ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জিম্বাবুইয়ের মুগাবে- স্বৈরাচারীর তিরোধান

প্রকাশিত: ০৮:০৪, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯

জিম্বাবুইয়ের মুগাবে- স্বৈরাচারীর তিরোধান

১৯৮০-এর প্রথম দিকে আমি জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থার অর্থনৈতিক পরামর্শক হিসেবে কেনিয়া হয়ে উগান্ডায় গিয়েছিলাম। ফেরার সময় কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে এসে প্রশাসনিক সার্ভিসে সহকর্মী রফিউল করিমের অতিথি হয়েছিলাম। উগান্ডায় কাজ করার সময়, বিশেষত সেখানকার নামকরা ম্যাকরারে বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনার রেশ ধরে পাশের সদ্য স্বাধীন দেশ জিম্বাবুইয়েতে যেতে চেয়েছিলাম আমি। ১৯৮০-এর ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে সেখানে তখনকার কিংবদন্তীয় রাজনৈতিক নেতা রবার্ট গ্যাব্রিয়েল মুগাবে তার রাজনৈতিক দল জিম্বাবুইয়ে আফ্রিকান ন্যাশনাল ইউনিয়নের (জানু) পতাকা নিয়ে নির্বাচনে ৬৩% ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছিলেন। মার্কস ও লেনিনের দর্শন অনুসারী ছিলেন রবার্ট মুগাবে। তখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়ানক অবনতির কারণে সে দেশে যাওয়া থেকে করিম নিবৃত্ত করেছিলেন আমাকে। ফলে জিম্বাবুইয়ে আর যাওয়া হয়নি আমার। চাক্ষুস পরিচয় ঘটেনি মুগাবের সঙ্গে। সেই মুগাবে মারা গেলেন এই সেপ্টেম্বরের ৬-এ সিঙ্গাপুরে। দেশবাসী কর্তৃক প্রেসিডেন্টের পদ থেকে অপসারিত হয়ে কার্যত দেশত্যাগী হিসেবে। আলজাজিরার সংবাদে দেখলাম জিম্বাবুইয়ের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই নেতা, আফ্রিকান ঐক্যের প্রবক্তার ১৪ সেপ্টেম্বরের শেষকৃত্যে রাজধানী হারারের জাতীয় স্টেডিয়ামের প্রায় তিন-চতুর্থাংশে আসন খালি রেখে জিম্বাবুইয়ের জনগণ তার প্রতি শ্রদ্ধার অর্ঘ্য অপুরিত রেখেছেন এবং জীবনান্তে পৃথিবীর কাছে মুগাবেকে ব্যর্থ রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারক হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তৎকালীন দক্ষিণ রোডেশিয়ার এক ছোট শহর কুতামাতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সোনা গোত্রভুক্ত এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেন মুগাবে। কুতামা কলেজ ও ফোটহারে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে মুগাবে মার্কসীয়-লেনিনীয় দর্শন অনুসারী হন এবং কর্মজীবনের প্রথম পর্যায়ে কলেজ ও বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে রোডেশিয়া এবং ঘানায় প্রসিদ্ধি লাভ করেন। এই সময়ে ঘানা ঔপনিবেশিক আফ্রিকান মহাদেশে একমাত্র উপনিবেশবাদমুক্ত স্বাধীন দেশ ছিল। পরে ১৯৬০ সাল থেকে তখনকার রোডেশিয়ায় উপনিবেশ স্থাপনকারী জনসংখ্যার হিসাবে সংখ্যালঘিষ্ঠ শ্বেত সম্প্রদায়ের একচ্ছত্র ভূমি মালিকানা ও সরকারী শক্তির বিরুদ্ধে জনগণকে সংঘবদ্ধ করতে থাকেন তিনি। ১৯৬৪ থেকে ৭৪ পর্যন্ত রোডেশিয়ার সংখ্যালঘু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতিনিধি শ্বেতশাসক আয়ান স্মিথ তাকে প্রায় ১১ বছর কারান্তরে বিনা বিচারে আটকে রাখেন। জেলে থেকে ডাকযোগে পাঠ নিয়ে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর, প্রশাসনে স্নাতক ও আইন বিষয়ে প্রবেশিকা ডিগ্রিপ্রাপ্ত হন। