ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চ্যালেঞ্জ এবং মানুষের প্রত্যাশা ॥ অভিমত

প্রকাশিত: ০৮:৪২, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯

 চ্যালেঞ্জ এবং মানুষের প্রত্যাশা ॥ অভিমত

কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছোট ছোট স্ট্যাটাসে শুধু ক্যাসিনো আর ক্যাসিনোতে সয়লাব। বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের সঙ্গে সংবিধানের অঘোষিত রাষ্ট্রের চতুর্থস্তম্ভ গণমাধ্যমের কর্মীদের ফেসবুকেও এই ক্যাসিনো নিয়ে নানা ধরনের মত প্রকাশ হয়েছে। বাংলাদেশে ক্যাসিনোর মতো খেলা আছে- এটি অধিকাংশ গণমাধ্যমের কর্মীরা রীতিমতো ব্যঙ্গ করেই তাঁদের অজানার কথাটি অকপটে স্বীকার করেছে। তাও আবার রাজধানী ঢাকার শহরের প্রাণকেন্দ্র মতিঝিল এলাকার ফকিরেরপুলে বড়লোকের আড্ডাখানায় বা বিভিন্ন ক্লাবগুলো দীর্ঘদিন ধরে এই ক্যাসিনো চলে আসছে- এটিও অনেককে অবাক করে দিয়েছে- এই কথাটি তাঁদের গণমাধ্যমে প্রকাশিত না হলেও ফেসবুকে কিন্তু ঠিকই ভাইরাল হয়েছে। কারণ, সম্প্রতি দলীয় এক সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের চেয়েও যুবলীগ কতিপয় নেতাদের ‘অপকর্ম’ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশের পর বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) ঢাকার চারটি ক্লাবে অভিযান চালিয়ে জুয়ার সরঞ্জাম, প্রায় ৫০ লাখ টাকা এবং ১৮২ জনকে গ্রেফতার করে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। আর এই অভিযান নিয়ে ব্যক্তি শেখ হাসিনার শত্রু মহলও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করেছেন। আর এই অভিযানের মাধ্যমে রাজনীতিবিদ থেকে রাষ্ট্রের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা দুর্বৃত্তদের চিহ্নিত করে যত দ্রুত সম্ভব আইনের আওতায় আনারও পরামর্শ দিয়েছে, সাধুবাদ জানিয়েছে। ১৮৬৭ সালের ‘জুয়া আইনে’ জুয়া যেমন নিষিদ্ধ, তেমনিভাবে বাংলাদেশের সংবিধানেও জুয়া বন্ধের কথা বলা হয়েছে। তাহলে এতদিন ধরে ক্যাসিনোগুলো চলছিল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কি জানত না- এ প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) বিকেলে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপনারা সাংবাদিক, আপনারা সবই জানেন- এর আগে কলাবাগান ক্লাব ও কারওয়ান বাজার হয়েছিল, তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যখন যেটার খবর আসছে, তখন আমরা বন্ধ করে দিচ্ছি, সিলগালা করছি। আমরা শুনছিলাম অনেকদিন ধরে ঢাকাতে কতগুলো অবৈধ ক্যাসিনো আছে। আমরা বিভিন্ন ক্লাব ও হোটেলগুলোতে বারের অনুমতি দিয়েছি, কিন্তু ক্যাসিনোর অনুমতি দিইনি। আর গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে নিশ্চিত হয়েই অপারেশন হয়েছে।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমি সব সময় বলে থাকি। এখানে যদি প্রশাসনের কোন লোক জড়িত থাকেন কিংবা তারা এগুলোতে সহযোগিতা করেছেন কিংবা তাদের নিয়ন্ত্রণে এগুলো হয়েছে (বলে প্রমাণ মেলে), অবশ্যই তিনি আইন অনুযায়ী বিচারের মুখোমুখি হবেন।’ আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায় আশাবাদী। কারণ, গত ২৮ আগস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানতে পারি, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম। সর্বশেষ তিনি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধানের দায়িত্ব পালন করে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার স্থলাভিষিক্ত হলেন ১৪ সেপ্টেম্বর। এই লেখায় সদ্য দায়িত্ব গ্রহণ করা ডিএমপি কমিশনারের কথাটি উল্লেখ করেছি এই কারণে, বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা দেশের জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের প্রশাসনযন্ত্রের পুলিশ বাহিনীকে যেভাবে প্রত্যাশা করেন, দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের উপর অর্পিত দায়িত্বের প্রতি যতটুকু দায়িত্ববান আশা করেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে মোহাম্মদ শফিকুল ইসলামকে নিয়ে আশাবাদী। আমি যখন কুমিল্লা জেলা কবির-মিঠু ছাত্রলীগের একজন ক্ষুদ্র কর্মী তখন আমার এক সহকর্মীর মোটরসাইকেলের একটা বিষয় নিয়ে মোহাম্মদ শফিকুল ইসলামের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। যতটুকু মনে পড়ে, তখন কুমিল্লার পুলিশ সুপার হিসেবে তিনি সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। আইন-কানুন, রাজনীতি নিয়ে এক চমৎকার কথামালার মেলবন্ধনে আবদ্ধ করে তখন শুধু আমাকেই নয়, আমার সহকর্মীকেও মুগ্ধ করেছেন তিনি। তাঁর ভালবাসা আর ব্যক্তিত্বের কাছে অপরাধীও অনুতপ্ত হতে দেখেছি। আমার সহকর্মী বাড়িতে আসার সময়ই তার হেলমেট ক্রয় করা থেকে শুরু করে বাইকের অন্যান্য ছোটখাটো ঝামেলাগুলো ঠিক করার জন্য রীতিমতো প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে পড়ে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ডিএমপির বর্তমান কমিশনারকে নিয়ে আশাবাদী। তবে, চ্যালেঞ্জটা অনেক কঠিন! কারণ, জিয়া-মোশতাকের ষড়যন্ত্রে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে রাষ্ট্রের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে ষড়যন্ত্র ঢুকিয়ে নিজেদের পছন্দমতো ব্যক্তিদের বসিয়ে পাকিস্তানী ভাবধারায় রাষ্ট্রপরিচালনা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। রাষ্ট্রযন্ত্রগুলোকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দিয়েছিল। প্রশাসনযন্ত্রের চেইন অব কমান্ড নষ্ট করে দিয়েছিল। এক সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান থেকে আরেক শাসক জেনারেল এরশাদ ইতিহাস বিকৃতি করে, সংবিধানকে ক্ষত-বিক্ষত করে শুধু কয়েকটি জেনারেশনকেই বিভ্রান্ত করে গড়ে তুলেনি, সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ভেতর থেকে ঘুণে খাওয়া নড়বড়ে করে গঠন করেছে। অন্যদিকে তথাকথিত রাজনৈতিক দল বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া সামরিক শাসক ও স্বৈরশাসকের চেয়েও কম কিছু করেনি। বরং অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলকারী মেজর জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদের চেয়ে একটু আগবাড়িয়ে তার ছেলেকে দিয়ে হাওয়া ভবন বানিয়ে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক রাষ্ট্রযন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার হতে বাধ্য করেছিল যার ন্যক্কারজনক নিকৃষ্ট ঘৃণিত কালো দিন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা। শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ওই গ্রেনেড হামলার বর্বরতায় আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতাকর্মীর মৃতদেহের রক্তস্রোতের লাল-রঙিন রাজপথে কতিপয় দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসনযন্ত্রের কর্মকর্তাদের সেই নোংরা থাবা; মনে হলে আজও আতকে ওঠে জাতি! খালেদা-তারেক জিয়ার ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহৃত না হলে প্রশাসনযন্ত্রের কর্তা ব্যক্তিদের চাকরিচ্যুত করার ভয় দেখানোসহ শারীরিকভাবেও নির্যাতনের কথা তখনকার অনেক কর্মকর্তা আজও ভুলে যায়নি। ’৭৫ পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানী ভাবধারায় ২৬ বছরের রাষ্ট্রপরিচালনায় প্রশাসনযন্ত্রের এক ধরনের ‘চেইন অব ক্রিমিনাল’ তৈরি হয়েছে, হয়ে আছে। আর সেইসঙ্গে আছে কতিপয় রাজনৈতিক নেতাদের গ্রুপ ভারি করার ষড়যন্ত্র, তদবির-লবিং, দেনদরবার আর সুপারিশ। তাই রাষ্ট্রের প্রশাসনযন্ত্রের অনেক কর্মকর্তা অনেক সময় নিখুঁতভাবে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে বাধার সম্মুখীন হয়। আর এই জায়গায় আন্তরিকতার সঙ্গে কঠোর হতে হবে। প্রয়োজনের সরকার প্রধানকে অবহিত করতে হবে। কারণ, সম্প্রতি কতিপয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও পুলিশ কর্মকর্তার জন্য সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা যেমন সমালোচিত হচ্ছে, তেমনিভাবে পুলিশ বাহিনীও তাদের ইমেজ সঙ্কটে পড়েছে। অথচ, এই পুলিশ বাহিনীর ওইসব কর্মকর্তা বেমালুম ভুলে যায়, মহান মুক্তিযুদ্ধে রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রথম প্রতিরোধ বুলেট নিক্ষেপ করে এই ‘পুলিশ’। কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তার কারণে আজ পুরো পুলিশ বাহিনী প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে না। তবে আশার কথা হচ্ছে, ইতোমধ্যেই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম দায়িত্ব পাওয়ার পর (১৫ সেপ্টেম্বর) প্রথম সংবাদ সম্মেলনে থানায় সেবার মান উন্নয়নে প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন, ‘ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অধীনে কোন থানায় যদি জনগণ কাক্সিক্ষত সেবা ও ভাল আচরণ না পান, তবে সিনিয়র অফিসারদের থানায় বসাব, প্রয়োজনে আমি নিজে থানায় বসে ওসিগিরি করব। এলাকার লোকদের সঙ্গে কথা বলব।’ ঢাকা মানে রাজধানী। আর রাজধানী মানেই দেশের দৃশ্যপট-এটা ছোটকাল থেকেই শুনে আসছি। আর এই রাজধানীর বিশাল জনসংখ্যার জানমালের নিরাপত্তার নিশ্চিত করতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অধীনে মোট ৫০টি থানায় দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের শৃঙ্খলার মান-উন্নোয়ন ও সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে আন্তরিক মনোবৃত্তি সৃষ্টি করতে সদ্য দায়িত্ব গ্রহণ করা ডিএমপি কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম তাঁর মেধা-অভিজ্ঞতা দিয়ে সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, মাদকসহ সকল প্রকার অপরাধ দমনের কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে মানুষের আস্থার জায়টি নিশ্চিত করবে বলে রাজধানীবাসীর প্রত্যাশা। লেখক : সভাপতি, বোয়াফ [email protected]
×