ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ড্রেজিং বন্ধ থাকায় নাব্য সঙ্কটের পথে কর্ণফুলী

প্রকাশিত: ১০:১৭, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯

 ড্রেজিং বন্ধ থাকায় নাব্য সঙ্কটের পথে কর্ণফুলী

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ কর্ণফুলীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজ ভালই এগোচ্ছিল। কিন্তু নদীর তলদেশে জমে থাকা পলিথিন ও আবর্জনার পুরু স্তর ওই অগ্রগতি থামিয়ে দিয়েছে। তলদেশ পরিণত হয়েছে পলিথিনের ভাগাড়ে। চীন থেকে অধিক ক্ষমতার বড় ড্রেজার এনেও খনন কাজ এগিয়ে নেয়া যাচ্ছে না। কার্যত থমকে আছে ২৪২ কোটি টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ। এদিকে, কর্ণফুলীর ড্রেজিং দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে যাওয়ায় অতি গুরুত্বপূর্ণ এ নদীর নাব্য রক্ষায় বেগ পেতে হচ্ছে। অবশ্য জাহাজ চলাচল স্বাভাবিক রাখতে নিয়মিত ড্রেজিং অব্যাহত রেখেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম বন্দরের হাইড্রোগ্রাফি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, প্রচলিত যন্ত্রপাতি দিয়ে কর্ণফুলী ড্রেজিং কঠিন হয়ে পড়ায় চীন থেকে আনা হয় ৩১ ইঞ্চি ব্যাসের সাকশন ড্রেজার। এগুলো নদী খননের জন্য উচ্চক্ষমতার যন্ত্রপাতি। কিন্তু এই ড্রেজার দিয়েও কর্ণফুলীর পলি তোলা দুরূহ হয়ে পড়েছে। কারণ, নগরীর খালগুলো হয়ে ভেসে আসা পলিথিন এবং অপচনশীল বর্জ্যগুলো ডুবে গিয়ে কর্ণফুলীর তলদেশে পুরু আস্তরের সৃষ্টি করেছে। ওই আস্তর এতটাই ভয়াবহ যে, ড্রেজার দিয়ে টেনে আনতেই উঠে আসে পলিথিন। কিছুক্ষণ কাজ করার পর ওই পলিথিন ও আবর্জনা পরিষ্কার করাটাও আরেকটি জটিল কাজ হয়ে পড়েছে। ড্রেজিংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রায় একমাস ধরে নদীতে অলস ভাসছে চীন থেকে আনা বড় আকারের ড্রেজার। যে প্রত্যাশায় এ ড্রেজার আনা হয়েছিল তা পূরণ হচ্ছে না। এখন বিকল্প পন্থা খুঁজতে হচ্ছে। বিকল্প হিসেবে গ্র্যাব শিপ ব্যবহার এবং আরও বেশি পরিমাণ বালি তোলার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে এভাবে করতে গেলে ব্যয় আরও বাড়বে, যা দ্বিগুণও হয়ে যেতে পারে। আইনী জটিলতা কাটিয়ে ওঠার পর চট্টগ্রাম বন্দরের প্রাণ কর্ণফুলীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং কার্যক্রম শুরুতে দ্রুততার সঙ্গেই। গত ফেব্রুয়ারির মধ্যেই শেষ হয় প্রকল্পের ২২ শতাংশ কাজ। পলিথিনের স্তর থাকায় সাধারণ ড্রেজার দিয়ে কাজের গতি যাওয়ায় থাকায় চীন থেকে আনা হয় অত্যাধুনিক ড্রেজার। জুন নাগাদ ড্রেজিং কাজ শেষ হওয়ার আশাবাদ ছিল বন্দর কর্তৃপক্ষের। প্রকল্প অনুযায়ী সদরঘাট থেকে বাকলিয়ার চর পর্যন্ত এই ক্যাপিটাল ড্রেজিং চলছে। তোলা হবে ৪২ লাখ ঘনফুট মাটি। প্রকল্পের আওতায় নদী খননের পাশাপাশি রয়েছে তীর সংরক্ষণ ও নতুন জেটি নির্মাণ। গত অক্টোবর থেকে বাংলাদেশ নৌবাহিনী কর্ণফুলীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং শুরু করে। দেশের অর্থনীতিতে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর গুরুত্ব সর্বাধিক। কেননা এই নদীতেই রয়েছে দেশের প্রধান বন্দর, যার মধ্যে দিয়ে মোট আমদানি-রফতানির বাণিজ্যের অন্তত ৯০ শতাংশ পরিচালিত হয়ে থাকে। দেশের আমদানি-রফতানি বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বন্দরের সাফল্য বাড়াতে নতুন নতুন টার্মিনাল নির্মাণের মাধ্যমে এর সম্প্রসারণের পাশাপাশি বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা উন্নয়নে জোর দিয়েছে সরকার। কেননা দেশের শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ও নতুন শিল্পায়নের বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে। আশির দশকে কর্ণফুলী নদীতে সর্বপ্রথম ক্যাপিটাল ড্রেজিং হয়। নেদারল্যান্ডসের একটি কোম্পানি ওই কাজ করে। এর প্রায় ১০ বছর পর ’৯০ সালে দ্বিতীয়বার ড্রেজিং হয়। এ প্রকল্পের কাজ করে চায়না হারবাল কোম্পানি। তারপর দীর্ঘ সময় কর্ণফুলীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং হয়নি। পাহাড় থেকে আসা পলিতে সদরঘাট থেকে বাকলিয়া পর্যন্ত ছোট ছোট চরের মতো সৃষ্টি হয়েছে। জাহাজ চলাচলে প্রয়োজনীয় নাব্য রক্ষায় বন্দর কর্তৃপক্ষ কয়েক দফায় ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের উদ্যোগ নিলেও তা থমকে যায় নানা সমস্যায়। কর্ণফুলীর নাব্য রক্ষা ও নেভিগেশন নিশ্চিত করতে ’১২ সালের জুলাইতে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের একটি প্রস্তাব পেশ করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। ওই প্রস্তাব ফাইলেই থেকে যায় অনেক বছর। ২০০৮ সালে ড্রেজিংয়ের জন্য ঠিকাদার নিয়োগের দরপত্র আহ্বান করা হয়। প্রকল্পের নাম হয় ‘ক্যাপিটাল ড্রেজিং এ্যান্ড ব্যাংক প্রোটেকশন’। সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে ২২৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকায় ড্রেজিংয়ের কাজ পায় ‘মালয়েশিয়া মেরিটাইম এ্যান্ড ড্রেজিং কর্পোরেশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি এই কাজ সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়। এই প্রকল্পে ড্রেজিং ছাড়াও ২ হাজার ৬১৫ মিটার দৈর্ঘ্যরে তীর নির্মাণ, সদরঘাট এলাকায় ৪শ’ মিটার লাইটারেজ জেটি নির্মাণ ও মেরিন ড্রাইভ তৈরির কথা ছিল। বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ৬শ’ দিনের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু মালয়েশীয় প্রতিষ্ঠানটি নিজে কাজ না করে ‘প্যাসিফিক মেরিন সার্ভিসেস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে স্থানীয় এজেন্ট নিয়োগ করে। কাজ শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আসতে থাকে গুরুতর বেশ কিছু অভিযোগ। অভিযোগগুলোর মধ্যে উত্তোলিত মাটি বিক্রি, সিরামিক ইট নির্মাণ, শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধ না করা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ এই প্রতিষ্ঠান ’১৩ সালের আগস্টে যন্ত্রপাতিসহ অনেক সরঞ্জাম ফেলে রেখে সটকে পড়ে। দফায় দফায় চিঠি দিয়েও ওই প্রতিষ্ঠানের কোন সাড়া না পেয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই চুক্তি বাতিল করতে বাধ্য হয়। এরপর প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানটি আদালতে গেলে পুরো ক্যাপিটাল ড্রেজিং কাজই আইনী জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতার আবর্তে পড়ে। কিন্তু বন্দরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এই কাজটি যে কোনভাবে শেষ করার গুরুত্ব অনুভব করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। নানা জটিলতায় দফায় দফায় থেমে যাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ অবশেষে শুরু করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রকল্প বাস্তবায়নে এবার দায়িত্ব পায় বাংলাদেশ নৌবাহিনী। অবশ্য আদালতে মামলা থাকায় প্রকল্পটির নাম পরিবর্তন করতে হয়। ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের পরিবর্তে প্রকল্পটি ‘সদরঘাট টু বাকলিয়া চর ড্রেজিং’ হিসেবে নামকরণ হয়।
×