ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

৮৯তম জাতীয় দিবস ॥ ইসলামী উম্মার সেবায় সৌদি আরব

প্রকাশিত: ০৮:০৫, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯

 ৮৯তম জাতীয় দিবস ॥ ইসলামী উম্মার সেবায় সৌদি আরব

‘আমরা আমাদের মুসলমান ভ্রাতৃবর্গ ও আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাব এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য যথাসাধ্য যা করার করব।’ এই কথাগুলো বলেছিলেন সৌদি আরবের সাবেক বাদশাহ ফাহদ বিন আবদুল আজিজ। এর মধ্য দিয়ে ইসলাম এবং সারা বিশ্বের মুসলমানদের সেবায় সৌদি আরবের উৎসর্গীকৃত মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। মুসলিম উম্মার সেবায় সৌদি আরবের অঙ্গীকার নানারূপে প্রতিফলিত। দেশটি সারা বিশ্বে শত শত কোটি ডলারের সাহায্য জোগায়। মুসলমানদের নিরাপদে ও স্বাচ্ছন্দ্যে হজ পালনের সুবিধার্থে দেশটি বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, সড়ক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার এক বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে এবং মক্কায় পবিত্র মসজিদ ও মদিনায় রসূলে করিমের মসজিদের সম্প্রসারণ কাজের পেছনে বিপুল অর্থ ব্যয় করেছে। সর্বত্র মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় দেশটি বহুবিধ উদ্যোগ ও কর্মসূচী নিয়েছে। এমনি একটি উদ্যোগ হলো অমুসলিম দেশগুলোতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের সেবায় ব্রতী হওয়া কোটি কোটি মুসলমান ইসলামী জাহানের বাইরে ভূখ-ে বসবাস করছে। তাদের সম্প্রদায় বিকশিত ও সমৃদ্ধ হয়েছে। বিপুলসংখ্যক মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এই সম্প্রদায়ের কলেবর বৃদ্ধি করেছে। ইসলামের জন্মভূমি ও প্রাণকেন্দ্র হিসেবে সৌদি আরব মনে করে যে শুধু ইসলামী বিশ্বের প্রতিই নয়, উপরন্তু এর বাইরে বসবাসরত মুসলমানদের প্রতিও তার একটা বিশেষ দায়িত্ব আছে। সেই দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে গত কয়েক দশকে সৌদি আরব এই বিশাল ও বর্ধিষ্ণু মুসলমান সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক প্রয়োজন মেটানো এবং ইসলামী জাহানের সঙ্গে তার সম্পর্ক জোরদার করার জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। ওই লক্ষ্য অর্জনে দেশটি বিভিন্ন দিক থেকে অগ্রসর হয়েছে। প্রধান কর্মধারাটি হচ্ছে বৃহৎ মুসলিম সম্প্রদায়ের এলাকাগুলোতে মসজিদ ও ইসলামী কেন্দ্র স্থাপন করা। ১৯৮০-এর দশক ও ১৯৯০ এর দশকে এই উদ্যোগ ত্বরান্বিত হয়, যার ফলে সৌদি আরবের অর্থায়নে বিশ্বের সর্বত্র দেড় হাজার মসজিদ ও ২১০টি ইসলামী কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সৌদি উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় আজ অবধি বিশ্বের সর্বত্র আরও অনেক মসজিদ ও ইসলামী কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। এই কেন্দ্রগুলোর কমপ্লেক্সের লক্ষ্য শুধু মুসলিম সমাজের আধ্যাত্মিক চাহিদা পূরণই নয়, উপরন্তু সাংস্কৃতিক ও সামাজিক চাহিদাও পূরণ করা। সাধারণভাবে এসব কমপ্লেক্সের মধ্যে রয়েছে একটি বৃহৎ মসজিদ, ছাত্রদের ক্লাসরুম, একটি পাঠাগার এবং সম্মেলন প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক সেমিনারের জন্য মিলনায়তন এবং সম্মেলন কক্ষ। কেন্দ্রগুলো বিভিন্ন আকারের। হাজার হাজার দর্শনার্থীর স্থান সঙ্কুলানের মতো বিশাল কমপ্লেক্স যেমন আছে তেমনি মুসলমানদের ছোট ছোট গ্রুপের স্থান সঙ্কুলানের মতো ছোট কেন্দ্রও আছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কেন্দ্রগুলো রয়েছে