ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ক্যাসিনোয় অভিযানের পর রাজধানীর সব জুয়ার আসর বন্ধ ;###;জড়িতরা আত্মগোপনে ;###;গ্রেফতার যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদকসহ চার মামলা, সাত দিনের রিমান্ডে ;###;আরেক যুবলীগ নেতা সম্রাটও নজরদারিতে

ক্যাসিনো জুয়া চলবে না ॥ সরকার কঠোর অবস্থানে

প্রকাশিত: ১১:০৩, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯

ক্যাসিনো জুয়া চলবে না ॥ সরকার কঠোর অবস্থানে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ সারাদেশে জুয়ার আসর ও ক্যাসিনো বন্ধে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সরকার। ধারাবাহিকভাবে সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযান চালানোর নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। ঢাকাসহ সারাদেশের জুয়ার আসর ও নেপথ্য কারিগরদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। ঢাকায় চারটি ক্যাসিনোতে অভিযানের পর বন্ধ হয়ে গেছে রাজধানীর সব জুয়ার আসর। বিশেষ করে জুয়ার জমজমাট আসর হিসেবে পরিচিত ক্লাবপাড়াগুলোর প্রতিটি ক্লাবে এখন তালা ঝুলছে। জুয়ার আসর পরিচালনার সঙ্গে জড়িতরাও আত্মগোপনে চলে গেছে। গ্রেফতারকৃত যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও মানিলন্ডারিংসহ চারটি পৃথক মামলা হয়েছে গুলশান থানায়। খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে অস্ত্র মামলায় চার দিন ও মাদক মামলায় তিন দিন মোট সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে ঢাকা মহানগর আদালত। আরেক যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট নজরদারিতে আছে। যে কোন সময় তাকেও গ্রেফতার করা হতে পারে বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। যে সব ক্লাবে অভিযান চালিয়ে জুয়ার সামগ্রী পাওয়া গেছে, সে সব ক্লাবের বিরুদ্ধে পৃথক পৃথক মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, শুধু ক্যাসিনো নয়, সব অবৈধ ব্যবসার বিরুদ্ধে অভিযান চলবে। অনুমোদন না নিয়ে কেউ ক্যাসিনো চালাতে পারবে না। ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেছেন, জুয়ার বোর্ড, ক্যাসিনো পরিচালনার ক্ষেত্রে যত প্রভাবশালীরাই জড়িত থাকুক আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশ কঠোর হবে। ঢাকার বিভিন্ন এলাকার জুয়ার বোর্ড ও ক্যাসিনোর তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। অবৈধ ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান চলবে। তাস দিয়ে শুরু হয়ে ঢাকার ক্লাবগুলোতে প্রকাশ্যেই ওয়ান টেন জুয়ার আসর চলে আসছিল। বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোটের শাসনামলে ঢাকার ক্লাবগুলোতে জুয়ার বড় আসর হিসেবে পরিচিত ক্যাসিনো কালচারের যাত্রা শুরু হয়। সর্বশেষ ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময় দেশে অনলাইন ক্যাসিনো শুরু হয়। এসব জুয়ার আসর চালাতে বিদেশ থেকে দক্ষ জুয়াড়িদের ভাড়া করে আনা হতো। জুয়া বন্ধ করতে ধারাবাহিক অভিযান চলবে ॥ বুধবার ঢাকার ফকিরাপুলের ইয়ংমেন্স ক্লাব থেকে নারী-পুরুষসহ ১৪২ জনকে গ্রেফতার করা হয়। জব্দ করা হয় জুয়া খেলার নানা সরঞ্জামাদি। সেখানে পাওয়া যায় মদ, ইয়াবা, নগদ টাকা, জালটাকাসহ বহু কিছু। মতিঝিলের ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে অভিযান চালিয়ে প্রায় সোয়া দশ লাখ টাকা, জালটাকা, ক্যাসিনো চালানোর নানা আলামত। গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্লাবে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা ও জুয়া খেলা অবস্থায় ৪০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া বনানীর গোল্ডেন ঢাকা বাংলাদেশ ক্লাবে অভিযান চালায় র‌্যাব। চারটি অভিযানে ২০১ জন গ্রেফতার হয়। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ৩১ জনকে এক বছরের এবং বাকিদের ৬ মাস করে কারাদ- দেয় র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। চারটি ক্যাসিনো থেকে প্রায় ৩৮ লাখ টাকা উদ্ধার হয়। এছাড়া কষ্টি পাথরের মূর্তি, জালটাকা, জুয়া খেলার সরঞ্জাম, ইয়াবা, বিদেশী মদসহ নানা ধরনের মাদক জব্দ হয়। ইতোমধ্যেই পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, র‌্যাব মহাপরিচালক ড. বেনজীর আহমেদ ও ডিএমপি কমিশনার মোহাঃ শফিকুল ইসলাম জুয়া বন্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালানোর কড়া নির্দেশ দিয়েছেন। অভিযান অব্যাহত রাখার বিষয়েও সুষ্পষ্ট নির্দেশনা জারি করেছেন তারা। দেশ থেকে সব ধরনের জুয়ার আসর গুঁড়িয়ে দিতে পুলিশ ও র‌্যাবের সকল ইউনিটকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক ও র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মোঃ সারওয়ার-বিন-কাশেম জনকণ্ঠকে জানান, সারাদেশেই জুয়া বন্ধে সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত রাখার নির্দেশ এসেছে। যদিও এমন নির্দেশনার আগ থেকেই র‌্যাব সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করে আসছে। ঢাকায় থাকা জুয়ার আসর সম্পর্কে আরও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। দেশ থেকে জুয়ার আসর গুঁড়িয়ে দিতে র‌্যাব সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। গ্রেফতারকৃত যুবলীগ নেতাকে গুলশান থানায় হস্তান্তর ॥ অবৈধ জুয়া ও বড় বড় জুয়ার আসর হিসেবে পরিচিত ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে বুধবার গুলশানের নিজ বাড়ি থেকে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতারকৃত ঢাকা দক্ষিণ মহানগর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে বৃহস্পতিবার দুপুরে গুলশান থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে র‌্যাব। গ্রেফতারের সময় তার বাসা থেকে ৪শ’ পিস ইয়াবা ও প্রায় দশ লাখ টাকা এবং প্রায় ৬ লাখ টাকার ডলার পাওয়া যায়। তার কাছে তিনটি অস্ত্র পাওয়া যায়। যার মধ্যে একটি অবৈধ। অপর দুটি অস্ত্র বৈধ লাইসেন্সের শর্তভঙ্গ করে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম জানান, ক্যাসিনো ও মাদক ব্যবসা নিয়ে আটক খালেদের কাছ থেকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। কারা কিভাবে এসব জুয়ার আসর পরিচালনার সঙ্গে জড়িত তাদের নাম পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে গুলশান থানায় ও মাদক আইনে মতিঝিল থানায় পৃথক