ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তিন তরুণের ‘মজার পাঠশালা’

প্রকাশিত: ১২:১৪, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯

তিন তরুণের ‘মজার পাঠশালা’

আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া মানেই ব্যাগ ভর্তি বইয়ের বোঝার চাপে পড়ে সীমাহীন ক্লান্তির এক একটি দিন কাটানো। আর প্রতিষ্ঠানের গতানুগতিক লেখাপড়া যেন প্রায় সকল ছাত্রছাত্রীর কাছে রসকষহীন নিত্যকর্মের অপর নাম। বাস্তবতার কাছে পরাজয় স্বীকার করে, অভিভাবক ও শুভানুধ্যায়ীদের সন্তুষ্ট করতে, নিজ নিজ অবস্থান থেকে বলিষ্ঠরূপে আত্মপ্রকাশ করতে কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে অস্তিত্ব সঙ্কট মোকাবেলা করতে অনিচ্ছাসত্ত্বেও একঘেয়ে এই নিয়মকে না ভালবেসে তাদের উপায় নেই বললেই চলে। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে ২০০৯ সালে ভলিউডে মুক্তি পাওয়া ‘থ্রি ইডিয়ট্স’ সিনেমাটির কথা যা প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার নানা অসঙ্গতি তুলে ধরে দেশ বিদেশের দর্শকদের মাঝে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। আর আজ আমাদের দেশের তিন তরুণ যেন ঠিক সেই সিনেমার কাহিনীকেই বাস্তবে রূপদানের প্রয়াস পেয়েছেন। তারা তাদের স্বীয় মেধা ও শ্রমের মাধ্যমে গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থায় ভিন্ন রূপ সংযোজন করতে গড়ে তুলেছেন ‘মজার পাঠশালা’ নামে একটি অনলাইন পাঠশালা। পুরনোকে ছিন্ন করে পৃথিবীতে প্রত্যহ ঘটছে নতুনত্বের খেলা, শুরু হচ্ছে বদলে যাবার পালা। এই নতুনত্ব থাকতে পারে মানুষের নিত্যনৈমত্তিক কাজের ধরনে, ভিন্ন চরিত্রের বর্ণিল বর্ণনায়, ভাষায় ইত্যাদিতে। তবে যে জায়গায় সবার মতের মিল লক্ষ্য করা যায় সেটিও সেই ‘নতুনত্ব’। তাই তো নতুনত্বের রথে চড়ে জীবনের মানে খুঁজতে এবং অন্যকে নতুন জীবনের পথ দেখাতেই তাদের এই কর্মপ্রচেষ্টা। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেখ নাঈম হাসান মুন। তিনি বর্তমানে যশোর শিক্ষা বোর্ড সরকারী মডেল স্কুল এ্যান্ড কলেজে দ্বাদশ শ্রেণীতে বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়নরত। তার সহযোগিতায় রয়েছেন তারই সহপাঠী কেএম সাদ্বীন-শাহাদাৎ দ্বীন (হেড অব কমিউনিকেশন, মজার পাঠশালা)। এছাড়াও রয়েছেন সামিউল ফেরদৌস (কো-এডমিন,মজার পাঠশালা)। অল্প বয়সেই সেখ নাঈম হাসান মুন তার ক্যারিয়ারে যোগ করেছেন বেশকিছু অর্জন। সেগুলোর মধ্যে জাতীয় পর্যায়ে ৪০তম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সপ্তাহ (৩য় স্থান), বঙ্গবন্ধু স্মারক পৃরস্কার গ্রহণ-২০১৯, যবিপ্রবি বিজ্ঞানমেলা ২০১৯ (প্রথম স্থান), ৪০তম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলা ২০১৯ (তৃতীয় স্থান), ৫ম বিভাগীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সপ্তাহ ২০১৮ (প্রথম স্থান), ৩৯তম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলা ২০১৮ (প্রথম স্থান), উদ্ভাবকের খোঁজে ২০১৭ (সেরা ১৫), বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সাইবার ডেটাবেজ এনালাইজ এ্যান্ড প্রোটেকশন নিয়ে কাজ করা সবচেয়ে ছোট সাইবার এক্সপার্ট (২০১৬), এটুআই ফটোগ্রাফি ক্লাবের জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত মোট ১৩ জন সদস্যের মধ্যে সবচেয়ে ছোট চিত্রগ্রাহক হিসেবে নির্বাচিত, জাতীয় হাইস্কুল প্রোগ্রামিং ও কুইজ প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান অর্জন উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে আস্ক এক্সপার্ট দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য, ইয়াপিপাই