ওয়াশিংটন ডিসি, নিউইয়র্ক, লসএ্যাঞ্জেলেস, সানফ্রানসিসকো, শিকাগো, মাদ্রিদ, লন্ডন, প্যারিস, রোম, বন, ব্রাসেলেস, জেনেভা, টোকিও, টরন্টো, ভিয়েনা, লিসবন, বুয়েনস এয়ার্স ও রিও ডি জেনিরো ইত্যাদি স্থানে। এসব কমপ্লেক্সের মধ্যে নতুনতম দুটি স্থাপিত হয় লসএ্যাঞ্জেলেস এবং স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গে, দুটোই ছিল এই দুই নগরীর মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য মরহুম বাদশাহ ফাহদ বিন আবদুল আজিজের দেয়া উপহার। নতুন দুই স্থাপনার প্রতিটির প্রধান দিকটা হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী ইসলামী স্থাপত্য নকশা অনুযায়ী নির্মিত একটি বিশাল মসজিদ। উভয় কমপ্লেক্সে রয়েছে বৃহৎ ইসলামী কেন্দ্র যেখানে আধুনিক সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা আছে। যেসব জায়গায় মুসলমান সম্প্রদায় বড় নয় অথচ তার পরও একটা আধ্যাত্মিক কেন্দ্র থাকা প্রয়োজন সেখানে সৌদি আরবের অর্থে ছোট ছোট মসজিদ নির্মিত হয়েছে। এমন মসজিদ এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার ১৫০০ স্থানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অনুরূপভাবে বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সম্প্রসারণ ও সৌন্দর্যবর্ধন কর্মসূচী সৌদি আরবের সাড়ে ৩৭ লাখ মার্কিন ডলারের দানের অর্থে বাস্তবায়িত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিপুলসংখ্যক মসজিদ ও ইসলামী কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশকে ২ কোটি মার্কিন ডলার দান হিসেবে প্রদানের জন্য সম্প্রতি একটি রাজকীয় ফরমান জারি হয়েছে। বাংলাদেশে ইসলামী প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সৌদি আরব ছিল সবচেয়ে বড় দাতা দেশ। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে সৌদি আরব বিপুল পরিমাণ আর্থিক, একাডেমিক ও প্রশাসনিক সাহায্যদান নিয়মিত যুগিয়ে চলেছে। বিশ্বের সর্বত্র ইসলামী কেন্দ্র ও মসজিদ প্রতিষ্ঠায় সরাসরি অর্থ যোগানো ছাড়াও সৌদি আরব ইসলামী জাহানের ভেতরে ও বাইরে মুসলমানদের সেবায় নিবেদিত বিরাটসংখ্যক বিশেষ সংস্থা হয় প্রতিষ্ঠা করেছে নয়ত এসব সংস্থার ক্রিয়াকলাপে সাহায্য সহায়তা যুগিয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি), বিশ্ব মুসলিম লীগ। বাদশাহ ফয়সাল ফাউন্ডেশন, বিশ্ব মুসলিম যুব সমাবেশ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যেগুলো সারা বিশ্বের মুসলমানদের সেবায় নিয়োজিত। সৌদি আরব বসনিয়া- হারজেগোভিনার মুসলমানদের জন্য দান সংগ্রহের উচ্চতর কমিটি এবং আন্তর্জাতিক ইসলামী ত্রাণ সংস্থার মতো বিশেষ সংগঠন এবং অসংখ্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানও গঠন করেছে। অনুরূপভাবে সৌদি আরব আফগানিস্তানে গৃহহীন ব্যক্তিবর্গ, এতিম ও বিধবাদের বিপুল পরিমাণ মানবিক সাহায্য যুগিয়েছে। দেশটি বছরের পর বছর ধরে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের শত শত কোটি ডলারের মানবিক সাহায্য দিচ্ছে। বাদশাহ সালমান মানবিক সাহায্য ও ত্রাণ কেন্দ্রে ওই সব ক্ষতিগ্রস্ত ইয়েমেনী জনগণকে সাহায্যের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। দেশটি সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত শরণার্থীদের জন্য নিজের সীমান্ত উন্মুক্ত করে দিয়েছে এবং তাদের সব রকম সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। বর্তমানে সৌদি আরবে সিরীয় শরণার্থীর সংখ্যা আড়াই কোটিরও বেশি। সৌদি আরব ১৯৮৫ সালে মদিনা আল মনোয়ারায় বাদশাহ ফাহদ পবিত্র কোরান মুদ্রণ কমপ্লেক্স