ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শাকিল আহমেদ মিরাজ

একটি এ্যাশেজ ও একজন স্মিথের গল্প...

প্রকাশিত: ০৯:২৬, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯

একটি এ্যাশেজ ও একজন স্মিথের গল্প...

পাঁচ টেস্টের এ্যাশেজ। এর মধ্যে চোটের কারণে এক ম্যাচ ও এক ইনিংস খেলতে পারেননি। চার টেস্টের ৭ ইনিংসেই ৭৭৪ রান করেছেন স্টিভেন স্মিথ। গড় ১১০.৫৭। সেঞ্চুরি ও হাফ সেঞ্চুরি সমান ৩টি করে। সিরিজে স্মিথের ইনিংসগুলো : ১৪৪, ১৪২, ৯২, ২১১, ৮২, ৮০ ও ২৩! এ্যাশেজের ইতিহাসে এক সিরিজে সর্বোচ্চ স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের রান ৯৭৪, অন্তত ৪ টেস্ট খেলেছেন সর্বোপরি এমন সিরিজে স্মিথের চেয়ে এগিয়ে আছেন আরও চার জন। স্মিথ হয়ত নতুন রেকর্ড গড়তে পারেননি, কিন্তু যে প্রেক্ষাপটে এই রান করেছেন, সেটি অবিশ্বাস্য। গত বছর কেপটাউন টেস্টে বহুল আলোচিত বল টেম্পারিংয়ের কারণে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ ছিলেন। বিশ্বকাপের পর সাদা পোশাকের টেস্টে ফিরেছেন প্রায় দেড় বছর পর। আর ফিরেই ব্যাট হাতে আলো ছড়িয়েছেন সাবেক অসি-অধিনায়ক। যার ওপর ভর করে দীর্ঘ ১৮ বছর পর ইংল্যান্ডের মাটি থেকে ঐতিহ্যের এ্যাশেজ ট্রফি নিয়ে ঘরে ফিরেছে তার দল অস্ট্রেলিয়া। জোফরা আর্চারের বাউন্স, ডেভিড ওয়ার্নারের অবিশ্বাস্য ফর্মহীনতা, আরও অনেক ঘটনার মাঝে ২০১৯ এ্যাশেজে স্মিথের নামটি বিশেষ ভাবেই লেখা থাকবে। ১৪২ বছরের টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে অনেক অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনের গল্প লেখা হয়েছে। স্টিভেন স্মিথের এমন ফেরা নিশ্চিত করেই তাতে বাড়তি মাত্র যোগ করবে। বহুল আলোচিত বল টেম্পারিংয়ের অপরাধে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন এক বছরের জন্য। অস্ট্রেলিয়া তো বটেই ওই ঘটনায় পুরো ক্রিকেটবিশ্বই কেঁপে উঠেছিল। বিশ্বকাপ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরেছেন, তবে তার দেশ শিরোপা ধরে রাখতে পারেনি। এবার দুর্দান্ত দুই সেঞ্চুরিতে টেস্ট প্রতাবর্তণটাকে স্মরণীয় করে রাখলেন স্মিথ। এজবাস্টনে এ্যাশজের প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে ১২২ রানে ৮ উইকেট হারানো অস্ট্রেলিয়া যে শেষ পর্যন্ত ২৮৪ রানের স্কোর গড়ে, সেখানে ২১৯ বলে ১৬ চার ও ২ ছক্কায় স্মিথ একাই করেন ১৪৪! প্রথম দিনের খেলা শেষে অকপটে স্বীকার করেছন এটি তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ইনিংস। টেস্টে দ্রুত ২৪ সেঞ্চুরির পথে বিরাট কোহলিকে পেছনে ফেলে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের পেছনেই জায়গা করে নিয়েছেন ৩০ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান। ২০৭ বলে ১৪ চারের দ্বিতীয় ইনিংসে করেন ১৪২। ২৫১ রানের বড় জয়ে প্রত্যাবর্তনেই ম্যাচসেরা স্মিথ। মাত্র পঞ্চম অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান হিসেবে এ্যাশেজের এক টেস্টে জোড়া