ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক (ডাঃ) কামরুল হাসান খান

বাঙালীর মুক্তির ইতিহাস বঙ্গবন্ধু থেকে বঙ্গবন্ধুকন্যা-

প্রকাশিত: ০৮:৪৬, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯

বাঙালীর মুক্তির ইতিহাস বঙ্গবন্ধু থেকে বঙ্গবন্ধুকন্যা-

১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলার ব্রিটিশদের কাছে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলার সূর্য অস্তমিত হয়। তারপর থেকে ভারতবর্ষে বিভিন্ন সময়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন হয়েছে। এতে সবসময়েই বাংলার মানুষের ভূমিকা এবং আত্মত্যাগ উল্লেখযোগ্য ছিল। বাংলাকে ক্ষতবিক্ষত করার নানা পদক্ষেপ ছিল। ১৯০৫ সালে ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জনের আদেশে প্রথম বঙ্গভঙ্গ সম্পন্ন হয়। কিন্তু ১৯১১ সালে প্রচন্ড গণআন্দোলনের ফলে বঙ্গভঙ্গ রহিত হয়। ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের উদ্যোগে বাঙালী হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি রক্ষার্থে বেঙ্গল প্যাক্ট গৃহীত হয়। কিন্তু ১৯২৬ সালেই কংগ্রেসে তা বাতিল হয়। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সাধারণ অধিবেশনে ভারতীয় উপমহাদেশে বসবাসকারী মুসলিমদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের দাবি উত্থাপিত হয় এবং অনুমোদিত হয়, যা ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব হিসেবে পরিচিত। ১৯৪৭ সালের ২৩ মে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর অগ্রজ শরৎ চন্দ্র বসু বাংলা, বাংলাভাষী বিহার, ওড়িশ সমম্বয়ে গ্রেটার বেঙ্গলের প্রস্তাব করেন। গান্ধীজী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিমসহ অনেকেই এ প্রস্তাব সমর্থন করেন। কিন্তু কংগ্রেসের উচ্চপর্যায়ের কিছু নেতার জন্য তা ভেস্তে যায়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির মধ্য দিয়ে সত্যিকার বঙ্গভঙ্গ হয়- ধর্মভিত্তিক ভারত এবং পাকিস্তান দুটো আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এভাবে বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য আলাদা ভূ-অঞ্চল এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে; কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা ভেস্তে গেছে। এমনই এক পরিস্থিতিতে তৎকালীন ফরিদপুর জেলাধীন গোপালগঞ্জ মহকুমার মধুমতি নদী তীরবর্তী নিভৃত পল্লীর ছায়া ঢাকা টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ মঙ্গলবার রাত ৮টায় জনক- জননীর ঘর আলো করে জম্মগ্রহণ করেন সকলের প্রিয় ‘খোকা’। কেউ কি তখন ভেবেছিল এই খোকাই একদিন একটি দেশের জাতির পিতা হবে, বাঙালী জাতির স্বাধীনতা দেবে, অধিকার দেবে? শেখ মুজিবুর রহমানের যখন জন্ম তখন পরাধীন ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন- শোষণের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা- আন্দোলন বেশ দানা বেঁধে উঠেছে। সমগ্র ব্রিটিশশাসিত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালীর ছিল অগ্রণী ভূমিকা। প্রসঙ্গত ভারতীয় উপমহাদেশে বাঙালী জাতির বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে গোখলের বিখ্যাত উক্তি What Bengal thinks today, India thinks tomorrow স্মরণ করা যেতে পারে। বাংলার এই সংক্ষুব্ধ রাজনৈতিক পরিবেশেই জন্মগ্রহণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিবের স্বকীয় নেতৃত্বের আভাস তার কিশোর বয়সের কয়েকটি ঘটনা থেকে আঁচ করা যায়। তিনি কিশোর বয়সে খ্যাতিমান রাজনৈতিক নেতা শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছে গোপালগঞ্জে নির্ভীক কণ্ঠে