ও স্থাপন করে। এখান থেকে পবিত্র কোরানের লাখ লাখ কপি এবং সেই সঙ্গে অর্থসহ বিভিন্ন ভাষায় কোরানের অনুবাদও ছাপা হয়েছে। এ ছাড়া লাখ লাখ অডিও ভিডি ও ক্যাসেটও এখানে রেকর্ড করা হয়েছে এবং মুদ্রিত কোরানের অনুবাদ ও ক্যাসেটগুলো মুসলিম বিশ্বের প্রায় সব দেশে বিনামূল্যে বিরতণ করা হচ্ছে। কাবা শরীফে হজ ও ওমরাহ পালনকারীদের কাছে এবং সারা বিশ্বের মসজিদগুলোতে এগুলো বিনামল্যে বিতরণ করা হয়। মুসলমান সংখ্যালঘুদের সেবা করার ব্যাপারে সৌদি আরবের জাতীয় উদ্যোগের আরেকটি দিক হলো সকল মুসলমানের শিক্ষার ব্যবস্থা। ইসলামী জাহানের বাইরের মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রসার ঘটে চলায় তাদের সন্তানদের জন্য ইসলামী ও আরবী শিক্ষার সুযোগ-সুবিধার বাস্তব প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইসলামী কেন্দ্র ও মসজিদগুলো মুসলিম সমাজের এই চাহিদাটা পর্যাপ্তভাবে পূরণ করছে। দুই দশক আগে সৌদি আরব উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে ইসলামী একাডেমি প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করে। এই পূর্ণাঙ্গ বা পুরোদস্তুর শিক্ষালয়গুলো ওয়াশিংটন ডিসির কাছে এবং লন্ডন, বন ও মস্কোয় অবস্থিত। এগুলোতে ইসলামী শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্বদানসহ আরবী ও স্থানীয় ভাষায় পূর্ণাঙ্গ পাঠক্রম দেয়া হয়। দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া ও স্কটল্যান্ডসহ অন্যান্য জায়গায় ইসলামী একাডেমি প্রতিষ্ঠার জন্য ইতোমধ্যে সমীক্ষা শুরু করে দেয়া হয়েছে। উপরন্তু, সৌদি আরব মুসলমান সংখ্যা গুরু দেশগুলোর এবং মুসলিম সংখ্যালঘু সমাজগুলোর মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের সৌদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যয়নের জন্য বৃত্তি প্রদানের বড় ধরনের উদ্যোগে জড়িত। বর্তমানে সারা বিশ্বে এ ধরনের হাজার হাজার ছাত্র মক্কা, মদিনা, রিয়াদ ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত উচ্চতর ডিগ্রীধারীকে বিশ্বের সর্বত্র প্রকৃত ইসলাম শিক্ষা দেয়ার জন্য দা-ই বা প্রচারক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ওই লক্ষ্যকে আরও এগিয়ে নিতে সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের প্রধান প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী শিক্ষা বিভাগ প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় অর্থ ও সহায়তাও প্রদান করেছে। সর্বাধিক পরিচিত এসব বিভাগ রয়েছে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ল’ স্কুল, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় ও মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে। এসব বিভাগের উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলাম সম্পর্কিত জ্ঞান ও উপলব্ধিকে এগিয়ে নেয়া, ইসলামী কোর্স শিক্ষার ক্ষেত্রে নির্র্ভুলতা ও বস্তুনিষ্ঠতা নিশ্চিত করা এবং ইসলাম ও মুসলিম বিশ্বের ওপর গবেষণায় জড়িত শিক্ষাবিদ ও প্রতিষ্ঠানকে সম্পদ যোগানো। ২০০৭ থেকে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সৌদি আরব বিশ্বের ৫টি মহাদেশের ৭৮টি দেশে ৯৯৯টি প্রকল্পে ৩ হাজার ২শ’ ৬৫ কোটি ডলার বিতরণ করেছে। এই প্রকল্পগুলো আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় সংস্থাসহ ১৫০টি অংশীদার এবং সাহায্যপ্রাপ্ত দেশগুলোর সরকারের দ্বারা বাস্তবায়িত হয়। সৌদি আরবে উন্নয়ন শুরু হওয়ার পর থেকে দেশটি সব দিক দিয়ে মানবতার এবং বিশেষ করে মুসলিম উম্মার কল্যাণে সর্বধাই কাজ করেছে এবং বিপুল অবদান রেখেছে।
×