বাভাবিক কারণেই রাজনৈতিক মহল আইয়ুবের সামরিক শাসনের প্রতি বিরুদ্ধ মনোভাব প্রকাশ করতেন। উল্লেখ্য, ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ সময়কালে গোটা পাকিস্তানের প্রথম কাতারের রাজনৈতিক নেতা হিসেবে পরিচিত প্রায় সকলেই জেলে অন্তরীণ ছিলেন। তবে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ/আন্দোলন হোক এটা তারা চাইতেন।
এই সময়কালে বিক্ষিপ্ত ছোটখাটো প্রতিবাদ বা জমায়েতগুলোকেও সামরিক আইনের বিরুদ্ধে উচ্চারিত মতামত বলে লোকমুখে প্রচার হতো। সত্যিকার অর্থে সংগঠিত কোন জমায়েত বা প্রতিবাদের ঘটনার কথা জানা যায়নি। তবে এটাও সত্যি যে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংগঠিতভাবে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে কিছু করা সম্ভব ছিল না।
১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন
ঢাকাসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সর্বত্রই বিভিন্ন কলেজে, স্কুলে এবং দুই এক ক্ষেত্রে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট/ক্লাস বয়কট হয়েছে। তবে এগুলো একসূত্রে গাঁথা ছিল কিনা, তা জানা সম্ভব ছিল না।
আমি তখন ঢাকার কে, এল, জুবিলী স্কুলের ক্লাস নাইনের ছাত্র। স্কুলের প্রধান শিক্ষক কামরুজ্জামান ও আরও কয়েকজন শিক্ষক রাজনীতিক ও রাজনীতি সচেতন ছিলেন। তাঁরা বিভিন্ন সময়ে আমাদের রাজনৈতিক জ্ঞান দিতেন।
১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে তাঁরা বললেন, নতুন শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়িত করলে শিক্ষা বছরের মেয়াদ বেড়ে যাবে। যার ফলে বছর নষ্ট হবে এবং অভিভাবকদের ওপর আর্থিক চাপ পরবে। শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ কি ছিল তাঁরা তা বলেননি। আনুষ্ঠানিকভাবে কবে তা প্রকাশ করা হয়েছে তাও বলেননি। শুধু শরীফ কমিশন/হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন এই দুইয়ের কথা জানতে পেরেছিলাম।
সামরিক শাসন প্রত্যাহার এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি তখন পূর্বের তিন বছরের চেয়ে অনেক বেশি শোনা যেত। এর সঙ্গে শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ বাতিলের দাবি স্বাভাবিকভাবেই একত্রিত হলে নতুন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক দল ও নেতাদের অনেকেই ছাত্রদের দাবি (শিক্ষা কমিশন সুপারিশ বাতিলের দাবি) সমর্থন করে তাদের আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতে লাগলেন। তবে অপ্রকাশ্যে। আন্দোলনের ‘পলিটিক্যাল আন্ডারটোন’ যাই থাকুক না কেন, এই আন্দোলন সার্বিকভাবেই ছাত্র দ্বারা পরিচালিত ছিল এবং আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবস্থান ছাত্ররা নিয়েছিল।
এই আন্দোলন তৎকালীন সকল ছাত্র সংগঠনের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে। সে সময়কার প্রখ্যাত ছাত্র নেতা কাজী জাফর আহমেদ, হায়দার আকবার খান রনো, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, এনায়েতুর রহমান (ডাকসুর ভিপি), শেখ ফজলুল হক মনি, ওবায়দুর রহমান, মিজানুর রহমান শেলী, আবুল হাসনাত, সিরাজুল আলম খান, সাইফুদ্দিন মানিক ও সেই সময় তুলনামূলকভাবে স্বল্পপরিচিতদের মধ্যে কাজী আরেফ আহমেদ আন্দোলনের সম্মুখ সারিতে ছিলেন।
ঢাকা শহরে কমবেশি প্রায় সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষা কমিশনবিরোধী বিভিন্ন মিছিল, সভায় অংশ নেন। তবে জগন্নাথ কলেজ, জুবিলী স্কুল, ইস্টবেঙ্গল ইনস্টিটিউশন, পগোজ স্কুলের ছাত্ররা প্রতিটি সভা-মিছিলেই অংশ নিতেন।
১৭ সেপ্টেম্বর
সর্বদলীয় ছাত্র নেতারা সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সমাবেশ ও সমাবেশ শেষে মিছিলের কর্মসূচী ঘোষণা করলেন এবং এই কর্মসূচী সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছে দিলেন। ছাত্রদের পক্ষ থেকে সেদিন হরতাল ডাকা হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত কিছু জানতে পারিনি।
কর্মসূচী অনুযায়ী জুবিলী স্কুল থেকে ছাত্রদের একটি বিরাট দল সদরঘাট মোড়ে ইস্টবেঙ্গল ইনস্টিটিউশন, পগোজ স্কুল, কলেজিয়েট স্কুল, জগন্নাথ কলেজ, কায়েদে আজম কলেজ (সোহরাওয়ার্দী কলেজ) থেকে আগত ছাত্রদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এক বিরাট মিছিল আকারে পটুয়াটুলি, ইসলামপুর, বাবুবাজার, আরমানিটোলা, নাজিমুদ্দিন রোড হয়ে চানখাঁর পুলের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় পৌঁছায়। সেখানে ছাত্র নেতাদের বক্তৃতার পর বিশাল মিছিল রওনা হয়। মিছিলটি হাইকোর্ট, আবদুল গনি রোড, জিন্নাহ এভিনিউ (বঙ্গবন্ধু এভিনিউ), নওয়াবপুর, ভিক্টোরিয়া পার্ক হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় শেষ হওয়ার পরিকল্পনা ছিল।
মিছিলটা হাইকোর্টের গেটের সামনে এলে হঠাৎ করেই পুলিশের সঙ্গে মিছিলকারীদের সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। এখানে আগে থেকেই পুলিশ এবং ইপিআর বাহিনী অবস্থান নিয়েছিল। একপর্যায়ে মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণ হয়। পুলিশ অথবা ইপিআর বাহিনীর সদস্যরা গুলি ছুড়েছিল। ফলে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ছয়/সাতজন গুলিবিদ্ধ হন। তাদের ভেতর থেকে দু’জন মারা যান বলে পরে জানা যায়। মিছিলকারী ছাত্ররা পুনরায় নওয়াবপুর রেল ক্রসিংয়ের সামনে একত্রিত হয়ে ভিক্টোরিয়া পার্কের দিকে অগ্রসর হন। সেখানে আবারও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় এবং প্রায় সাত/আটজন ছাত্র পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হন। দুপুর ১২টা থেকে শুরু করে বিকেল সাড়ে তিনটার মধ্যে এই সংঘর্ষগুলো ঘটে। পরে নিহতদের কয়েকজনের পরিচয় পাওয়া যায়। ১১ জন নিহত হয় বলে জানা যায়, যাদের মধ্যে ছিলেন ছাত্র ওয়াজিউল্লাহ, বাবুল, মোস্তফা প্রমুখ।
এই ঘটনার পর শহরের সকল দোকানপাট, অফিস-আদালতের কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। পুরো শহরের পরিস্থিতি থমথমে হয়ে ওঠে। রাতে ঢাকার সকল ছাত্রাবাস, মেস ও বিভিন্ন সংগঠনের অফিসে পুলিশ রেইড করে। কয়েকশ’ ছাত্র ও বহু সাধারণ নাগরিক গ্রেফতার হন। ঘটনার নিন্দা করে কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার ছাপানো বিবৃতি বিলি করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি দাবি করে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একটি বিবৃতির ছাপানো কপিও কয়েকজনের কাছে দেখা যায়। এর কয়েকদিন পরে আমাদের স্কুলের শিক্ষকরা জানালেন শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ বাতিল করা হয়েছে।
লেখক : সাংবাদিক