ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মারিয়াদের বিপর্যয়ের কারণ কি পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ম্যাচ খেলার অভাব?

প্রকাশিত: ০৭:২৫, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯

 মারিয়াদের বিপর্যয়ের কারণ কি পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ম্যাচ খেলার অভাব?

স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ এই বাক্যটিতে নিশ্চয়ই কোন দ্বিমত পোষণ করবেন না বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীরা-বিগত কয়েক বছরে পুরুষদের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে নারী ফুটবল। তবে আরেকটি অপ্রিয় ও রূঢ় বাস্তবতার বাক্য হলো-নারী জাতীয় দল বয়সভিত্তিক পর্যায়ে এশিয়ান পর্যায়ে গিয়ে বারবার একটি ব্যর্থতার বৃত্তে বন্দী হয়ে পড়ছে! উদাহরণ হিসেবে বলা যায় এএফসি অনুর্ধ-১৬ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের কথা। প্রতি দুই বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হয় এই প্রতিযোগিতাটি। এক বা দুই ধাপ বাছাইপর্ব খেলে এশিয়ার বিভিন্ন জোনের সেরা আটটি দেশ এই আসরের চূড়ান্ত পর্বে অংশ নেয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। এ নিয়ে আসরটি আয়োজিত হচ্ছে অষ্টমবারের মতো। প্রথম আসর বসেছিল সেই ২০০৫ সালে। ২০১৭ সালে সপ্তম আসরে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো এই আসরে নাম লেখায়। নতুন দেশ হিসেবে স্বভাবতই তখন বাংলাদেশকে নিয়ে তেমন কোন প্রত্যাশা ছিল না কারুর। সেরা তিনের মধ্যে থেকে সেবার ফিফা অ-১৭ নারী বিশ্বকাপের মূলপর্বে নাম লেখাবে বাংলাদেশ, এই স্বপ্নও দেখেননি কেউ। লাল-সবুজ বাহিনীও আহামরি কিছু করে দেখাতে পারেনি সেবার। সেই আসরে গ্রুপ ‘বি’তে প্রথম ম্যাচে উত্তর কোরিয়ার কাছে ৯-০ গোলের হারে শুরু, এরপর জাপানের কাছে ৩-০ এবং অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৩-২ গোলে হেরেছিলো তারা। তবে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ম্যাচটা দুভার্গ্যজনকভাবে হেরেছিল মারিয়া মান্দারা। ৮০ মিনিট পর্যন্ত তারা এগিয়েছিল ২-১ গোলে। ফরোয়ার্ড কৃষ্ণা রাণী সরকার লাল কার্ড পেলে কমে যায় বাংলাদেশের শক্তি। এই সুযোগে বাকি ১০ মিনিটে দুই গোল করে ম্যাচ জিতে যায় অস্ট্রেলিয়া। ফলে আক্ষেপের অনলে দগ্ধ হতে হয়েছিল মনিকা-তহুরাদের। দুই বছর পর আবারও এএফসি অ-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের চূড়ান্ত পর্বে পৌঁছে যায় বাংলাদেশের মেয়েরা। এবার তারা পড়ে ‘এ’ গ্রুপে। প্রথম ম্যাচে দারুণ খেলেও স্বাগতিক থাইল্যান্ডের কাছে ১-০ গোলে হেরে যায় তারা। দ্বিতীয় ম্যাচে তিনবারের চ্যাম্পিয়ন জাপানের কাছেও হেরে যায়। এবারের হারের ব্যবধানটা বেশ বড়, ৯-০। এই হারেই ২০২০ সালে ভারতে অনুষ্ঠেয় ফিফা অ-১৭ নারী বিশ্বকাপের চ‚ড়ান্ত পর্বে যাবার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায় আঁখি, ঋতুপর্ণা, নাজমা, সাজেদাদের। এখন আগামী ২১ সেপ্টেম্বর অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে নিজেদের তৃতীয় ও শেষ গ্রুপ ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ, যা তাদের জন্য স্রেফ নিয়মরক্ষার ম্যাচ। উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে প্রথমবার এই আসরে (সেবারও আসরটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল থাইল্যান্ডে) খেলার আগে মেয়েদের প্রস্তুতি যেন ভাল হয়, সেজন্য দারুণ পদক্ষেপ নিয়েছিল বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। সেবার তারা মেয়েদের থাইল্যান্ডে পাঠানোর আগে তাদের কন্ডিশনিং ক্যাম্প করতে দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে পাঠিয়েছিল চীন, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়াতে। সেখানে গিয়ে মেয়েরা বিভিন্ন একাডেমি এবং স্থানীয় দলের সঙ্গে ৬-৭টি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলে নিজেদের ভালমতো শাণিয়ে নেয়ার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু এবার থাইল্যান্ডে যাবার আগে মেয়েদের বিভিন্ন দেশে কোন কন্ডিশনিং ক্যাম্প হয়নি। জানা গেছে বাফুফে আর্থিক কারণে মেয়েদের গতবারের মতো বিভিন্ন দেশে ট্যুরে পাঠাতে পারেনি। