ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বোবায় ধরা হল গভীর ঘুম ও জাগরণের মাঝামাঝি একটি স্নায়ুজনিত সমস্যা

প্রকাশিত: ০৬:৩৫, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯

বোবায় ধরা হল গভীর ঘুম ও জাগরণের মাঝামাঝি একটি স্নায়ুজনিত সমস্যা

অনলাইন ডেস্ক ॥ ফারজানা ইয়াসমিনের বয়স ত্রিশের কোঠায়। প্রায় রাতেই তিনি গভীর ঘুম থেকে জেগে ওঠেন এবং তার মনে হয় শরীরের ওপর যেন ভারী কিছু চাপ দিয়ে আছে, সেটা এতোটাই ভারী যে তিনি নিশ্বাস নিতে পারেননা। এমনকি পাশে কেউ থাকলে তাকেও ডাকতে পারেন না। "ঘুমটা হঠাৎ ভেঙ্গে যায়। মনে হয় যে আমার কোন শক্তি নেই। নিজের হাত পা নাড়ানোর মতো, মুখে আওয়াজ করার মতো শক্তিটাও পাইনা। অনেক চেষ্টা করলে গোঙানির মতো শব্দ হয়।" "মনে হয় যেন এই বোধহয় দম আটকে মারা যাব। মাত্র কয়েক সেকেন্ড এই অবস্থাটা লাস্ট করে। কিন্তু তাতেই মনে হয় ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। এতো ভয়ংকর, ওই সময়টা। যার না হয় সে কখনোই বুঝবেনা।" বলেন মিস ইয়াসমিন। এমন অভিজ্ঞতার কথা আমাদের আশেপাশে আরও অনেকের কাছ থেকে শোনা যায়। যাকে অনেকে "বোবায় ধরা" বলে থাকেন। বোবায় ধরা কী? চিকিৎসাশাস্ত্রের ভাষায় এই সমস্যাকে বলা হয় স্লিপ প্যারালাইসিস, বা ঘুমের মধ্যে পক্ষাঘাত। স্লিপ প্যারালাইসিস হলে একজন ব্যক্তি কিছু সময়ের জন্য কথা বলা বা নাড়াচাড়া করার শক্তি হারিয়ে ফেলেন। এটি সাধারণত কয়েক সেকেন্ড থেকে এক মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। তবে ওই সময়টায় রোগী ভীষণ ঘাবড়ে যান, ভয় পেয়ে যান। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সামান্থা আফরিনের মতে, বোবায় ধরা বা স্লিপ প্যারালাইসিস হল গভীর ঘুম ও জাগরণের মাঝামাঝি একটি স্নায়ুজনিত সমস্যা। ঘুমের ওই পর্যায়টিকে বলা হয় র‍্যাপিড আই মুভমেন্ট-রেম। রেম হল ঘুমের এমন একটি পর্যায় যখন মস্তিষ্ক খুব সক্রিয় থাকে এবং এই পর্যায়ে মানুষ স্বপ্ন দেখে থাকে। কিন্তু সে সময় শরীরের আর কোন পেশী কোন কাজ করেনা। এ কারণে এসময় মস্তিষ্ক সচল থাকলেও শরীরকে অসাড় মনে হয়। বোবায় ধরা কাদের হয়, কেন হয়? স্লিপ প্যারালাইসিস হওয়ার নির্দিষ্ট কোন বয়স নেই। এই পরিস্থিতি যে কারও সঙ্গে যেকোনো বয়সে হতে পারে। তবে ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা সংস্থা বা এনএইএস-এর তথ্য মতে তরুণ-তরুণী এবং কিশোর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন। স্লিপ প্যারালাইসিস হওয়ার পেছনে কিছু কারণকে চিহ্নিত করেছে তারা। ১. পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব বা ছেড়ে ছেড়ে ঘুম হওয়া। অসময়ে ঘুমানো। অনেক সময় কাজের সময় নির্দিষ্ট না হলে, অথবা দূরে কোথাও ভ্রমনে গেলে এমন ঘুমের সমস্যা হতে পারে। ২. মাদকাসক্ত হলে অথবা নিয়মিত ধূমপান ও মদপান করলে। ৩. পরিবারে কারও স্লিপ প্যারালাইসিস হয়ে থাকলে। ৪. সোশ্যাল অ্যাঙ্কজাইটি বা প্যানিক ডিসঅর্ডার বা বাইপোলার ডিজঅর্ডারের মতো মানসিক সমস্যা থাকলে। বোবায় ধরার লক্ষণ: ডা. সামান্থা আফরিনের মতে এবং ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী স্লিপ পারালাইসিসের সাধারণ কয়েকটি লক্ষণ রয়েছে। সেগুলো হল: ১. বড় করে নিশ্বাস নিতে অনেক কষ্ট হয়। মনে হবে যেন বুকের মধ্যে কিছু চাপ দিয়ে আছে। দম বেরোচ্ছেনা। ২. অনেকের চোখ খুলতে এমনকি চোখ নাড়াচাড়া করতেও সমস্যা হয়। ৩. অনেকের মনে হয় যে কোন ব্যক্তি বা বস্তু তাদের আশেপাশে আছে, যারা তার বড় ধরণের ক্ষতি করতে চায়। ৪. ভীষণ ভয় হয়। শরীর ঘেমে যায়। ৫. হৃৎস্পন্দন ও শ্বাস প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যায়। অনেকের রক্তচাপও বাড়তে পারে। ৬. পুরো বিষয়টা কয়েক সেকেন্ড থেকে এক মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। প্রভাবটি কেটে গেলে আগের মতো কথা বলা বা নড়াচড়া করায় কোন সমস্যা থাকেনা। তারপরও অনেকে অস্থির বোধ করেন