দুটি মামলা দায়ের হয়েছে। সূত্র বলছে, খালেদের ক্যাসিনো চালানোর বিষয়টি পুলিশ ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্য সংস্থাগুলো এবং রাজনীতিকভাবে প্রভাবশালীরা জানতেন। সবকিছু ম্যানেজ করেই ক্যাসিনো চালানো হতো বলে খালেদ স্বীকার করেছেন। গুলশান থানার ওসি এসএম কামরুজ্জামান জানান, দুটি মামলায় সাত দিন করে ১৪ দিনের রিমান্ড আবেদন করে খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে ঢাকার আদালতে পাঠানো হয়েছে। ডিএমপির প্রসিকিউশন বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার জসীম উদ্দিন জনকণ্ঠকে জানান, অস্ত্র মামলায় চার দিন আর মাদক মামলায় তিন দিন মোট সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদের বিরুদ্ধে চার মামলা ॥ খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে মোট চারটি মামলা দায়ের হয়েছে। যার মধ্যে র‌্যাব-৩ এর ওয়ারেন্ট অফিসার গোলাম মোস্তফা বাদী হয়ে গুলশান থানায় অস্ত্র, মাদক ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে তিনটি মামলা দায়ের করেন। আর মতিঝিলি থানায় মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি মামলা করেন র‌্যাবের ওয়ারেন্ট অফিসার চাইলা প্রু মার্মা। মামলার এজাহারে খালেদ মাহমুদের বাসা থেকে ১টি শটগান, দুটি পিস্তল, শটগানের ৫৭ রাউন্ড গুলি ও ৭.৬৫ এমএম-এর ৫৩ রাউন্ড গুলি জব্দ হয়েছে। এছাড়া ৫৮৫ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট ও ১০ লাখেরও বেশি নগদ টাকা এবং ৭ লাখের বেশি বিভিন্ন দেশের মুদ্রা জব্দ হয়। তিনটি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সের মেয়াদ ২০১৭ সালে শেষ হয়ে গেছে। অস্ত্র ও মাদক আইনে দায়ের করা দুটি মামলায় খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে সাত দিন করে ১৪ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। মানিলন্ডারিং আইনে করা মামলাটি শিডিউল অনুযায়ী পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তদন্ত করবে। সিআইডির কাছে ওই মামলার কাগজপত্র পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। খালেদের টর্চার সেলের সন্ধান ॥ বড় জুয়ার আসর ক্যাসিনো চালানোর দায়ে গ্রেফতারকৃত খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার একটি টর্চার সেলের সন্ধান পেয়েছে র‌্যাব। কমলাপুর রেল স্টেশনের উল্টো দিকে ইস্টার্ন কমলাপুর টাওয়ারের চতুর্থ তলায় ওই টর্চার সেলের সন্ধান পায় র‌্যাব-৩ এর একটি দল। র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শফিউল্লাহ সাংবাদিকদের জানান, খালেদের কাছে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে অনেক মানুষ তাদের কাছে অভিযোগ করেন। সেই অভিযোগের ভিত্তিতেই এবং তাদের দেয়া তথ্য মোতাবেক কমলাপুরের ওই টর্চার সেলটির সন্ধান পাওয়া যায়। সেখান থেকে বৈদ্যুতিক শক দেয়ার আধুনিক যন্ত্রপাতি, গায়ের চামড়া জ্বালা পোড়া করবে, এমন শক দেয়ার সরঞ্জাম, বিপুল লাঠিসোটা ও হকিস্টিক পাওয়া যায়। এসব দিয়েই কাউকে ধরে নেয়ার পর নির্যাতন করা হতো বলে নির্যাতিতদের দাবি। জুয়াসহ সব অবৈধ ব্যবসার বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ ॥ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, শুধু ক্যাসিনো নয়, সব অবৈধ ব্যবসার বিরুদ্ধে অভিযান চলবে। সরকারী অনুমোদন ছাড়া ক্যাসিনো চালানো যাবে না। সরকারের কাছ থেকে অনুমতি না নিয়েই ক্যাসিনো চালানোর কারণে অভিযান চালানো হয়েছে। ইতিপূর্বে কলাবাগান ও কাওরানবাজারের দুটি ক্লাবে অভিযান চালানো হয়েছে। অভিযানের পর ক্লাব দুটির অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। জুয়ার সঙ্গে প্রশাসনের কেউ জড়িত থাকলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। গ্রেফতারকৃত যুবলীগ নেতার টর্চার সেল থাকার বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। ডিএমপি কমিশনারের কড়া নির্দেশ জারি ॥ বৃহস্পতিবার নিজ কার্যালয়ে ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেন, রাজধানীতে অবৈধ জুয়ার আড্ডা ও ক্যাসিনো চলতে দেয়া হবে না। এসব জুয়ার বোর্ড, ক্যাসিনো পরিচালনার ক্ষেত্রে যত প্রভাবশালীই জড়িত থাকুক না কেন আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশ কঠোর হবে। পুলিশও অভিযান চালাবে। ঢাকার বিভিন্ন এলাকার জুয়ার বোর্ড ও ক্যাসিনোর তালিকা করা শুরু হয়েছে। আজ (বৃহস্পতিবার) থেকেই অভিযান শুরু হবে। অভিযানের আগে টার্গেটকৃত ক্যাসিনোগুলো থেকে মালামাল সরিয়ে নেয়া হচ্ছে কিনা, সে বিষয়ে গোয়েন্দারা নজর রাখছে। এদিকে মতিঝিল থানার পাশেই ইয়ংমেন্স ক্লাবের ক্যাসিনোতে অভিযানের পর থানা পুলিশের ভূমিকার বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে। কমিশনার আরও জানান, যারা জুয়া খেলতে আসে, তাদের অনেকেই মদ বা অন্যান্য মাদক সেবন করে। ক্যাসিনো বন্ধ করা হলে মাদকের আগ্রাসনও কমবে। এছাড়া ঢাকায় ডিজে পার্টিসহ নানা পার্টির আড়ালে মাদক সেবনের বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। ঢাকার ক্লাবপাড়া এখন ভুতুড়ে এলাকা ও নেপথ্য কারিগররা পলাতক ॥ বৃহস্পতিবার মতিঝিল ও গুলিস্তান ক্লাবপাড়া ঘুরে দেখা গেছে, ক্লাবগুলোতে তালা ঝুলছে। পাহারা দেয়ার মতো নিরাপত্তা প্রহরী পর্যন্ত নেই। কাউকে জিজ্ঞাসা করলেই তারা এসব বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেছেন। এমনকি ক্লাবগুলোর সামনে থাকা পান-সিগারেটের দোকানগুলো পর্যন্ত বন্ধ। তাদের হদিস নেই। গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, পান, বিড়ি ও সিগারেটের দোকানগুলোর মালিকরা ছিল ক্লাব কর্তৃপক্ষের সোর্স। তারা পান, বিড়ি ও সিগারেট বিক্রির আড়ালে বাইরে নজর রাখত। তাদের কাছে অনেক বড় জুয়াড়ির সম্পর্কে তথ্য আছে। তারা অনেককেই চেনেন। এজন্য তারা দোকান ফেলেই আত্মগোপন করেছেন। ক্যাসিনোতে কয়েনের দাম লাখ টাকা ॥ ক্যাসিনোগুলোতে সাধারণত নগদ টাকার সরাসরি ব্যবহার কম ছিল। আগে টাকা জমা দিয়ে তার বিপরীতে কয়েন সংগ্রহ করা হতো। এসব কয়েনের একেকটির দামের পার্থক্য ছিল। কোন কয়েনের দাম ছিল লাখ টাকা। আর কোনটির ৫০ হাজার, কোনটির ৪০ হাজার এভাবে হাজার টাকার কয়েন পর্যন্তও ছিল। জুয়াড়িদের সঙ্গ দিত নারীরা ॥ ভিআইপিদের খেলার জুয়ার বোর্ডগুলোর অধিকাংশই পরিচালনা করত নারীরা। এদের বিদেশ থেকে আনা হতো। এসব আকর্ষণীয় নারী জুয়ার বোর্ড চালাত। জুয়ার ফাঁকে ফাঁকে চলত মদ পান। তাদের সঙ্গে থাকত দেশী-বিদেশী নারীরা। নারীরা এসব জুয়াড়ির সঙ্গ দিত। মদ্যপ জুয়াড়িদের কাছ থেকে সর্বস্ব জুয়ার মাধ্যমে হাতিয়ে নিতেই এসব কৌশল অবলম্বন করা হতো। সবই ছিল ক্যাসিনো মালিকদের পূর্বপরিকল্পিত। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ঢাকায় ক্যাসিনো কালচার শুরু ॥ গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, যুগ যুগ ধরেই সারা পৃথিবীতে জুয়ার কালচার চলে আসছে। তবে তা ছিল একেবারেই ক্ষুদ্র পরিসরে। এক সময় এটি ছিল বাজি। এই বাজি ধরাই এক সময় আধুনিক জুয়ায় পরিণত হয়। ক্লাবপাড়াগুলোতে তাসের মাধ্যমে জুয়া জেতা বা হারের মাধ্যমে টাকা বা অন্য কোন জিনিস বাজি ধরা হতো। সর্বশেষ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে দেশে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা আধুনিক বড় জুয়ার আসর হিসেবে পরিচিত ক্যাসিনো কালচার শুরু হয়। দেশে ক্যাসিনো কালচার শুরু করেছিলেন ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা ও বিএনপি-জামায়াতের গৃহায়নমন্ত্রী মির্জা আব্বাস। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ব্রাদার্স ইউনিয়নে ক্যাসিনো কালচার শুরু হয়েছিল। ব্রাদার্স ইউনিয়নের এই জুয়ার আসরে বিএনপির অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিও যেতেন। ব্রাদার্স ইউনিয়নের ক্যাসিনোর মাধ্যমেই সাদেক হোসেন খোকার উত্থান। সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে পাল্লা দেয়ার জন্য সে সময় মির্জা আব্বাসও মতিঝিলের ক্লাবগুলো দখল করেন। তখন আরামবাগ ক্লাব ও ওয়ান্ডারার্স ক্লাবেও ক্যাসিনো শুরু করা হয় মির্জা আব্বাসের নেতৃত্বে। মির্জা আব্বাস আর সাদেক হোসেন খোকার পদাঙ্ক অনুসরণ করে মোসাদ্দেক আলী ফালু মোহামেডান ক্লাবে জুয়ার আড্ডা শুরু করেছিলেন। ’৯১-৯৬ সালে বিএনপির আমলে একমাত্র আবাহনী ছাড়া অন্য সব ক্লাবেই জুয়া-ক্যাসিনোর বাজার বসানো হয়েছিল। বিএনপি চলে যাওয়ার পর ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও এই ক্লাবগুলোর নিয়ন্ত্রণ ছিল বিএনপির হাতেই। তখনও পুলিশের নাকের ডগায় বসেই এই ক্যাসিনোগুলো চলেছে। মোহামেডান ছাড়াও মোসাদ্দেক আলী ফালু তখন রহমতগঞ্জ ক্লাবও দখল করে নিয়েছিলেন। সেখানেও শুরু হয় ক্যাসিনো ব্যবসা। ২০০৬ সালে বিএনপির পতনের পর এই ক্যাসিনোবাণিজ্য কিছুদিন বন্ধ ছিল। পরবর্তী সময় ধাপে ধাপে ক্যাসিনোগুলো আবার চালু করা হয়। ঢাকায় অনলাইন ক্যাসিনো কালচার ॥ সর্বশেষ ২০১৭ সালে দেশে অনলাইন ক্যাসিনো কালচার শুরু হয়। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন দেলু ও সরকারদলীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির হাত ধরে ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময় তার মালিকাধীন ঢাকার ৩৭/২ নম্বর পুরানা পল্টনের প্রীতম জামান টাওয়ারের ১৩ ও ১৪ তলায় প্রথম অনলাইন ক্যাসিনো চালু করা হয়। ক্যাসিনোটিতে সরাসরি বোর্ডে গিয়ে খেলার সব ধরনের উপকরণ ছিল। আবার সেখানে অনলাইনে জুয়া খেলারও ব্যবস্থা ছিল। নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা দেয়ার পর জুয়াড়ির মোবাইলে একটি এ্যাপস চালু করে দেয়া হতো। আর টাকার বিপরীতে জুয়াড়িদের