তাঁদের গ্রামের স্কুলের দাবি তুলে ধরেছিলেন। স্কুলে পড়ার সময় এক ঘটনায় প্রতিবাদী ভূমিকা গ্রহণের জন্য বালক শেখ মুজিব গ্রেফতার হন এবং সাতদিন হাজতবাস করেন। বিদ্রোহী এই বালক যে একদিন স্বদেশের মুখ উজ্জ্বল করবেন এমন সম্ভাবনা অনুধাবন করা গিয়েছিল সেদিন। দেশের মানুষের আর্থিক দুরবস্থা ও সামাজিক বৈষম্য সম্পর্কে শেখ মুজিব বালক বয়স থেকেই সচেতন ছিলেন এবং তাঁর বিভিন্ন কর্মকান্ডে তা প্রকাশও পেয়েছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তান শাসক শ্রেণীর বৈষম্য নীতি, শোষণ ও অগণতান্ত্রিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামের কথাই বারবার ঘুরে-ফিরে আসে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য। তখন থেকেই তিনি দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, বাঙালী জীবনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতেন। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালীর জন্য ভেবেছেন; কোন শ্রেণী, সংগঠন, পেশা বা কোন গোষ্ঠীর কথা আলাদা করে ভাবেননি। কিন্তু এসব সামাজিক-আর্থিক অবস্থানের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সমস্যাগুলোকে তাঁর কর্মে ও ভাবনায় তিনি স্থান দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বাংলাদেশের ঐশ্বর্য, সম্পদ, বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিকদের কথা উল্লেখ করে প্রায়ই বলতেন, ‘এ বাংলায় কি-না আছে! বাংলা কবির দেশ, কবিতার দেশ, বাংলা বিপ্লবীর দেশ, বিপ্লবের দেশ, বাংলা ভাবুকের দেশ ভাবনার দেশ, বাংলা শিল্পীর দেশ, শিল্পের দেশ, বাংলা সোনার দেশ, রুপার দেশ, বাংলা ঐতিহ্যের দেশ, ইতিহাসের দেশ। বঙ্গবন্ধুর ভাবনাজুড়ে ছিল হাজার বছরের বাংলাদেশ। তাঁর সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখার ইতিকথা কেবল পাকিস্তান আমলে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের যুগের নয়, তারও আগের। শেখ মুজিব সর্বভারতীয় অপেক্ষা বাংলার রাজনীতি, বাংলার জন্য বেশি ভাবতেন, বাংলার দুঃখী মানুষের কথা তাঁর রাজনৈতিক কর্মে ও ভাবনায় কৈশোর থেকেই স্থান করে নিয়েছিল। তাই শেখ মুজিবের জীবন ও কর্ম তথা রাজনৈতিক ইতিহাসকে বাংলাদেশের মর্মকথার নৈর্ব্যক্তিক ইতিহাস, বাংলাদেশের বহির্জগতের রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতির ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে চিত্রিত করা যাবে না। একটি সমাজ, জনজীবন বা জাতির ভাবধারাতে সঠিক স্থান নির্দেশই শুধু ইতিহাসের বিষয়বস্তু নয়, তার বিচার-বিশ্লেষণ ইতিহাসের অন্তর্গত। তাই বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের ইতিহাস সর্বতোভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। বঙ্গবন্ধু ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্য ধারার উত্তর-সাধক বলা যেতে পারে। সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাঁর দৃষ্টান্ত তিনি নিজেই। আশৈশব সংগ্রামী ভূমিকায় বাংলার স্বার্থের প্রশ্নে তিনি কখনও কোথাও কোন আপোস করেননি অথবা কোন চাপের মুখে নতি স্বীকার করেননি। এ কারণেই তাঁকে বারবার কারাবন্দী হতে হয়েছিল। বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পরিচালিত অভূতপূর্ব অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি ও ব্যাপকতা ভারতে গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে কোন দিক দিয়েই তুলনীয় নয়। স্থান ও কালের ব্যবধান ছাড়াও শেখ মুজিবের অসহযোগ আন্দোলন একটি সমান্তরাল বেসামরিক সরকার পরিচালনার এক অনন্যা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল- যা মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের