ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের গর্ব রোমান সানা...

প্রকাশিত: ০৯:২৬, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের গর্ব রোমান সানা...

জনজোয়ারের বিচারে বাংলাদেশে বর্তমানে এক নম্বর খেলা ক্রিকেট। এরপরই অবস্থান ফুটবল, হকিসহ অন্যান্য খেলার। কিন্তু তিনটি খেলারই বর্তমানে বেহাল দশা বিরাজ করছে। আগেই মরে যাওয়া ফুটবল জেগে ওঠার চেষ্টা করছে। তবে অনেকটা তৈলাক্ত বাঁশে ওঠানামার মতো! হকির অবস্থাও অনেকটা এমন। নতুন নেতৃত্ব আসার পরও স্টিকের খেলার খুব বেশি উন্নতি চোখে পড়ছে না। সম্ভাবনাময় ক্রিকেট হতাশ করছে সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে জাতীয় ক্রিকেট দলের এমনই বেহাল দশা যে, যার-তার কাছে হেরে ইজ্জত বিসর্জন দিচ্ছে! দেশের প্রধান তিন খেলার এমন হ-য-ব-র-ল অবস্থার মধ্যে অন্যান্য কয়েকটি খেলায় দারুণ সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে শীর্ষ নাম আরচারি। তীর-ধনুকের এই খেলাটার নামও জানেন না আমাদের দেশের অনেক মানুষ। অথচ এই খেলাটাই ধারাবাহিকভাবে বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের মর্যাদা বাড়িয়ে তুলেছে। বিশেষ করে বলতে হয় আরচার রোমান সানার কথা। দেশসেরা এই আরচার এখন সবার নয়নের মণি। ধারাবাহিক চোখ ধাঁধানো সাফল্যের কারণে রোমান জাতীয় বীরে পরিণত হয়েছেন। হবেনই না বা কেন? গত কয়েক বছর ধরেই চোখ ধাঁধানো সাফল্য পাচ্ছেন দেশসেরা এই আরচার। খুলনার এই স্বর্ণছেলে গেল তিন মাসের মধ্যে দুইবার বাংলাদেশের পাতাকা বর্হিবিশ্বে উঁচিয়ে ধরেছেন। গত জুনে ২০২০ সালের টোকিও অলিম্পিকে খেলার যোগ্যতা অর্জনের তিন মাসের মধ্যে আরেকটি স্বর্ণসাফল্য পেয়েছেন রোমান। ১৩ সেপ্টেম্বর ফিলিপিন্সের ক্লার্ক সিটিতে এশিয়া কাপ ওয়ার্ল্ড র‌্যাংকিং টুর্নামেন্টের (স্টেজ-৩) রিকার্ভ পুরুষ এককে স্বর্ণপদক জয় করেন। রিকার্ভ পুরুষ এককের ফাইনালে চীনের সাই হেংকিকে ৭-৩ সেট পয়েন্টে পরাজিত করেন ২৪ বছর বয়সী বাংলাদেশী সুপারস্টার। পাশাপাশি দলীয় ইভেন্টেও সাফল্য পেয়েছেন। স্মরণীয় সাফল্যের পর দেশে ফিরলে বীরচিত সংবর্ধনা দেয়া হয় রোমানকে। দেশে ফিরে আবেগাল্পুত হয়ে পড়েন খুলনার তরুণ। আবেগী কণ্ঠে তিনি এশিয়া কাপের স্বর্ণপদক দেশবাসীকে উৎসর্গ করেন। এরপর সাফল্য প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটা অনেক বড় টুর্নামেন্ট। এই আসরে স্বর্ণপদক জেতা অনেক গর্বের। এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে আমি আশাবাদী। আমার এই পদক দেশবাসীকে উৎসর্গ করছি।’ ধারাবাহিকতা ধরে রেখে রোমানের মূল লক্ষ্য আগামী বছর হতে যাওয়া অলিম্পিকে ভাল করা। এজন্য যতটা সম্ভব নিজেকে তৈরি করবেন বলেও জানান রোমান, ‘এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে অলিম্পিকে পদক জয় করা সম্ভব। আমি এ লক্ষ্য নিয়েই নিজেকে প্রস্তুত করব।’ ক্যারিয়ারের শুরুর দিকের স্মৃতিচারণ করে তিনি আরও বলেন, ‘প্রথম যখন আরচারিতে আসি, তখন ইমদাদুল হক মিলন ভাই, শেখ সজীব ভাইকে দেখে অনুপ্রাণিত হই। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে তারা যখন স্বর্ণপদক জিততেন, আমিও চাইতাম। পরে তো জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়েও স্বর্ণপদক জিতেছি।’ তবে অলিম্পিকের আগে চলতি বছরের শেষের দিকে নেপালে হতে যাওয়া এসএ গেমসে পাখির চোখ রোমানের, ‘এসএ গেমসে এখনও আমরা স্বর্ণপদক পাইনি। আপাতত মূল লক্ষ্য এখানে স্বর্ণ জয় করা। তাছাড়া সবার লক্ষ্য থাকে অলিম্পিকে পদক জেতা। আমারও আছে। আসলে হয় কি, আরচারি এমন একটা খেলা, সেখানে নিজের সেরাটা দিতে পারলে, কিছুটা ভাগ্যের পরশ পেলে মিলে যায় অনেক কিছু।’ তবে হতাশার বিষয়, দেশকে গর্বিত করার পরও রোমানকে নিয়ে খুব একটা মাতামাতি লক্ষ্য করা যায়নি! রোমানের ইতিহাস গড়া স্বর্ণপদক জয়ের দিনে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল কোনোরকমে জিম্বাবুইয়েকে হারিয়ে ইজ্জত রক্ষা করে। অথচ ওই ম্যাচ জেতার পর ক্রিকেট দলকে অভিনন্দনে ভাসিয়ে দেয়া হয়। অর্থ পুরষ্কার তো আছেই। কিন্তু রেকর্ড গড়ে বিশ্ববাসীর সামনে বিদেশ থেকে স্বর্ণপদক জয়ের পর রোমানের ভাগ্যে একটা অভিনন্দন বার্তাও জোটেনি! এ নিয়ে স্বয়ং এই আরচার আক্ষেপ আর হতাশ প্রকাশ করেন। বাংলাদেশে ৪৬টি সরকারস্বীকৃত ফেডারেশন রয়েছে। সাফল্যের বিচারে সব ফেডারেশনকেই সমান গুরুত্ব দেয়া উচিত সরকারের। কিন্তু তদারকির অভাবে অমিত সম্ভাবনাময় অন্যান্য খেলাধুলা অনেকটা আড়ালে থেকে যাচ্ছে। অভূতপূর্ব সাফল্যের পরও শুধু ক্রিকেট ছাড়া অন্যান্য খেলাধুলাকে তেমন গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে না বলে অভিযোগ আছে। রোমানের বিস্ময়কর সাফল্যের পরও একটা অভিনন্দন বার্তা না পাওয়া এ সত্যতারই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে। সচেতন মহলের মতে, ক্রিকেট নিয়ে অতি আবেগী না হয়ে সব খেলাকে সমান গুরুত্ব দেয়া উচিত সংশ্লিষ্টদের। তাহলেই প্রত্যাশিত সাফল্য আসবে দেশের ক্রীড়াঙ্গন থেকে। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান রোমান বাংলাদেশ আনসারে সাধারণ চাকরি করেন। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে আসা এই তরুণ দেশকে গর্বে ভাসিয়ে চলেছেন। ১৯৮৬ সালে সিউল এশিয়ান গেমসে বক্সিংয়ে মোশাররফ হোসেনের ব্রোঞ্জ জয়ের পর এতদিন এশীয় পর্যায়ে আর কোন ব্যক্তিগত পদক ছিল না বাংলাদেশের। রোমান ব্যর্থতার এই ধারা থেকে বের হয়ে নতুন ইতিহাস গড়ে জিতেছেন সোনার পদক। আগামী বছর এশিয়ার দেশ জাপানের টোকিওতে বসতে যাচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও মর্যাদার ক্রীড়া আসর অলিম্পিক গেমস। মূলত অলিম্পিকই ক্রীড়াবিশ্বকে এক সুতায় আবদ্ধ করে থাকে। বৃহৎ এই মঞ্চে বাংলাদেশ থেকে দু’জন ক্রীড়াবিদ সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। একজন আরচার রোমান সানা। অপরজন গলফার সিদ্দিকুর রহমান। গত জুন মাসে হল্যান্ডে বসেছিল আরচারি বিশ্বকাপ। সেখানে রোমান সানা সেমিফাইনালে খেলেছেন বিশ্বের ৯২টি দেশের ২০০ প্রতিযোগীর সঙ্গে লড়াই করে। সেমিফাইনালে মালয়েশিয়ার খাইরুল আনোয়ারের কাছে হেরে গেলেও তখনই গলফার সিদ্দিকুর রহমানের পর সরাসরি টোকিও অলিম্পিকে খেলা নিশ্চিত হয় রোমানের। শেষ চারে হারলেও কোটা প্লেস পেয়ে ২০২০ সালের টোকিও অলিম্পিকে খেলার সুযোগ হয় তাঁর। সেমিতে হারের পর তৃতীয় স্থান অর্থাৎ ব্রোঞ্জের লড়াইয়ে বিশ্বের ছয় নম্বর তারকা ইতালির মাউরো নেসপোলিকে পরাজিত করেন। এর মধ্য দিয়ে