এর ব্রোঞ্জ গ্রেডেড ডেভেলপার, বাংলাদেশ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কো ওয়ার্কিং স্পেস এর সবচেয়ে ছোট স্টার্টআপ এন্টারপ্রেনার, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রকল্পে কৃষিবন্ধু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক, আইসিটি ডিভিশনের স্টার্টআপ প্রজেক্টের সবচেয়ে ছোট উদ্যোক্তা এবং এনাবেল আইটির সিইও হিসেবে কর্মরত আছেন। তার পছন্দের কাজ প্রোগ্রামিং। এ পর্যন্ত তার বানানো মোট রোবটের সংখ্যা ২৩টি। এছাড়াও পছন্দ করেন ছবি আঁকা, ফটোগ্রাফি ও সিনেমাটোগ্রাফি। তিনি নাসা থেকে ২০১৬ সালে আমন্ত্রণও পেয়েছিলেন। প্রায় ২ বছরের পরিকল্পনার পর ২০১৮ সালের ৫ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা পায় ‘মজার পাঠশালা’। এর মূলমন্ত্র হলো ‘লার্ন আর্ন এস্টাব্লিশ’। ২০১৬ সালে অনলাইন স্কুলের প্রচলন যখন দেশে কেবল শুরু হচ্ছিল তখন থেকেই তার মাথায় চাপল অনলাইন স্কুল তৈরির ভাবনা। মজার পাঠশালা নিয়ে মাথায় পুরো পরিকল্পনাটা সাজিয়ে নেয়ার পর ২০১৭ সালে আমাদের বর্তমান ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তফা জব্বারের সঙ্গে পুরো বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি কিছু দিকনির্দেশনা দেন। অতঃপর জাফর ইকবাল, আয়মান সাদিক, সোলাইমান শুখনসহ অনেকের দিকনির্দেশনা নিয়ে যাত্রা শুরু হয় দেশের অন্যতম অনলাইন স্কুল মজার পাঠশালার। শুরুতে সেখ নাঈম হাসান মুন, আবরার শায়েখ আর সামিউল ফেরদৌস লাবিব এই ৩ জন মিলে কার্যক্রম শুরু করলেও পরবর্তীতে তাদের সঙ্গে আরও কিছু মানুষ যুক্ত হয় এবং কাজের গতি বাড়তে থাকে। ২০১৮ সালের মে মাসে আমাদের দেশের বর্তমান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সঙ্গে তাদের পরিচয় হয় এবং তখন থেকে মজার পাঠশালা বাংলাদেশ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং স্টার্টআপ বাংলাদেশের মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করার স্বীকৃতি অর্জন করে। অনলাইনে মজার মজার কন্টেন্টের ভিত্তিতে পাঠ্যপুস্তকের বিষয়গুলো সাবলীল ভঙ্গিমায় উপস্থাপনের মাধ্যমে গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার প্রতি ভীতি দূরীকরণই এই পাঠশালা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ক্যাম্পাস এ্যাম্বাসেডর নির্বাচিত করা হয়, যারা নিজ নিজ ক্যাম্পাসে মজার পাঠশালার প্রতিনিধত্ব করে থাকেন। তাদের প্রেষণাদানের লক্ষ্যে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ মজার পাঠশালার পক্ষ থেকে প্রায়শ ল্যাপটপ, স্মার্টফোন ও কম্পিউটার এক্সেসরিজ পুরস্কার হিসেবে প্রদান করা হয়। মজার পাঠশালা এর কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে- প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী বা ১ম থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য বোর্ড বইসমূহকে এনিমেশনে রূপান্তর, ঘরে বসে শিক্ষার্থীদের পড়ার সুযোগ সৃষ্টি, কম খরচে কারিগরি শিক্ষা, তৃতীয় লিঙ্গ, পতিতাবৃত্তিতে থাকা মানুষের সন্তানদের বিনামূল্যে শিক্ষাদান, অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের জন্য লেখাপড়ার সহজলভ্যতা সৃষ্টি, শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার পাশাপাশি নেতৃত্বদানে উৎসাহী করা ও উদ্যোক্তা সৃষ্টি করা, সববয়সীদের জন্য কেবল একটি মাত্র প্লাটফর্ম তৈরি করা। ভিন্নধর্মী এই কাজে নাইম হাসান মুন পেয়েছেন গুণীজনদের প্রেরণা ও পথনির্দেশনা। বর্তমান ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেন, ‘যাই কর, বাংলা ভাষায় করবি। মনে রাখবি, শুধু ছাত্রছাত্রী না চাষাদের কথাও ভাবা লাগবে।’ বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দিপু মনি বলেন, ‘মজার পাঠশালা অনলাইন স্কুলটি বেশ ভাল আর পতিতাবৃত্তিতে থাকা মানুষের সন্তান ও অটিজমদের নিয়ে অন্য কোন অনলাইনকে কাজ করতে দেখা যায় না। আমাকেও তোমরা মজার পাঠশালায় ভর্তি করে নাও।’ মজার পাঠশালায় একাডেমিক ও প্রফেশনাল কোর্সের ব্যবস্থা রয়েছে। একাডেমিক কোর্স বিনামূল্যে করানো হয়। আর প্রফেশনাল কোর্সগুলোতে বিভিন্ন মেয়াদে নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি-এর বিনিময়ে বেসিক রোবটিক, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (এসইও), বেসিক কম্পিউটার, ডিআইওয়াই-পাওয়ার পয়েন্ট, ফটোগ্রাফি, সিনেমাটোগ্রাফি, কন্টেন্ট এডিটিং, ফটোশপ প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। উল্লেখ্য, এক্ষেত্রে কোন প্রকার হিডেন কস্ট নেই। ১০-১২ জন থেকে কাজ শুরু করে আজ মজার পাঠশালার মোট সদস্য প্রায় ৩০০-এর কাছাকাছি। সারা পৃথিবীতে নতুন নতুন বিষয় সৃষ্টি হচ্ছে। বাড়ছে আমাদের কন্টেন্টের পরিমাণ। তাছাড়া পাঠ্যপুস্তকের বিষয়গুলো এনিমেটেড করা একটি ব্যয়বহুল বিষয়। তাই বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের টেম্পরারি কন্টেন্ট স্পন্সর এবং পারমানেন্ট কন্টেন্ট স্পন্সরের প্রয়োজন বলে এর প্রধান নির্বাহী জানান। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের প্রতি প্রত্যাশা ব্যক্ত করে প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, ‘চেঞ্জমেকিং কোন কঠিন কাজ নয়। টপিক আমাদের আশপাশে কিংবা হয়ত আমাদের নিজের মাঝেই রয়েছে। তোমার কাছে যা কঠিন ও বিরক্তিকর লাগে সেটা পরিবর্তন করতে পারলেই একজন মানুষ হিরো। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে ইচ্ছেটাই যথেষ্ট। তবে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে আমরা তরুণরা সমাজ বদলানোর কথা শোনাব না, বদলে দেখাব। আর আমরা পারবই।’ দেশ ও জাতির উন্নয়নে প্রয়োজন তথ্যপ্রযুক্তি সমৃদ্ধ আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা। জীবনের চাহিদার প্রয়োজনে বিশ্বে বর্তমানে প্রচলিত শিক্ষার স্থান দখল করেছে অনলাইন ও মিডিয়াভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা। আমাদের দেশেও ধীরে ধীরে অনলাইন ও ইলেক্ট্রনিক টেকনোলজির অগ্রগতির ফলে বাড়ছে কর্মক্ষেত্র। সেইসঙ্গে মানুষের দক্ষতা এবং কর্মক্ষমতাও বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। কর্মক্ষেত্রে প্রয়োজন শিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি। কাজেই আমাদেরও শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্রিটিশ আমল থেকে প্রবর্তিত গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষাকে নতুনভাবে বাস্তবমুখী করে সাজাতে হবে। যদি প্রাথমিক স্তরে জীবনাচরণ সম্পৃক্ত শিক্ষা প্রবর্তন করা যায়, তবে যে উদার ও সৃজনশীল চিন্তা একজন শিক্ষার্থীর মধ্যে গড়ে উঠবে, তা তাকে পরবর্তী শিক্ষা স্তরে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত করবে। জীবনঘনিষ্ঠ বাস্তবধর্মী শিক্ষার শক্তিই হচ্ছে উন্নয়ন ও জাতি গঠনের আসল শিক্ষা, জাতীয় জীবনে অগ্রগতির মূল চাবিকাঠি ও চালিকাশক্তি। এই শিক্ষার প্রভাবেই মানুষ কুসংস্কার, জড়তা ও হীনতা থেকে মুক্ত হয়ে জাতিকে শক্তিশালী ও সুসংগঠিত করতে পারে। কখনও জীবন সংগ্রামে বাধা এলেও একজন মানুষ সমাজ ও রাষ্ট্রের বোঝায় পরিণত না হয়ে পুনরায় নতুন উদ্যমে ঘুরে দাঁড়াতে পারে। আমাদের সোনার বাংলাদেশকে সত্যিকারের ডিজিটাল করতে গেলে আমাদের এ ক্ষেত্রে মনোযোগী হতে হবে।
×