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি পার্শ্ববর্তী মোজাম্বিকে পালিয়ে যান। পরে রোডেশিয়ায় ফিরে এসে জনগণকে উপনিবেশবাদ ও সংখ্যালঘু শ্বেত সরকারের বিরুদ্ধে সংগঠিত করে জিম্বাবুইয়ান আফ্রিকান ন্যাশনাল ইউনিয়নের (জানু) নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হন এবং শ্বেত ঔপনিবেশিক শাসক আয়ান স্মিথের সেনাবাহিনীর সঙ্গে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষ্ণকায় জনগণকে রোডেশিয়ার সর্বত্র বন থেকে বনে ছড়িয়ে পড়া গেরিলা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। তার সহযোগী ছিলেন জোসিয়া তনগোগারা। ইতোমধ্যে ১৯৬৫ সালে আয়ান স্মিথ রোডেশিয়াকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বাইরে একতরফাভাবে স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করেন। ব্রিটেন এভাবে ঘোষিত স্বাধীনতাকে প্রাথমিক পর্যায়ে স্বীকৃতি দেয়নি। রোডেশিয়ার কৃষ্ণ জনগণ স্বাধীনতাকে গ্রহণ করে; কিন্তু শ্বেত সংখ্যালঘু সরকারের তীব্র বিরোধিতা করে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ তথা কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের প্রতিনিধি সমন্বয়ে সরকার গঠনের দাবি জানাতে থাকেন। পরে ব্রিটেনের মধ্যস্থতায় রোডেশিয়ায় কৃষ্ণাঙ্গ এবং শ্বেতাঙ্গদের সম্মতি ও মতৈক্যের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত এবং সে দেশের বড় বড় শ্বেতাঙ্গ ভূমি মালিকদের জমি যথার্থ ক্ষতিপূরণ দিয়ে জাতীয়কৃত করে কৃষ্ণদের মাঝে বিতরিত হবে- এই দুই শর্ত মেনে মুগাবে ১৯৮০ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ব্রিটেন তার সরকার ও রোডেশিয়ার স্বাধীনতাকে মেনে নেয়। এই সময় তাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিপ্লবের বীর পুরুষ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আশা করা হয় যে, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে তিনি তার দেশে দল ও গোষ্ঠীগত বিরোধ দূর করতে সক্ষম হবেন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুযায়ী জনগণের কাছে জবাবদিহিতাবিশিষ্ট সরকার স্থাপন করবেন এবং সংখ্যালঘিষ্ঠ শ্বেতাঙ্গদের যথাপ্রয়োজন নাগরিক প্রতিরক্ষণ দেবেন। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে মুগাবে রোডেশিয়ার নাম জিম্বাবুইয়েতে পরিবর্তন করেন। সকল পক্ষ থেকে আশা করা হয় যে, জিম্বাবুইয়ের উপনিবেশবাদী একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণাকারী শ্বেত সংখ্যালঘুদের সরকার দূরে সরিয়ে তিনি সকল বর্ণ ও শ্রেণীর জনগণের জন্য প্রকৃত গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করবেন। প্রাথমিক পর্যায়ে মুগাবে জিম্বাবুইয়ে দৃষ্টি আকর্ষণীয় প্রগতিশীল কার্যক্রম গ্রহণ করেন। তিনি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা বিস্তৃত করেন। ১৯৮০ সালে জিম্বাবুইয়ে মাত্র ১৭৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল। ২০০০ সালের মধ্যে এসব বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৫০০ ছাড়িয়ে যায়। এই সময়ে বয়স্ক সাক্ষরতার হার ৬২% থেকে ৮২%-এ উন্নীত হয়, শিশুদের রোগ প্রতিষেধক ইনজেকশনের ব্যাপ্তি ২৫% থেকে ৯২%-এ উন্নীত হয়। তার সরকার শ্বেতাঙ্গ বড় বড় কৃষকদের জমি ন্যায্যমূল্যের বিপরীতে কৃষ্ণাঙ্গ ক্ষুদ্র কৃষকদের মাঝে বিতরণ শুরু করে। একই সময়ে তার কৃষ্ণাঙ্গ গোত্র সোনার সঙ্গে বিরোধী রাজনৈতিক দল জমুয়া নকমোর নেতৃত্বাধীন জিম্বাবুইয়ে আফ্রিকান জন ইউনিয়ন বা জাপুর সঙ্গে সমঝোতা স্থাপনে তিনি প্রয়াসী থাকেন। তিনি তার মন্ত্রিসভায় ৪টি পদে বিরোধী দলকে স্থান দেন। পরে ১৯৮৭ সালে সংবিধান পরিবর্তন করে তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রেসিডেন্টের পদ গ্রহণ করেন। স্বৈরতান্ত্রিকতার অনুসরণে তিনি ২০০২, ২০০৮ ও ২০১৩তে প্রহসনমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে ২১ নবেম্বর ২০১৭ পর্যন্ত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকেন। এই সময়ে তিনি স্বৈরতান্ত্রিকতার পথ অনুসরণ করে একাধারে অত্যাচারী ও অযোগ্য প্রশাসক হিসেবে সারা বিশ্বের কাছে নিজকে প্রতিভাত করেন। ১৯৮২ থেকে ৮৭ সাল সময়ে তিনি তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী নকমোর সমর্থকদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালান। গুকুরাহুন্দি সূত্র (বৃষ্টিপূর্ব খরকুটো উড়ানো প্রবল বায়ু প্রবাহ) অনুযায়ী মাতাবেলেল্যান্ডে তার সৈন্যবাহিনী ও সমর্থকরা ন্যূনপক্ষে ২০ হাজার বিরোধী জনগোষ্ঠীকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করে। দেশের বিরোধী দলকে সর্বাত্মকভাবে তার রাজনৈতিক দল ও সরকার দিয়ে নির্যাতন এবং দমন করা হয়। তাদের জন্য সভা র‌্যালি নিষিদ্ধ, সকল অফিস গৃহ তালাবদ্ধ এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত সকল জেলা কাউন্সিল বন্ধ করে দেয়া হয়। বিরোধী দল জাপুকে বেআইনী ঘোষণা করে এর সদস্যবৃন্দকে সরকারী দল জানুতে জোর করে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফলত জিম্বাবুইয়ে কার্যত একক রাজনৈতিক দলবিশিষ্ট দেশে পর্যবসিত হয়। তার অনুমোদিত স্লোগান সারাদেশে নির্লজ্জভাবে উচ্চারিত হয় : বিরোধী দলকে ভোট দিয়ে আত্মহত্যা কর না, সরকারী দলকে সমর্থন করে বেঁচে থাক। ২০০৫ সালে মুগাবের অত্যাচারী সরকার ৭ লাখ বস্তিবাসীকে নগর উন্নয়নের মোড়কে বাস্তুচ্যুত করে। শ্বেতাঙ্গদের জন্য পার্লামেন্টের সংরক্ষিত ২০ আসন বিলুপ্ত করা হয়। শ্বেতাঙ্গ শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও বাণিজ্যিক কৃষকগণ জিম্বাবুয়ে ছেড়ে ব্রিটেনে অভিবাসী হতে থাকেন। রোডেশিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা ছাড়িয়ে স্বাধীন জিম্বাবুইয়েতে নিজ দেশবাসীকে হত্যা করে মুগাবের তল্পিবাহকরা অত্যাচারের রেকর্ড স্থাপন করে ফেলে। সরকারী