এবং পুনরায় ঘুমাতে যেতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এর চিকিৎসা: স্লিপ প্যারালাইসিস আসলে গুরুতর কোনও রোগ নয়। মাঝে মাঝে নিজে থেকেই ভাল হয়ে যায়। মনকে চাপমুক্ত রাখার পাশাপাশি ঘুমানোর অভ্যাসে ও পরিবেশে ইতিবাচক পরিবর্তন আনলে অনেক ক্ষেত্রেই এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা সাধারণ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন: ১. রাতে অন্তত ৬ ঘণ্টা থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমানোর চেষ্টা করা। এবং সেই ঘুম যেন গভীর হয়। ২. প্রতিদিন রাতে একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এবং সকালে একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে জেগে ওঠার অভ্যাস করা। এমনকি ছুটির দিনগুলোতেও। ৩. ঘুমের জন্য শোবার ঘরটিতে আরামদায়ক পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করতে হবে। যেন সেই ঘরে কোলাহল না থাকে, ঘরটি অন্ধকার থাকে এবং তাপমাত্রা সহনীয় মাত্রায় থাকে, খুব বেশি না আবার কমও না। সম্ভব হলে ঘরে ল্যাভেন্ডারের সুগন্ধি ছিটিয়ে দেয়া যেতে পারে। ৪. ঘুমাতে যাওয়ার আগ মুহূর্তে ভারী খাবার সেইসঙ্গে ধূমপান, মদ পান এবং ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় যেমন চা-কফি খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। ৫. ঘুমাতে যাওয়ার অন্তত চার ঘণ্টা আগে ব্যায়াম করার চেষ্টা করা। ৬. ঘুমের সময় হাতের কাছে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ অর্থাৎ ঘুমের বাঁধা হতে পারে এমন কোন বস্তু রাখা যাবেনা। ৭. দিনের বেলা দীর্ঘসময় ঘুম থেকে বিরত থাকতে হবে। ৮. স্লিপ প্যারালাইসিস হলে নিজের মনকে প্রবোধ দিতে হবে যে ভয়ের কিছু নেই, এই পরিস্থিতি সাময়িক, কিছুক্ষণ পর এমনই সব ঠিক হয়ে যাবে। এই সময়ে শরীর নাড়াচাড়া করার চেষ্টা থেকে বিরত থাকতে হবে। কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে: এসব নিয়ম মেনে চলার পরও যদি কারও বাড়াবাড়ি রকমের স্লিপ প্যারালাইসিস হয় অর্থাৎ আপনার ঘুমে নিয়মিতভাবে ব্যাঘাত ঘটে তাহলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। কেননা স্লিপ প্যারালাইসিস ঘন ঘন হলে উদ্বিগ্নতার কারণে রক্তচাপ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে বা কমে যায়, যা বড় ধরণের স্বাস্থ্য-ঝুঁকির সৃষ্টি করতে পারে। চিকিৎসক রোগীর সার্বিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে থাকেন। অনেক সময় তারা কম থেকে বেশি মাত্রার অ্যান্টি ডিপ্রেসেন্ট ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন। চিকিৎসা পদ্ধতি: নিউরোলজিস্ট বা স্নায়ু বিশেষজ্ঞরা মূলত ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সেক্ষেত্রে তারা ইলেক্ট্রোমায়োগ্রাম-ইএমজি পরীক্ষা করে থাকেন। এখানে মূলত মাংসপেশির ইলেকট্রিকাল অ্যাকটিভিটির মাত্রা পরীক্ষা করা হয়। যেটা কিনা স্লিপ প্যারালাইসিসের সময় অনেক কমে যায়। রাতে ঘুম না হওয়ার কারণে স্লিপ প্যারালাইসিসে আক্রান্তদের অনেকেরই দিনের বেলায় ঘুম ঘুম ভাব হয়। সেসময় চিকিৎসকরা রোগীর এই দিনের বেলার ঘুম পরীক্ষা করে থাকেন। যাকে বলা হয় ডে-টাইম ন্যাপ স্টাডি এবং এর পরীক্ষাটিকে বলা হয় মাল্টিপল স্লিপ ল্যাটেন্সি টেস্ট। স্লিপ প্যারালাইসিসের সময় মস্তিষ্ক জেগে উঠলেও শরীর তখনও শিথিল থাকে। এর কারণ হিসেবে কানাডার দুই গবেষক জানিয়েছেন যে মস্তিষ্কে দুই ধরণের রাসায়নিক বা অ্যামাইনো অ্যাসিডের নি:সরণের কারণে মাংসপেশি অসাড় হয়ে পড়ে। রাসায়নিক দুটি হল, গ্লাইসিন এবং গামা অ্যামাইনোবিউটিরিক অ্যাসিড-গ্যাবা। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানী প্যাট্রিসিয়া এল ব্রুকস এবং জন এইচ পিভার, পিএইচডি একাধিক পরীক্ষার মাধ্যমে জানতে পেরেছেন যে নিউরোট্রান্সমিটার গ্যাবা এবং গ্লাইসিন মস্তিষ্কে পেশী সক্রিয় রাখার কোষগুলোকে "সুইচ অফ" করে দেয়। সূত্র : বিবিসি বাংলা
×