ব্যপ্তি ও প্রভাব থেকে প্রকৃতিগতভাবেই আলাদা। বাংলাদেশের মানুষ, সংগঠন, রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবের ডাকে ঐক্যবদ্ধভাবে সাড়া দিয়েছে ও অংশগ্রহণ করেছে। একদিকে সামরিক বাহিনী শত শত লোককে গুলি করে হতাহত করেছে, অপরদিকে বাংলাদেশের মৃত্যুঞ্জয় জনতা বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে শান্তিপূর্ণভাবে অসম সাহসে গুলির মুখে বুক পেতে দিয়ে আন্দোলন করেছে- কার্ফু ভেঙ্গেছে জনগণ, তাদের কানে বেজেছিল বঙ্গবন্ধুর অমোঘ নির্দেশ- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই অসহযোগ আন্দোলনকে সঙ্গতভাবেই বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায় হিসেবে অভিহিত করা যায়। তিন সপ্তাহব্যাপী একটি সমান্তরাল সরকার পরিচালনা করে বঙ্গবন্ধু তাঁর নেতৃত্ব ও সাহসের এমন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, যার উদাহরণ ইতিহাসে নেই। তারপরই শুরু হয়েছিল সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতাযুদ্ধ- বাংলাদেশের অবিসংবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামে ও দিক নিদের্শনায়। অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধু একজন প্রকৃত জাতীয়তাবাদী নেতায় রূপান্তরিত হন। বঙ্গবন্ধুর জীবন এবং তার অব্যবহিত পূর্বে উপমহাদেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বিশেষভাবে মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু এবং তাঁর রাজনৈতিক জীবনের পথপ্রদর্শক, সহযোদ্ধা, জাতীয় নেতাদের প্রভাব বঙ্গবন্ধুর জীবনে ছিল। শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীসহ বহু নেতা ও কর্মীর মধ্য থেকে দেশ ও জনগণের প্রতি গভীর ভালবাসা, নিষ্ঠা, লক্ষ্যের প্রতি অবিচল ও একাগ্রতা, সর্বোচ্চ ত্যাগ ও সাহসের কারণে শেখ মুজিবুর রহমানের অভ্যূদয় ঘটে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন সম্পর্কে গবেষকগণ অনেক সময় বিস্ময়বোধ করেন- যিনি তাঁর রাজনীতি শুরু করেছেন তরুণ বয়সে মুসলিম লীগের সংস্পর্শে, তিনি কিভাবে সামন্তবাদী সমাজের চিন্তা- ভাবনা ও ভাবাদর্শ থেকে বেরিয়ে এলেন। একজন মানুষ হিসেবে শেখ মুজিবের মহত্ত্ব এখানে যে, বাঙালী জাতির মুক্তির জন্য তিনি নিরন্তর লড়াই করেছেন। তিনি চেয়েছেন এই দেশের মানুষ যেন খেয়ে পরে সুখে-শান্তিতে বাঁচতে পারে, আত্মমর্যাদা নিয়ে বিশে^র দরবারে নিজেদের ন্যায্য স্থান পেতে পারে। আর এ জন্য বঙ্গবন্ধু তাঁর সমগ্র জীবন, চিন্তা-ভাবনা ও শ্রম উৎসর্গ করেছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একজন আদর্শবাদী ও নীতিবান মানুষ হিসেবে এদেশের সাধারণ মানুষের একান্ত কাছাকাছি ছিলেন। ২৪ বছরের নিরসল সাধনায় সাফল্য অর্জন সত্ত্বেও তিনি অহংকারী ও উদ্ধত ছিলেন না। বিলাসিতা ও স্বেচ্ছাচারকে তিনি ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে কখনো প্রশ্রয় দেননি। বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী হওয়ার পরও তাঁর ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাসাটি একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই আড়ম্বরহীন, বাহুল্যবর্জিত, সাধারণ ছিল। পৃথিবীর কোন দেশের রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন এতটা সাধারণ, জাঁকজমকহীন এমন কল্পনা করা যায় না। সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের অংশীদার হিসেবে তিনি অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন। তাঁর স্ত্রীও তাঁরই আদর্শের অনুসারী ছিলেন। বলা যেতে পারে তাঁর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা একজন আদর্শ গৃহিণী হলেও প্রখর রাজনৈতিক