সেঞ্চুরি করেন স্মিথ। তার আগে এই কীর্তি ছিল ওয়ারেন বার্ডসলে, আর্থার মরিস, স্টিভ ওয়াহ ও ম্যাথু হেইডেনের। সাবেক বাঁহাতি ওপেনার হেইডেন ২০০২ সালে জোড়া সেঞ্চুরি করেছিলেন। ১৭ বছর পর সে ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছেন স্মিথ। প্রথম টেস্টে আরও একটি কীর্তি গড়ে ইতিহাসের পাতায় নাম উঠিয়েছেন স্মিথ। সেখানে অবশ্য তিনি কারও পেছনে নন, বরং সবার আগে। সেদিন পর্যন্ত সাদা পোশাকে ১১৯ ইনিংসে তার সংগ্রহ ছিল ৬৪৮৫ রান। সমানসংখ্যক ইনিংস খেলে এই সংস্করণে তার চেয়ে বেশি রান করতে পারেননি আর কেউ। স্মিথের আগে এই রেকর্ড ছিল ইংল্যান্ডের ওয়ালি হ্যামন্ডের (৬ হাজার ৪৪০ রান) দখলে। লর্ডসে বহু আলোচিত দ্বিতীয় টেস্টে জোফরা আর্চারের বাউন্সার স্মিথের হেলমেট গলে মাথার পেছনের অংশে আঘাত করলে তৃতীয় টেস্টে আর মাঠেই নামতে পারেননি। করেছিলেন ৯২ রান। সুস্থ হয়ে ওল্ডট্রাফোর্ডের চতুর্থ টেস্টে ফের ইতিহাসগড়া ডাবল সেঞ্চুরি! অবিশ্বাস্য ব্যাটিংয়ে ক্রিকেটবিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছেন সুপার উইলোবাজ। ক্যারিয়ারের ২৬তম সেঞ্চুরির পথে প্রথম ইনিংসে ২৪ চার ও ২ ছক্কায় ৩১৯ বলে ২১১ রানের মনোমুদ্ধকর ইনিংস। দ্বিতীয় ইনিংসে ৮২। ১৮৫ রানের বড় জয়ে এ্যাশেজ ধরে রাখা নিশ্চিত করে অস্ট্রেলিয়া। এবারও ম্যাচসেরা সেই স্মিথ! নিষেধাজ্ঞার কলঙ্ক মুছতে এর চেয়ে ভাল কিছু আর হতে পারত না। ওভালে শেষ টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৮০ রান করার পর দ্বিতীয় ইনিংসে ২৩ রান করে আউট হন। ১৩৫ রানে ম্যাচ হারলেও ২-২এ সিরিজ ড্র করে ট্রফি নিয়ে দেশে ফেরে টিম পেইনের দল। কারণ গত বছর (২০১৮) ঘরের মাটিতে ৪-০’ ব্যবধানের জয়ে ট্রফি তাদের কাছেই ছিল। অতিমানবীয় ব্যাটিংয়ে নায়ক অবশ্যই স্টিভেন স্মিথ। ১১০.৫৭ গড়ে ৭৭৪Ñ ১৯৯৪ সালের পর কোনও টেস্ট সিরিজে সবচেয়ে বেশি ব্যক্তিগত রান সংগ্রহ করেন স্মিথ। ২৫ বছর আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ গেট ব্রায়ান লারা এক সিরিজে ৭৭৮ রান করেছিলেন। মাত্র ৪ রানের জন্য লারাকে ছোঁয়া হয়নি স্মিথের। তবে নতুন শতাব্দীতে স্মিথের ৭৭৪ রানই এক সিরিজে সর্বোচ্চ। ২০০০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত আগের রেকর্ডটিও ছিল স্মিথের দখলে। ২০১৪-১৫ সালে ভারতের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজে ৭৬৯ রান করেছিলেন তিনি। আর একাধিকবার নির্দিষ্ট একটি টেস্ট সিরিজে ৭০০’র বেশি রান সংগ্রহ করা ষষ্ঠ ব্যাটসম্যান হলেন স্মিথ। তার আগে এমন কৃতিত্ব দেখিয়েছেন স্মিথের পূর্বসূরী স্যার ডন ব্র্যাডম্যান, ভারতীয় লিটল মাস্টার সুনীল গাভাস্কার, ক্যারিবিয়ান যুবরাজ ব্রায়ান র্চালস লারা, উইন্ডিজ গ্রেট স্যার গ্যারি সোবার্স এবং তারই সতীর্থ এভার্টন উইকস। এ্যাশেজের ইতিহাসে এক সিরিজে সবচেয়ে বেশি রানের তালিকায় স্মিথের অবস্থান পাঁচ নম্বরে। একটি এ্যাশেজে তার চেয়ে বেশি রানের নজির রয়েছে ব্র্যাডম্যান (১৯৩০ সালে ৯৭৪ রান এবং ১৯৩৬-৩৭ সালে ৮১০ রান), ওয়ালি হ্যামন্ডস (১৯২৮-২৯ সালে ৯০৫ রান) ও মার্ক টেলরের (১৯৮৯ সালে ৮৩৯ রান)। অনেক রেকের্ড স্মিথ হয়ত পেছনে, তাবে নিষেধাজ্ঞার কলঙ্ক মুছতে এবারের এ্যাশেজ নাড়িয়ে দেয়া তার ইনিংসগুলোও ছিল স্মরণীয়। নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফেরার পর প্রথম টেস্ট সিরিজই কি না এ্যাশেজ! এজবাস্টনে প্রথম টেস্টে যখন মাঠে নেমেছিলেন দুয়োর চোটে মাঠে কান পাতা যাচ্ছিল না। পাঁচ টেস্ট, ছয় সপ্তাহ ও ১১৯৬ বল পর ওভালে সিরিজের শেষ টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ২৩ রান করে আউট হয়েছেন তখন তাঁর সম্মানে পুরো গ্যালারি উঠে দাঁড়িয়েছে। উষ্ণ করতালিতে মাঠ ভরে গেছে। এজবাস্টনে ১৪৪ ও ১৪২ রানের দুই ইনিংসের পর একে একে তাঁর ব্যাট থেকে দেখা মিলেছে ৯২, ২১১, ৮২, ৮০ ও ২৩ রানের ইনিংস। সহজ ভাষায় এবারের এ্যাশেজে ৭৭৪ রান করেছেন স্মিথ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের রান তাঁর অর্ধেকের কাছাকাছি। পুরো সিরিজের প্রথমবারের মতো ৮০ রানের নিচে আউট হওয়ার পরও তাই গ্যালারি উঠে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছে। ছয় সপ্তাহ আগেও দুয়ো দেওয়ায় ব্যস্ত থাকা প্রতিপক্ষই তাঁর সমর্থকদের দলে ভিড়ে গেছেন! এই শতাব্দীতে এক সিরিজে স্মিথের চেয়ে বেশি রান কেউ করেননি। এর আগের রেকর্ডটিও (৭৬৯, প্রতিপক্ষ ভারত) তাঁর। ইতিহাসেই এক সিরিজে তাঁর চেয়ে বেশি রান করার রেকর্ড আছে আরও এগারোজনের। ১৯৩০ সালে ডন ব্র্যাডম্যানের ৯৭৪ রান এখনও নাগালের বাইরেই থাকছে সবার। তবে বহুদিন পর কারও ব্যাটে ব্র্যাডম্যানকে ছাড়িয়ে দেওয়ার হুংকার শোনা গেছে। ১১০.৫৭ গড়ে রান তোলা স্মিথের পক্ষে কি সম্ভব হতো ব্র্যাডম্যানকে টপকানো? উত্তরে না বলার আগে একটি তথ্য মাথায় রাখুন, মাথায় চোট না পেলে আরও তিন ইনিংসে ব্যাট করার সুযোগ পেতেন স্মিথ। জীবনের সেরা ফর্মে থাকা স্মিথ, তিন ইনিংস আর ২০১ রানÑ এ সমীকরণের উত্তর জানা হবে না কখনও! তিন ইনিংস না খেলেই যা খেলেছেন, সেটাই অবিশ্বাস্য। এ সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম নয় ইনিংসের সর্বমোট রানের ৩৩ ভাগেরও বেশি রান এসেছে স্মিথের ব্যাট থেকে। ৩ ইনিংস কম খেলে। আজ সিরিজের শেষ ইনিংসে মাত্র ২৩ রানে আউট হওয়ায় পরিসংখ্যানটা একটু ‘বাস্তব’ রূপ নেয়। তবে সিরিজ শেষেও প্রথম দুই টেস্টের শেষে এ্যাশেজের উইকিপিডিয়ায় মজা করে দেওয়া সংজ্ঞা টাকেই সত্য বলে মনে হবে, এ্যাশেজ হলো সেই টেস্ট সিরিজ যা ইংল্যান্ড ও স্টিভ স্মিথের মধ্যে খেলা হয়! সত্যিই, সব দিক থেকে এগিয়ে থাকার পরও এ্যাশেজে যে ড্র (ওভাল টেস্টে ইংলিশদের জয়ী ধরে) মেনে নিতে হচ্ছে ইংল্যান্ডকে, তার কারণ স্মিথ আর তার ব্যাকরণ বদলে দেওয়া ব্যাটিং। স্মিথের উদ্দেশে বিবিসি ফাইভের বার্তা, ‘স্টিভ স্মিথ ২৩ রানে ফিরছেন। হ্যাঁ, আপনি ঠিকই পড়ছেন!’ বয়স মাত্র ৩০। ৯ বছরের ক্যারিয়ারে রান ৬৯৭৩। সেঞ্চুরি ২৬। ক্রিকেটের ইতিহাস কি বলে? কিংবদন্তিদের পথটা তো এভাবেই এগোয়...।
×