রাজনৈতিক দল জানুর নেতা ও কর্মীরা জিম্বাবুইয়ের সব স্থানে নিজেদের ব্যবসাকেন্দ্র খুলে বসে। সকল সংবাদপত্র সরকারী দলের মালিকানাভুক্ত ট্রাস্টের অধীনে আনা হয়। সংবাদপত্রের মালিকানা ও পরিচালনা থেকে সকল শ্বেতাঙ্গকে হটিয়ে দিয়ে জানুর কৃষ্ণাঙ্গদের যোগ্যতা যাচাই না করে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৯২ সালে জানুর নেতা ও কর্মীদের মালিকানাধীন সম্পদ এবং ব্যবসায়ের মূল্য ৭৫ মিলিয়ন যুক্তরাষ্ট্রীয় ডলারে প্রাক্কলিত হয়। একই সময়ে মুগাবের সমর্থকরা দেশব্যাপী হত্যা, নির্যাতন ও লুটতরাজের তা-ব চালাতে থাকে। দেশের প্রশাসন ও বিচার বিভাগের তৎপরতা জনগণের জান এবং মাল রক্ষাকরণের প্রক্রিয়ায় পূর্ণ মাত্রায় নিষ্ক্রিয় থাকে। ভিন্নতর রাজনৈতিক দলে কর্মী ও সমর্থকদিগকে দমন করার প্রক্রিয়ায় সরকারী নির্বাহীদের বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং অত্যাচারের অনুকূলে দায়মুক্তি দেয়া হয়। ২০০০ সাল থেকে অনুসৃত পারস্পরিক সমঝোতার সূত্র ত্যাগ করে মুগাবে শ্বেতাঙ্গ বাণিজ্যিক কৃষকদের জমি কৃষ্ণাঙ্গ কৃষকদের অনুকূলে জোর করে দখলে নিতে থাকেন। স্বাধীনতার বছরে জিম্বাবুইয়ের সকল চাষযোগ্য জমির ৩৯% ৬০০ শ্বেতাঙ্গ মালিকানা বাণিজ্যিক খামারের আওতায় ছিল, ৪১% জমি সামাজিক মালিকানা এবং মাত্র ৪% কৃষ্ণাঙ্গ বাণিজ্যিক খামারের মালিকানাধীন ছিল। ২০০০ সাল পর্যন্ত ব্রিটেনের সহায়তায় শ্বেতাঙ্গ খামারিরা কৃষ্ণাঙ্গ খামারিদের কাছে পারস্পরিক আলোচনাভিত্তিক মূল্য নির্ধারণের সূত্র অনুযায়ী হস্তান্তর করে আসছিল। ১৯৯০-এর মধ্যেই ৫২ হাজার কৃষ্ণাঙ্গ পরিবার এভাবেই শ্বেতাঙ্গ বাণিজ্যিক কৃষকদের ৬.৫ মিলিয়ন একর জমি দখল করেছিল। এই প্রক্রিয়া বর্জন করে ২০০০ সাল থেকে মুগাবের অনুগত নেতা ও কর্মীরা বেশ পরিমাণ জমি নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। তার অনুসারীরা ও অন্য কৃষ্ণাঙ্গ কৃষকরা প্রযুক্তি, মূলধন ও উদ্যমের অভাবে এসব জমিতে আগের মতো তেমন উৎপাদন করতে সক্ষম হননি। ফলত দেশ দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়। ২০০০ সালে জিম্বাবুইয়ে ২ মিলিয়ন টন ভুট্টা উৎপাদন করেছিল। ২০০৮ সালে ভুট্টার উৎপাদন আধা মিলিয়ন টনের নিচে নেমে আসে। ২০০৩ সালে মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ সংস্থার (হিউম্যান রাইটস ওয়াচ) হিসাব অনুযায়ী খাদ্য-নিরাপত্তার বলয়ের বাইরে জিম্বাবুইয়ের ৫২% জনগণ নিপতিত হয়। ২০০৯ সালের মধ্যে দেশের ৭৫% জনগণ বিদেশ থেকে আমদানীয় খাদ্য সহায়তার ওপর নির্ভরশীল বলে বিদিত হয়। এই সময় খাদ্য বিপণন বোর্ড স্থাপন করে মুগাবের সরকার খাদ্য বাজারজাতকরণ থেকে ব্যক্তি উদ্যমকে বহিষ্কৃত করে। এই খাদ্য বিপণন বোর্ড, খাদ্যের বিতরণ প্রধানত মুগাবের রাজনৈতিক দল জানুর সদস্যবৃন্দের মধ্যে সীমিত রাখে। ১৯৯০-এর দশকে জিম্বাবুয়ের অর্থব্যবস্থা চরম বিপর্যয়ে পতিত হয়। মুগাবের মন্ত্রী ও সরকারের উচ্চ পদাসীন নির্বাহীরা দুর্নীতিতে আবদ্ধ থাকেন, দেশব্যাপী সার্বিক উৎপাদন তীব্র গতিতে কমে যায়। ২০০০ সালে জিম্বাবুইয়ের দেশজ অভ্যন্তরীণ উৎপাদ (জিডিপি) ৭.