চেতনা সম্পন্ন মহিলা ছিলেন। কোনরূপ দাম্ভিকতা, আড়ম্বরপ্রিয়তা ও অহংকারকে মুজিব-দম্পতি প্রশ্রয় দেননি। বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই নির্দ্বিধায় বলা সম্ভব হয়েছে সমগ্র দেশবাসীকে, এদেশের প্রতিটি বাঙালীকে, প্রতিটি মানুষকে- ‘আমি তোমাদেরই লোক’। বিশ্বকবির এ ঐকান্তিক ইচ্ছার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন দেখতে পাই বাঙালী জাতীয়তাবাদের জনক, বাংলাদেশের রূপকার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনে। দেশবাসীর ওপর তাঁর প্রভাব ছিল অতুলনীয়। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ একদিন তাঁর কথায় অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে, প্রাণ দিয়েছে। কারণ তারা জানত এই মানুষটি দেশের মানুষের ভালবাসা ছাড়া আর কিছুই চান না। না পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্ব, না প্রভুত্বের গৌরব, না ধনৈশ্বর্যের মূঢ়তার সাহচর্য। বাঙালীকে বিশে^র দরবারে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়ার গৌরব ব্যতীত তাঁর আর কোন স্বপ্ন ছিল না। বাঙালীর হৃদয়ে অকৃত্রিম বন্ধুত্ব- ভালবাসা মুজিব নেতৃত্বের দূর্জয় দুর্গ, যার ভিত্তি বঙ্গবন্ধুর আজীবন নিঃস্বার্থ ত্যাগের ওপর রচিত। বাংলা ও বাঙালীর মুক্তির জন্য তিনি সুদীর্ঘ এক যুগ কাটিয়েছেন কারাগারের অন্ধকার কক্ষে। মানুষের মুক্তির ইতিহাসে এমন ত্যাগের দৃষ্টান্ত বিরল। বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম দৈনিক ‘নবযুগ‘ পত্রিকায় ১৩৪৯ সালের ৩ বৈশাখ প্রকাশিত বাঙালীর ‘বাংলা‘ প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘বাংলা বাঙালীর হোক। বাংলার জয় হোক। বাঙালীর জয় হোক। বঙ্গবন্ধু এই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে বিদ্রোহী কবির স্বপ্ন সফল করেছিলেন, বাংলাকে বাঙালীর করেছিলেন। বাংলাদেশকে স্বাধীন করাই বঙ্গবন্ধুর একমাত্র কৃতিত্ব নয়। সাম্প্রদায়িকতার অন্ধ প্রকোষ্ঠ থেকে, শতাব্দী-লালিত মূঢ়তা থেকে গণতন্ত্রের মুক্তির মন্ত্র শোনা গিয়েছিল তাঁর কণ্ঠে এবং তা বাস্তবায়ন করেছেন। বঙ্গবন্ধু মৃত্যুঞ্জয় হয়ে আছেন বাংলাদেশের মানুষের ভালবাসায়। কোন কূটকৌশল বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে পারবে না, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অবদান চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। বঙ্গবন্ধুই বিশে^র একমাত্র নেতা যিনি একটি জাতিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছেন এবং স্বপ্নের বাস্তবায়ন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও রাজনীতি বিশ্লেষণ করলে তাঁর যে অন্যতম বৈশিষ্ট্যগুলো প্রাধান্য পায় তা হলো- সর্বোচ্চ ত্যাগ, প্রশ্নাতীত সততা, দেশ ও জনগণের প্রতি গভীর ভালবাসা, সাহস, মানবতাবাদী এবং লক্ষ্যে অবিচল। বঙ্গবন্ধু বারবার বলেছেন সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই। আমরা অহরহ বলি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক। বঙ্গবন্ধুর কথা শুধু মুখে মুখে বললে হবে না তাঁর যে সোনালী আদর্শগুলো রয়েছে তা অনুসরণ করতে হবে তাহলেই সোনার মানুষ হওয়া যাবে এবং কেবল তখনই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। আমরা যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী দাবি করি- এখন একটু মিলিয়ে দেখা দরকার এই মহান নেতার আদর্শের কতটা কাছে বা কতটা দূরে আছি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক দাবি করলে তাঁর ত্যাগ, সততা আর দেশপ্রেমের মহান আদর্শগুলো অনুসরণ করার চ্যালেঞ্জ তো আমাদের নিতেই হবে। প্রায় দু’শ’ বছর ব্রিটিশ ঔপনিবেশের যাঁতাকলের নাগ পাশ থেকে বাংলাকে আলাদা ভূ-অঞ্চল করার, বাংলাভাষীদের অধিকার আদায়ের অনেক আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে। বঙ্গবন্ধুই অবশেষে বাংলার স্বাধীনতা দিয়েছেন, বাঙালীদের অধিকার দিয়েছেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে একটা বিধ্বস্ত দেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছিলেন এবং সকল ক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনাসহ উন্নয়নের শক্ত ভিত স্থাপন করেছেন। বঙ্গবন্ধু সব সময় বলতেন ‘স্বাধীনতা অর্জন করা কঠিন, তার চেয়ে কঠিন রক্ষা করা। জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি না হলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে ।’ ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের সহায়তায় সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যা করে বাঙালীর অর্থনৈতিক মুক্তির পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল। একুশটি বছর বাংলাদেশ চলেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, পাকিস্তানী রাজনীতির ভাবধারায়। রাজনীতি হয়েছে কলুষিত, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বঞ্চিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার, হাজার বছরের কৃষ্টি, ঐতিহ্য সংস্কৃতির ধারা থেকে বঞ্চিত। ১৯৮১ সালের ১৭ মে, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বুকের ভেতর কষ্টের পাথর বেঁধে পা রেখেছিলেন তাঁরই স্নেহময়ী প্রাণপ্রিয় পিতা-মাতা, ভাই ভ্রাতৃবধূসহ নিকট আত্মীয়ের রক্তে ভেজা বাংলার মাটিতে, নিজের স্বামী, দুটো শিশু সন্তান-সংসারের অবশিষ্ট সুখটুকু পেছনে ফেলে- বাবার মতোই কোন পিছুটান না রেখে- কেবল বাবার অবশিষ্ট কাজটুকু সম্পন্ন করতে। পঁচাত্তরে খুনীরা তখনও তৎপর- সব জায়গায় ওত পেতে আছে। এর মধ্যেই বঙ্গবন্ধু কন্যা পিতার পথ ধরে জীবনের সকল ঝুঁকি নিয়ে শুরু করলেন বাংলার মানুষের মুক্তির সংগ্রাম। সেদিন যদি তিনি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন না করতেন তাহলে এতদিনে দেশ পুরোপুরি পাকিস্তানের মতো স্বৈরাচারী, বিশৃঙ্খল, সাম্প্রদায়িক, জঙ্গী রাষ্ট্রে পরিণত হতো। শেখ হাসিনা সে অবস্থা থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করেছেন এবং বাংলার মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে অভিসিক্ত করেছেন। ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তিপাক’- ৮১ থেকে ৯০ পর্যন্ত দীর্ঘ আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন শেখ হাসিনা এবং প্রধান শক্তি ছিল তাঁর দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সঙ্গে সহযোগী সংগঠনসমূহ। ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের নৈরাজ্য, অনাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন শেখ হাসিনা। তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ মে ঢাকার মাটি ছুঁয়ে যে কথা দিয়েছিলেন তা তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছেন। একইভাবে সেদিন ঢাকা শহরে লাখ লাখ কর্মীরা যে শপথ নিয়েছিলেন যে, দেশের সকল পরিস্থিতিতেই তাদের মায়ের মতো বোনের মতো নেত্রীকে আগলে রাখবেন সেটিই তারা প্রমাণ করেছেন। আজকে বাংলাদেশে বার বার সঙ্কটাপন্ন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আবহে, হাজার বছরের বাঙালী কৃষ্টি সংস্কৃতির অবগাহনে ফিরে পেয়েছে বাংলাদেশের প্রাণ। বাংলাদেশ আজকে বিশে^র বিস্ময়। বিশ্বের দরবারে উন্নয়নের রোলমডেল। গত ২০১৮ সালে স্যাটেলাইট-১ এর উৎক্ষেপণের মাধ্যমে আকাশ বিজয় করেছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আকাশ-সমুদ্র- সীমান্ত বিজয় পূর্ণ হলো। গত ২০১৭ সালে ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে সকল শর্ত পূরণ করে বাংলাদেশ উন্নয়শীল দেশে পদার্পণ করেছে। বাংলাদেশের মাথা পিছু আয় এখন প্রায় ২০০০ ডলার। অর্থনৈতিক অনেক সূচকে বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় এগিয়ে। প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের ওপর। