ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ক্যাসিনো ও জুয়ার বিপুল সরঞ্জাম, নগদ টাকা, মদ উদ্ধার;###;কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ

আরও চার ক্লাবে অভিযান

প্রকাশিত: ১০:১৭, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯

আরও চার ক্লাবে অভিযান

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ রাজধানীর জুয়ার আসর ক্যাসিনো বন্ধের জন্য ক্যাসিনো মাফিয়া চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারের উদ্দেশ্যে ক্লাবগুলোতে অভিযান পরিচালনা করছে পুলিশ। রাজধানী মতিঝিলের আরামবাগ, দিলকুশা, মোহামেডান ও ভিক্টোরিয়া- এই চার ক্লাবে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। উদ্ধার করা হয়েছে ক্যাসিনো ও জুয়ার বিপুল সরঞ্জামাদি, নগদ টাকা ও মদ। রাজধানীর ক্যাসিনো মাফিয়ারা ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা বলে পরিচিত। রাজধানীর বিভিন্ন ক্লাবে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও নেপালের মতো ক্যাসিনো বসিয়েছেন মাফিয়া চক্র। প্রতি রাতে লুটে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। এরই মধ্যে মোটা অঙ্কের অর্থ বিভিন্ন কৌশলে বিদেশে পাচার করেছেন ক্যাসিনোর মাফিয়ারা। রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী ক্রীড়া ক্লাবগুলোতে ক্যাসিনোর আসর বসিয়ে ক্রীড়া সংস্কৃতির বদলে পরিণত করা হয়েছে অপরাধের আখড়ায়। রাতের গভীরতা নামার সঙ্গে সঙ্গে ক্লাবগুলোতে আনাগোনা বাড়তে থাকে অপরাধ জগতের মাফিয়া, ধনীর দুলাল ও সুন্দরী রমণীদের। ক্যাসিনোর মাফিয়ারা বাইরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পরিচয়ের হলেও ক্যাসিনোর আসরে জুয়ার টেবিলে তারা সবাই এক ও অভিন্ন। সরকার পরিবর্তনের পর এরা ভোল পাল্টিয়ে ক্যাসিনোর আসর বসিয়ে মানুষকে নিঃস্ব বানিয়ে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলা গাছে পরিণত হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে এই খবর পান সরকার প্রধান শেখ হাসিনা। এরপরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি নির্দেশ যায়। জঙ্গীবাদ, মাদকবিরোধী অভিযানের মতোই জুয়ার আসর ক্যাসিনো বন্ধে হার্ড লাইন বেছে নিয়েছে সরকার। রবিবার রাজধানী মতিঝিলের আরামবাগ, দিলকুশা, মোহামেডান ও ভিক্টোরিয়া- এই চার ক্লাবে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। উদ্ধার করা হয়েছে ক্যাসিনো ও জুয়ার বিপুল সরঞ্জামাদি, নগদ টাকা ও মদ। এখন এসব মালামাল সিজ করা হয়। কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। ক্যাসিনো পরিচালনায় ও খেলায় জড়িতরা গা ঢাকা দিয়েছে। জুয়ার আসর ক্যাসিনো বসানোর নেপথ্য গডফাদাররা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। রাজধানীর কোন ক্লাবেই এখন আর জুয়ার আসর ক্যাসিনো বসছে না। আর কোন ক্লাবে জুয়ার আসর ক্যাসিনো বসাতে দিবে না পুলিশ। রবিবার দুপুরে রাজধানীর মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় অভিযান পরিচালনা শুরু করে পুলিশ। যেই চার ক্লাবে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে তার মধ্যে দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব ও আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ পাশাপাশি অবস্থিত। এখানে অভিযান চালায় মতিঝিল ও পল্টন থানা পুলিশ। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে একসঙ্গে চার ক্লাবে অভিযান চালানো হয়। আরামবাগ ও দিলকুশা ক্লাবে অভিযান চালানো হয়েছে। অভিযান পরিচালনাকারী একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, বিকেল সাড়ে ৩টায় আরামবাগ ক্লাবে গিয়ে দেখা যায়, আগে থেকেই বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন করা। অন্ধকারে সবকিছু দেখা যাচ্ছিল না। তবে সেখানে ক্যাসিনো চলে সেটা বোঝা যাচ্ছিল। অভিযানের খবর শুনে সবাই পালিয়ে যায়। দিলকুশায়ও কাউকে পাওয়া যায়নি। তবে এসব জুয়া-ক্যাসিনোতে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। রবিবার দুপুরে আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ, দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে একযোগে এই অভিযান শুরুর পর ভিক্টোরিয়া ক্লাব থেকে বিভিন্ন ধরনের জুয়া খেলার নয়টি বোর্ড, এক লাখ টাকা, বিপুল পরিমাণ তাস, জুয়ায় ব্যবহৃত চিপস ও মদ পাওয়া গেছে। মোহামেডানে পাওয়া গেছে দুটো রুলেট টেবিল, নয়টি বোর্ড, বিপুল পরিমাণ কার্ড, ১১টি ওয়্যারলেস সেট ও ১০টি বিভিন্ন ধরনের চাকু। আরামবাগ ও দিলকুশা ক্লাবেও বাকারা, রুলেট, টেবিলসহ বিভিন্ন জুয়ার সরঞ্জাম পেয়েছে পুলিশ। তবে সব ক্লাবই বন্ধ ছিল বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। মতিঝিল বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) আনোয়ার হোসেন বলেছেন, চারটি ক্লাব থেকেই ক্যাসিনো খেলার সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে। মালামাল জব্দ করে পুলিশ। এর মধ্যে শুধু ভিক্টোরিয়া ক্লাব থেকে এক লাখ টাকা ও একটি মদের বোতল উদ্ধার করা হয়েছে। অভিযান চলমান থাকবে বলেও জানান তিনি। তিনি জানান, এখনও কাউকে আটক করা হয়নি, তবে যেভাবে হোক আমরা ক্লাবে ক্লাবে প্রবেশ করে অভিযান চালানো হচ্ছে। এসব ক্লাবে অবৈধভাবে জুয়া, ক্যাসিনো চলত এমন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এই অভিযান। গত সপ্তাহে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে যুবলীগ নেতাদের নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ১৮ সেপ্টেম্বর অবৈধ জুয়া ও ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে র‌্যাবের হাতে আটক হন ঢাকা দক্ষিণ মহানগর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। গত ১৮ সেপ্টেম্বর বুধবার বিকেলে গুলশান ২ নম্বরের ৫৯ নম্বর সড়কে যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া বাসা এবং ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাবে একযোগে অভিযান চালায় র‌্যাব। শাজাহানপুরের রেলওয়ে কলোনিতে বেড়ে ওঠা খালেদ ফকিরাপুলের ওই ক্লাবের সভাপতি। অস্ত্র ও মাদকের পৃথক দুই মামলায় তাকে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। সম্প্রতি ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কয়েকজন নেতার বিষয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারপরই ছাত্রলীগের পদ হারান শোভন-রাব্বানী। এরপর আটক হন খালেদ। ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাবের পাশাপাশি ওই এলাকার ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, বঙ্গবন্ধু এভিনিউর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র এবং বনানীর আহমেদ টাওয়ারে গড়ে তোলা একটি ক্যাসিনোতেও র‌্যাবের অভিযান চলে। গত ২০ সেপ্টেম্বর যুবলীগের অপর আলোচিত নেতা জি কে শামীমকে নিকেতনের নিজ কার্যালয় থেকে আটক করা হয়। একই দিনে র‌্যাবের অভিযান পরিচালিত হয় রাজধানীর কলাবাগান ক্রীড়া চক্র ক্লাবে। আটক করা হয় ক্লাবটির সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজকে। অভিযানের সময় শফিকুলের কাছে সাত প্যাকেট গন্ধহীন হলুদ রঙের ইয়াবাসহ অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এছাড়া জব্দ করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ক্যাসিনোতে খেলার কয়েন, স্কোর বোর্ড ও ৫৭২ প্যাকেট তাস। র‌্যাবের ধারণা, এ ক্লাবে ক্যাসিনো খেলা হতো। ওই রাতেই রাজধানীর ধানমন্ডি ক্লাবে অভিযান চালানো হয়। কিন্তু সেটি বন্ধ থাকায় সেখানে থাকা বারটি সিলগালা করে দেন র‌্যাব সদস্যরা। এ ছাড়া শনিবার র‌্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়, চট্টগ্রামের পাঁচটি ক্লাবে একযোগে অভিযান শেষে তিনটি ক্লাবে জুয়ার আসর চালানোর প্রমাণ পাওয়ার কথা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জুয়ার আসর বসানো ক্যাসিনো ক্লাবের চর্চা হঠাৎ করেই হয়নি, এসব ক্লাবে দীর্ঘকাল ধরেই জুয়ার চর্চা ছিল। বেআইনীভাবে অনুমোদনহীন ক্যাসিনো চালানো হচ্ছিল পুলিশের নাকের ডগায়। দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসোহারা ভিত্তিতে ক্যাসিনোর টাকার ভাগ বাটোয়োরা চলে যেত অসৎ রাজনীতিক থেকে শুরু করে পুলিশ, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজদের পকেটে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে ক্যাসিনোর আসর পেয়েছে উত্তরাধিকার সূত্রে। আশির দশক থেকেই ক্যাসিনো ক্লাবের প্রচলন শুরু হয়। ক্যাসিনোর টাকাই মূলত হয়ে ওঠে ক্লাবের পরিচালন ব্যয় নির্বাহের উৎস। তখন ক্লাবের সংগঠকরা রাজনীতিতে খুব একটা সক্রিয় ছিলেন না বরং ক্লাবগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা ছিল। ফলে খেলাধুলাতেও ক্লাবগুলো বেশ ভাল করেছিল। তখন মূলত ওয়ান-টেন নামে একটি জুয়া হতো, আর ছিল হাউজি। সপ্তাহে কয়েক দিন হতো হাউজি। ক্লাবের বার্ষিক দাতাদের বাইরের বড় আয় আসত এই হাউজি থেকেই। জুয়া হিসেবে তখন ক্লাবগুলোতে হাউজি, ওয়ান-টেন, রামিসহ কিছু খেলা চালু ছিল। আর বোর্ড বা জায়গা ভাড়া দিয়ে অর্থ আয় হতো ক্লাবের। বিগত এক দশকের মধ্যেই বিদেশের মতো বিশাল বড় ফ্লোরে হাজার রকমের জুয়া খেলার যন্ত্রপাতির সমাহার না হলেও স্মট মেশিন কমবেশি সব ক্লাবে পৌঁছে গেছে। প্রশ্ন উঠেছে এতদিন ধরে পুলিশের নাকের ডগায় জুয়ার আসর ক্যাসিনো চলছে? ক্লাবগুলোতে অভিযান পরিচালনার সময়ে সংবাদিকদের এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর দেন মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, যখনই আমাদের কাছে তথ্য এসেছে, তখনই আমরা অভিযান চালিয়েছি। এর আগেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অবৈধ জুয়ার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে বলে ওই পুলিশ কর্মকর্তার দাবি।
×