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন চলে আসে সম্প্রতি বাফুফের সভাপতির বিরুদ্ধে ১৭ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়মের যে অভিযোগ তুলেছেন বাফুফের দুই সহ-সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মহি এবং বাদল রায়, সেই অভিযোগের সঙ্গে কি মেয়েদের ট্যুরে পাঠাতে না পারার আর্থিক বিষয়টি সম্পৃক্ত? তবে এবার আসর শুরুর ১০ দিন আগে মেয়েদের থাইল্যান্ডে পাঠায় বাফুফে। মূল লড়াইয়ে নামার আগে ৩টি গা-গরমের ম্যাচ খেলে মারিয়ারা স্থানীয় দলের বিরুদ্ধে। ২টিতে জেতে ও ১টিতে ড্র করে। হারায় যথাক্রমে ১-০ গোলে চুনবুরি একাডেমি (অনুর্ধ-১৭) দলকে এবং ৩-১ গোলে মুয়াংথং অনুর্ধ-১৭ গালর্স একাডেমি দলকে। ২-২ গোলে ড্র করে কাসেতসার্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে। আবারও প্রশ্ন উঠেছে, এত কম প্রস্তুতি ম্যাচ খেলাটা কি পর্যাপ্ত ছিল? এই আসরে প্রথমবারের মতো দলভুক্ত হয় ১২ ফুটবলার। এদের মধ্যে দুজন তখন পর্যন্ত কোন আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেনি। ২০১৭ এএফসি অ-১৬ আসরের চূড়ান্ত পর্বে খেলা বাংলাদেশ দলের ১১ ফুটবলার এই আসরেও আছে। সেক্ষেত্রে আরেকটি প্রশ্ন, দলে কি দক্ষ খেলোয়াড়ের ঘাটতি ছিল, যে কারণে জাপানের কাছে এমন বাজে হার? যদিও দেশ ছাড়ার আগে কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন জোর দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমাদের মেয়েরা দীর্ঘদিন ধরেই অনুশীলনের মধ্যে আছে। তারা আগের চেয়ে সবদিকেই অনেক উন্নতি করেছে। তাদের আত্মবিশ্বাসের মাত্রাও আগের চেয়ে অনেক বেশি। এগুলোই আমাদের দলের জন্য সম্পদ। ওখানে গিয়ে ৩টি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলে আমাদের আরও উন্নতি হবে।’ কিন্তু উন্নতি যে কতটা হয়েছে, সেটা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। তাছাড়া ছোটন আরও জানিয়েছিলেন বিদেশে গিয়ে প্রস্তুতি ম্যাচ না খেললেও দেশেই তারা মেয়েরা নিজেদের মধ্যে প্রচুর প্রস্তুতি ম্যাচ খেলেছে। ফলে আবারও মনে প্রশ্ন জাগে, নিজেদের মধ্যে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলে কতটা উন্নতি করা সম্ভব? সিনিয়র পর্যায়ে এখনও চূড়ান্ত সাফল্য না পেলেও বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টগুলোতে কিন্তু দুর্বার বাংলাদেশের জাতীয় মহিলা ফুটবল দল। তারা ছয়টি শিরোপা জিতেছে এ পর্যন্ত। এগুলো হলো : এএফসি অ-১৪ বালিকা চ্যাম্পিয়ন (আঞ্চলিক) আসরে দু’বার (২০১৫ ও ২০১৬), এএফসি অ-১৬ আসরের (২০১৬) আঞ্চলিক বাছাইপর্বে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন, সাফ অ-১৫ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপ (২০১৭), জকি ক্লাব গার্লস ইন্টারন্যাশনাল ইয়ুথ ইনভাইটেশনাল ফুটবল টুর্নামেন্ট (২০১৮) এবং বঙ্গমাতা অ-১৯ আন্তর্জাতিক গোল্ডকাপ (২০১৯)। এছাড়া রানার্সআপ হয়েছে সাফ অ-১৫ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে (২০১৮) এবং এএফসি অ-১৬ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপ বাছাইপর্বে (২০১৯)। প্রতিবারই দলের কোচ ছিলেন ছোটন। এখন দেখার বিষয়, নিজেদের শেষ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে স্বান্তনার জয় নিয়ে দেশে ফিরতে পারে কি না শামসুন্নাহার, আনুচিং, আনাই, নীলারা।
×