নিজস্ব ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, এমনকি মোবাইলে সফটওয়্যারটি ডাউনলোড করে ইন্টারনেটে জুয়া খেলার সুযোগ করে দেয়া হতো। অনলাইনে জুয়া খেলে হেরে গেলে মোবাইলে থাকা টাকা কেটে নেয়া হতো। আবার লাভ হলে মোবাইলে টাকা আসত। পুরো প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণ করত ক্যাসিনো কর্তৃপক্ষ। প্রথম প্রথম জুয়াড়িকে লাভ দিয়ে লোভে ফেলা হতো। এরপর সুযোগ বুঝে কারসাজি করে সব টাকা কৌশলে হাতিয়ে নেয়া হতো। অনলাইনে জুয়া খেলে আদৌ কেউ জিততে পারেনি। কারণ পুরো সিস্টেমটি মনিটরিং করত ক্যাসিনো কর্তৃপক্ষ। চায়না বংশোদ্ভূত চার মালয়েশিয়ান নাগরিক ক্যাসিনোটি চালাত। অনলাইন জুয়ায় পথে বসেছে হাজার হাজার মানুষ। চক্রটি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে মালয়েশিয়ায় পাচার করেছে। মালয়েশিয়ার জুয়াড়ি সিন্ডিকেটের চার সদস্য ইয়ং উইং হং (পাসপোর্ট নম্বর এ-৪০৮৫৭৯৭৮), টং খা চিয়ান (এ-৩৩৩৯০৫৯৯), কক উইং পিং (পাসপোর্ট নম্বর এ-৩৫৮৫০৩০১) ও লাও ফুক চিং (পাসপোর্ট নম্বর এ-৪০৭৩৭৬৯৬)কে ২০১৭ সালের আগস্টে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলেন বিতর্কিত ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন দেলু। ঢাকার বিজয়নগর এলাকার একটি আবাসিক হোটেলে বৈঠকের মাধ্যমে জুয়ার আসর বসানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়। অবৈধভাবে টাকা পাচার মালয়েশিয়ায় এই ব্যবসায়ী সেকেন্ড হোম করেছেন। মালয়েশিয়ার ক্যাপং এলাকায় রয়েছে তার বাড়ি ও একাধিক গাড়ি। প্রায় প্রতি মাসেই তিনি মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও কম্বোডিয়ার ক্যাসিনোতে গিয়ে জুয়া খেলেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ফুলবাড়িয়া এলাকায় সিটি কর্পোরেশনের তিনটি মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অবৈধভাবে গড়ে তোলা দোকান বিক্রি ও ভাড়া দিয়ে হাতিয়ে নেন তিনি শত শত কোটি টাকা। অবৈধ টাকার বৈধতা দিতে ঠিকাদারি ও আমদানি রফতানি ব্যবসার কথা বলে থাকেন। ক্যাসিনোটিতে কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও ফিলিপিন্সের নামকরা ক্যাসিনোর সঙ্গে সার্ভার লিঙ্কের মাধ্যমে সরাসরি খেলা চালানো হয় বলে মিথ্যা প্রলোভন দেয়া হতো জুয়াড়িদের। প্রকৃতপক্ষে সফটওয়্যার কারসাজির মাধ্যমে মালয়েশিয়া থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো ক্যাসিনোটি। ব্যাংকার-প্লেয়ার, রোলেট, টাইগার ড্রাগন ও সিগবো নামের চারটি খেলা চালানোর জন্য ৪৯টি কম্পিউটার বসানো হয়েছিল ক্যাসিনোটিতে। জুয়াড়িরা ক্যাশ কাউন্টারে টাকা জমা দেয়ার পর তা সরবরাহ করা হতো নির্ধারিত কম্পিউটারে। এরপর চলতে থাকে খেলা। সফটওয়্যার কারসাজির মাধ্যমে বেশিরভাগ জুয়াড়ির কাছ থেকে চক্রটি টাকা হাতিয়ে নিলেও জুয়াড়িদের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জনে হাতে গোনা দু’চারজনকে বড় অঙ্কের টাকা জিতিয়ে দিত চক্রটি। জুয়াড়িদের ভিড় বাড়ায় ১৩ তলায় আরও ৩৬টি কম্পিউটার বসানো হয়েছিল। ১৩ তলায় কাঁচ ঘেরা ছোট ছোট আলাদা পাঁচটি কক্ষে চলত ভিআইপিদের জুয়া খেলা। বাকি কম্পিউটারগুলোতে সাধারণরা জুয়া খেলত।
×