৪ বিলিয়ন যুক্তরাষ্ট্রীয় ডলারের প্রাক্কলিত হয়। ২০০৫ সালে এর জিডিপি যুক্তরাষ্ট্রীয় ডলার ৩.৪ বিলিয়নে নেমে আসে। ১৯৯৮ সালে বেকারত্ব কর্মক্ষম জনগণের প্রায় ৫০%-এ পৌঁছে। ২০০৯ সালে জিম্বাবুইয়ের প্রায় ৪০ লাখ দক্ষ শ্রমিক দেশ ছেড়ে চলে যায়। এই পরিস্থিতিতে মার্কসিয়ান-লেনিনিয়ান দর্শন অনুযায়ী মুগাবে ৪.২ বিলিয়ন জিম্বাবুইয়েন ডলার ব্যাংকসহ জাতীয় অবসর ভাতা দেয়ার কার্যক্রম শুরু করেন। ফলত দেশে তীব্র মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। ২০০৭ সালে জিম্বাবুইয়ের দৃষ্ট মুদ্রাস্ফীতি বিশ্বের সর্বোচ্চ বার্ষিক ৭৬০০%-এ উঠে আসে। ২০০৮ সালে মুদ্রাস্ফীতির হার অবিশ্বাস্য ১০০০০০%-এ উন্নীত হয়। সরকার মার্কিন ডলারকে রাষ্ট্রীয় মুদ্রা বা লিগ্যাল টেন্ডার ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। ফলত অর্থ ব্যবস্থার ওপর সরকারের কোন প্রভাব ফেলার পথ ও পন্থা বিলুপ্ত হয়। আমদানি-রফতানির ধারা গণদৃষ্টি ও ব্যবস্থাপনার অন্তরালে চলে যায়। দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। সরকারের তৎপরতা কিছু বিচ্ছিন্ন শহর এলাকায় সীমিত হয়ে আসে। মোটকথা, মুগাবের সরকার ব্যর্থ সরকারে পর্যবসিত হয়, জিম্বাবুইয়ের নাম ব্যর্থ রাষ্ট্রের উদাহরণ হিসেবে বহির্বিশ্বে উল্লিখিত হতে থাকে। এরূপ অর্থনৈতিক ও সামাজিক দুঃসময়ে মুগাবে দেশের বাইরে নিজকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রয়াস নেন। ১৯৮৬ সালে তিনি জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রধান নির্বাচিত হন। ১৯৯৬-এ তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনকে সক্রিয় সহায়তা দেন ও দক্ষিণ আফ্রিকার উন্নয়ন সম্প্রদায়ের সশস্ত্র বিভাগের প্রধান নির্বাচিত হন। ১৯৯৮ সালে তিনি দ্বিতীয় কঙ্গো যুদ্ধে ১১০০০ সৈন্য পাঠান, কঙ্গোর তৎকালীন প্রেসিডেন্টের সমর্থনে এ্যাঙ্গোলা ও নামিবিয়াকে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানান। এই যুদ্ধে প্রযুক্ত হয়ে জিম্বাবুইয়ের অর্থনৈতিক সঙ্কট সত্ত্বেও মুগাবে দৈনিক ১ মিলিয়ন যুক্তরাষ্ট্রীয় ডলার ব্যয় করতে থাকেন। ১৯৮০ সালেও তিনি জিম্বাবুইয়েকে আফ্রিকান ঐক্য সংঘের সদস্য হিসেবে সংযুক্ত করেন এবং ১৯৯৭-এ এই সংঘের সম্মেলন অযৌক্তিক ব্যয়ে নিছক আত্মসন্তুষ্টির জন্য হারারেতে অনুষ্ঠিত করেন। মুগাবের দুঃশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে জনগণের সমর্থন নিয়ে জিম্বাবুইয়ের সামরিক বাহিনী ২০১৭-এর ১৫ নবেম্বর তাকে গৃহবন্দী করে। ১৯ নবেম্বর তার রাজনৈতিক দল জানু তাকে দল থেকে পদচ্যুত করে। ডিসেম্বরে তিনি প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তার ভাইস প্রেসিডেন্ট মানানগাগওয়ার নেতৃত্বে গঠিত পরবর্তী সরকার তাকে পূর্ণ কূটনৈতিক মর্যাদা, সরকারী ব্যয়ে আজীবন ৫ শয়নকক্ষবিশিষ্ট একটি বাড়ি, ২৩ জন সেবক কর্মচারী এবং তার অর্জিত সকল সম্পদ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রাখার অধিকার দেয় এবং তাকে অতিরিক্ত ১০ মিলিয়ন যুক্তরাষ্ট্রীয় ডলার প্রদান