বিশ্ব আরচারিতে দেশকে এনে দেন প্রথম পদক। অবশ্য রোমান সানা বিদেশের মাটিতে এর আগে আরও দুটি স্বর্ণপদক জিতেছেন। ২০১৪ সালে ‘প্রথম এশিয়ান আরচারি গ্রাঁ প্রি’ ও ২০১৭ সালে কিরগিজস্তানে ‘আন্তর্জাতিক আরচারি টুর্নামেন্ট’-এ। কিন্তু বিশ্বকাপে পদক জেতার মাহাত্মই তো আলাদা। বিশ্বকাপে সাফল্যের পর এশিয়া কাপে স্বর্ণ জিতে ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন তিনি। সেই সঙ্গে আগামী বছর অলিম্পিকেও স্বপ্নের পরিধি বাড়িয়ে দিয়েছেন। তীর-ধনুকের খেলা আরচারি। ইংরেজী ‘আরচরি’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ধনুর্বিদ্যা বা তীরন্দাজের সৈন্যদল। আদিম যুগের মানুষেরা মাংসাশী প্রাণী শিকার করে ক্ষুধা নিবারণ ও হিং¯্র প্রাণীর কবল থেকে আত্মরক্ষার জন্য সৃষ্টি করেছিল তীর-ধনুকের মতো অস্ত্রের। পরবর্তীতে অবশ্য এ অস্ত্রটি শিকার ও নিজেকে বাঁচানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, পরিণত হয় মানুষ হত্যার প্রধান হাতিয়ারে! আধুনিক যুগে গুলি, বন্দুক, বোমা আবিষ্কার হওয়াতে তীর-ধনুকের গুরুত্ব ঠিক অতটা নেই। তবে খেলাধূলায় এর ব্যবহার ভালভাবেই আছে। বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় খেলা আরচারিতে ব্যবহার করা হয় তীর-ধনুক। ভুটানে তো এটি জাতীয় খেলা হিসেবেই স্বীকৃত। সেই আরচারিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নজরকাড়া সাফল্য পাচ্ছে লাল-সবুজের বাংলাদেশ। আর এই সাফল্যের মূল কারিগার রোমান সানা। ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৬ সাল। টানা তিন বছর জাতীয় আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণ জয়ের কৃতিত্ব আছে রোমানের। এমন কৃতিত্ব আর কোন আরচারের নেই। ২০১৪ আসরে রোমান ৩৩৫ পয়েন্ট স্কোর করে ভেঙ্গে দেন ইমদাদুল হক মিলনের ২০১০ সালে গড়া ৩৩৩ পয়েন্টের জাতীয় রেকর্ড। তার এই রেকর্ড এখনও অটুট। রোমান খুলনার ছেলে। কয়রাতে তাঁর গ্রামের বাড়ি। বাবা চাকরিজীবী আব্দুল গফুর সানা এবং গৃহিণী মা বিউটি বেগমের ২ ছেলে, ১ মেয়ের মধ্যে সবার ছোট রোমান। তার জন্ম খুলনায়, ৮ জুন, ১৯৯৫ সালে। আরচারিকে পেশা হিসেবে নেয়ার আগে ক্রিকেট-ফুটবলই বেশি খেলতেন। দু’টিতেই ছড়িয়েছিলেন আলো। খুলনার যে স্কুলে পড়তেন নবম শ্রেণীতে (স্কুলের নাম শিশু মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়), ওই স্কুলের সহ-সভাপতি হাসান স্যার (তার পুরো নামটি মনে নেই রোমানের)। ২০০৮ সালের কথা। এক সপ্তাহের জন্য বিকেএসপির একটি যুব প্রশিক্ষণ ক্যাম্প হবে খুলনায়। হাসান স্যার রোমানকে আরচারি খেলা সম্পর্কে ধারণা দেন এবং ট্রায়াল দিতে উৎসাহিত করেন। তার কথা শুনে ট্রায়াল দেন রোমান এবং প্রথমবারেই টিকে যান! কিন্তু এরপরই হয় ঝামেলা। ট্রায়ালের চূড়ান্তে পর্বে যোগ দেয়ার আগে বিষয়টি জানতে পেরে রোমানর মা-বাবা বেঁকে বসেন! কিছুতেই তারা ছেলেকে যেতে দেবেন না বিকেএসপিতে! পরে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে-শুনিয়ে রাজি করানো হয় তাদের। এরপর কি হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এখন নিয়মিতই বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের নাম আলোকিত করে চলেছেন গর্বের প্রতীক রোমান সানা।
×