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ধাপে ধাপে পূরণ হয়ে যাচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ বা রূপকল্প ২০২১ এর সকল কর্মসূচী। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য, বিদ্যুত, যোগাযোগসহ সকল ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হচ্ছে জাজ¦ল্যমান পরিবর্তন। দারিদ্র হ্রাস, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণ, আঞ্চলিক সহযোগিতা সম্প্রসারণ এসব কারণেই বাংলাদেশ বিশে^র দরবারে বিশেষ অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ যোগাযোগ ব্যবস্থায় দৃশ্যমান হচ্ছে আমূল পরিবর্তন। সময় এখন বাংলাদেশের। সময় এখন শেখ হাসিনার, সময় এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শক্তির। শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে এবং বাংলাদেশ উন্নয়নের ধারার জন্য অর্জন করছেন অসংখ্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে হয়েছেন মাদার অব হিউম্যানিটি। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি দমন কর্মসূচীকে আরও বেগবান করা এখন সময়ের দাবি। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এখন বিশ্বের অন্যতম সেরা, সৎ, যোগ্য, কর্মঠ, মানবতাবাদী গণতান্ত্রিক নেতা। গণতন্ত্রের মানসকন্যা এখন গণতন্ত্রের মূর্তপ্রতীক। বঙ্গবন্ধু বাঙালীকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। স্বাধীনতা পরবর্র্তী সঙ্কট নিরসন করে গেছেন, দেশের সকল ক্ষেত্রে শক্ত ভিত করে গেছেন যার উপরই হচ্ছে সকল উন্নয়ন। তাঁর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা পিতার পদাংক অনুসরণ করে পুনরায় গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ে তুলেছেন, বাস্তবায়ন করে চলেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অর্থনৈতিক মুক্তির পথ ধরে সার্থক করে তুলছেন স্বাধীনতা। নারী সরকার প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, যুক্তরাজ্যের মার্গারেট থ্যাচার ও শ্রীলঙ্কার চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গার রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছেন। সম্প্রতি উইকিলিকসের এক জরিপের তথ্যের ভিত্তিতে ভারতীয় বার্তা সংস্থা ইউনাইটেড নিউজ অব ইন্ডিয়া (ইউএনআই) এ তথ্য জানিয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করে তাঁর বাস্তবায়ন করছেন। সম্প্রতি ছাত্রলীগের প্রধান নেতৃদ্বয়কে পরিবর্তন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। দেশের সকল ক্ষেত্রে নির্মোহভাবে এ দৃষ্টান্তের প্রতিফলন ঘটবে এটিই দেশবাসীর প্রত্যাশা। আমরা যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক দাবি করি তাঁদেরকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুসরণ করে বিশ্ব রাজনীতির তান্ডবের সময় শক্তভাবে জননেত্রী শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়াতে হবে তবেই চূড়ান্ত মুক্তির লক্ষ্যে পৌঁছবে বাংলাদেশ এবং বাঙালী জাতি। আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর জন্মদিন আপনার। শুভ জন্মদিন জননেত্রী শেখ হাসিনা। আপনার দীর্ঘায়ু এবং সুস্থ জীবন কামনা করি। লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×