করে। ২০১৯-এর ৬ সেপ্টেম্বর তিনি সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার শেষকৃত্যে যোগ দিয়েছিলেন তার দেশের প্রেসিডেন্ট মানানগাগওয়া, কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরো কেনিয়াতা এবং দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামফোসা। আফ্রিকার অন্য কোন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এই শেষকৃত্যে আসেননি। তেমনি আসেননি পাশ্চাত্যের কোন রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান এবং এরা কেউ তার মৃতুতে শোকবাণী পাঠাননি বা প্রকাশ করেননি। আমাদের দেশের দুই স্বৈরশাসক তাদের মৃত্যুর পর এমনিভাবেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উপেক্ষিত হয়েছিলেন। মুগাবের জীবনালেখ্য পর্যালোচনা করলে ৫টি বৈশিষ্ট্য সহজেই স্পষ্টভাবে শনাক্ত করা যায়। এক. মুগাবে গণতন্ত্রের অনুসারী ছিলেন না, প্রকৃত পর্যায়ে স্বৈরশাসন ও আত্ম-সমৃদ্ধি ছিল তার জীবনের মূলমন্ত্র। দুই. তিনি কার্যকরণে সাম্প্রদায়িক ছিলেন। তিনি শ্বেতাঙ্গদের যেমন ঘৃণা করেছেন, তেমনি বিভিন্ন গোত্রে বিভাজিত তার দেশের কৃষ্ণকায়দের মিলন ঘটাতে পারেননি, এমনকি এই লক্ষ্যে তার শাসনামলের প্রথম দিকের চেষ্টাও আন্তরিক ছিল না। তিন. তিনি আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও সম্মানে বিশ্বাসী ছিলেন না। ফলত তার শাসনের প্রথম ৪ বছর ছাড়া অন্য কোন সময়ে সুশীল প্রশাসন স্থাপন, সংরক্ষণ ও প্রসারণ তার কৃতকর্মকে কোনক্রমেই বিশেষায়িত করেনি। জিম্বাবুইয়েতে তিনি আধুনিক, গতিশীল ও জনগণের কাছে দায়বদ্ধ সরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। চার. তিনি সৎ ছিলেন বলা চলে না, জনগণের সম্পদ অনৈতিকভাবে অর্জন ও ব্যবহার করন এবং সরকারী ক্ষমতায় নিজ স্বার্থে ব্যবহার তাকে তার শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিক শাসক থেকে ভিন্নতর ও সৎ মানব হিসেবে বিশিষ্টতা দেয়নি। পাঁচ. মুগাবের শাসন ও অপতৎপরতা ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পাওয়া কিংবা মুক্তির পথে অগ্রসরমান আফ্রিকার ভাবমূর্তি বিনষ্ট করেছে। আফ্রিকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, গোত্রভিত্তিক আনুগত্যের বাইরে সকল মানুষের অধিকার ও অগ্রগতির চালিকাশক্তি হিসেবে এই মহাদেশের সক্ষমতাকে বিশ্বব্যাপী প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। স্বৈরতন্ত্র যে জনগণের মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না এবং মানবাধিকার রক্ষা করতে সক্ষম নয়- মুগাবের জীবন ও শাসন তাই প্রতিভাত করে গেছে। কর্মজীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে আফ্রিকার স্বাধীনতা ও উন্নয়নের অনুকূলে তার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তিনি তার দলের জনগণের শ্রদ্ধা কিংবা আনুগত্য অর্জন করতে সফল হননি। সহকর্মী রফিউল করিমকে ধন্যবাদ, তিনি এই স্বৈরশাসকের সঙ্গে চাক্ষুস পরিচয় থেকে আমাকে দূরে রেখেছিলেন। লেখক : সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী
×