ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শিরোপা জিততে মরিয়া টাইগাররা

প্রকাশিত: ১২:০২, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯

শিরোপা জিততে মরিয়া টাইগাররা

মোঃ মামুন রশীদ ॥ আফগানিস্তান ‘জুজু’ হয়ে উঠেছিল গোলকধাঁধা। সেই ধাঁধায় বাংলাদেশ দলকে আটকে গত সাড়ে ৫ বছরে টানা ৪ টি২০ ম্যাচে হারিয়ে দেয় তারা। তবে চট্টগ্রামে আফগানদের ‘জিউজিৎসুর’ মারপ্যাঁচ থেকে চলমান ত্রিদেশীয় টি২০ সিরিজের শেষ ম্যাচে বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ দল। মনস্তাত্ত্বিক একটি ‘বাধা’ কাটিয়ে ওঠার পর এখন অনেকটাই আত্মবিশ্বাসী সাকিব আল হাসানের দল। আজ মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ফাইনালে তাই আরেকবার আফগানদের হারিয়ে শিরোপা জেতার স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ দল। এর আগে কখনোই কোন বহুপাক্ষিক টি২০ আসরে চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মাত্র একটিই শিরোপা এসেছে গত মে মাসে। বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে হওয়ার ত্রিদেশীয় ওয়ানডে সিরিজে মাশরাফি বিন মর্তুজার নেতৃত্বে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। এবার সাকিবের নেতৃত্বে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক এবং টি২০-তে প্রথম শিরোপা জেতার সুযোগ। প্রতিপক্ষ আফগানরাও টি২০ ক্রিকেটে শক্তিমত্তায় এগিয়ে থাকায় আত্মবিশ্বাসী ফাইনাল জিততে। বিশেষ করে মিরপুরে স্পিনারদের সুবিধা বেশি হওয়ার কারণে শিরোপা প্রত্যাশী রশীদ খানের দল। ম্যাচটি সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে শুরু হবে। মিরপুরেই আফগানদের বিপক্ষে প্রথমবার টি২০ ম্যাচ খেলেছিল বাংলাদেশ দল ২০১৪ সালের টি২০ বিশ্বকাপে। সেই ম্যাচে প্রতিপক্ষদের ৯ উইকেটে বিধ্বস্ত করে স্বাগতিকরা। কিন্তু এরপর টানা চার ম্যাচ সেই আফগানদের কাছেই হারতে হয়েছে বাংলাদেশ দলকে। এর মধ্যে সর্বশেষ পরাজয়টি ছিল মিরপুরেই। কিন্তু চট্টগ্রামে গিয়ে আফগানদের বিপক্ষে টানা হারের লাগামে রাশ টেনে ধরতে পেরেছে বাংলাদেশ দল। টানা দুই ম্যাচ জিতে এখন অনেকটাই ভারমুক্ত সাকিবরা। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যাটিং ব্যর্থতা। আফগান স্পিনত্রয়ী রশীদ খান, মুজিব উর রহমান আর মোহাম্মদ নবিদের সামনে একেবারেই অসহায় দেখা গেছে ব্যাটসম্যানদের। সেজন্য সিরিজের শুরু থেকেই শিষ্যদের স্পিন সামলানোর দক্ষতা বাড়ানোর কাজ করেছেন প্রধান কোচ রাসেল ডোমিঙ্গো এবং ব্যাটিং কোচ নিল ম্যাকেঞ্জিং। সেক্ষেত্রে সাফল্যটা দেখিয়েছেন অধিনায়ক সাকিব নিজেই। চট্টগ্রামে তার ৭০ রানের ঝড়ো ইনিংস আফগান ‘জুজু’ উড়িয়ে দিয়েছে। সবচেয়ে বড় মনস্তাত্ত্বিক লড়াই যার বিপক্ষে সেই রশিদের বোলিংয়ের বিরুদ্ধেও এক ওভারে ১৮ রান তুলে সাকিব দেখিয়েছেন নিজেদের দক্ষতা ও সামর্থ্য কাজে লাগিয়ে সতর্ক থাকলে বড় কিছু করা যায়। তবে চট্টগ্রামে ছিল ফ্ল্যাট উইকেট, যেখানে স্পিনারদের সুবিধা আদায় করা বেশ কঠিনই। ফাইনাল মিরপুর হওয়াতে তাই আফগান স্পিনারদের নিয়ে আরেকবার ভাবতে হচ্ছে। কারণ, স্পিন স্বর্গ হিসেবে বিশ্বজোড়া খ্যাতি আছে মিরপুরের। সোমবার তাই ম্যাচের আগের দিনও অনুশীলনে ডোমিঙ্গো তার শিষ্যদের স্পিন আক্রমণ সামলানোর রসদ বাড়ানোর প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। আফগানদের যেমন স্পিন শক্তি আছে, বাংলাদেশের স্পিনাররাও কম কার্যকর নয়। আফগান ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে বাংলাদেশী স্পিন তেমন প্রভাব ফেলতে না পারলেও সেটার ওপর এখন পর্যন্ত আস্থা রাখছেন কোচ ডোমিঙ্গো। সোমবার অবশ্য উইকেটে কিছুটা ঘাসের উপস্থিতি দেখে চোখ জ্বলজ্বল করছে এ দক্ষিণ আফ্রিকান কোচের, আশা করছেন ৪ পেসার নিয়ে একাদশ সাজানোর। তবে আজ শেষ মুহূর্তে উইকেট দেখেই সিদ্ধান্তটি চূড়ান্ত করতে চান। সেক্ষেত্রে একাদশের বাইরে ব্যর্থ সাব্বির রহমান চলে যাবেন। আর সব ম্যাচেই দুই পেসার মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন ও শফিউল ইসলাম সফল হয়েছেন। দেরিতে হলেও সফলতা এসেছে মুস্তাফিজুর রহমানের পেস থেকেও। তাই বিশেষায়িত স্পিনার না খেলালেও খুব সমস্যা হওয়ার কথা নয় বাংলাদেশের। কারণ, কার্যকর বাঁহাতি স্পিনার সাকিব আছেন এবং তরুণ আফিফ হোসেন ধ্রুবও টি২০ ক্রিকেটে তার অফস্পিন নিয়ে বেশ কার্যকর তা সর্বশেষ ম্যাচেও আফগানদের বিপক্ষে প্রমাণ করেছেন। তাছাড়া মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত ও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের অফস্পিনে কার্যকারিতা দেখানোর অভিজ্ঞতা তো আছেই। তাই ইনজুরিতে থাকা তরুণ লেগস্পিন অলরাউন্ডার আমিনুল ইসলাম বিপ্লবকে ফাইনালে না দেখা যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এ বিষয়ে কোচ ডোমিঙ্গোই বললেন, ‘সম্ভবত একজন বাড়তি পেসার নিয়ে আমরা ১২ জনের দল গড়ব, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে উইকেট দেখে। আজকে (সোমবার) উইকেটে খানিকটা ঘাস আছে, বাউন্স মিলতে পারে। চার পেসার তাই ভাল বিকল্প হতে পারে। তার (বিপ্লব) বাঁহাতে তিনটি সেলাই পড়েছে। যদিও তার বোলিং হাতে ইনজুরি নয়। তারপরও, কোচ হিসেবে আমি কখনোই এমন কাউকে খেলাতে চাই না, যার কোন ধরনের চোট আছে। আমি সবসময় চাই শতভাগ ফিট ১১ জনকে নিয়ে মাঠে নামতে। আর আমার মতে, আমিনুল বা যে কারও বিকল্প আমাদের দলে আছে। আমার মনে হয় না, হাতে সেলাই নিয়ে ফাইনালে ওকে আমরা খেলতে দেখব।’ আমিনুলের খেলার সম্ভাবনাই তাই একেবারেই ক্ষীণ। সৌভাগ্যক্রমে ফাইনালেই অভিষেক হয়ে যেতে পারে তরুণ উদীয়মান বাঁহাতি ওপেনার মোহাম্মদ নাইম শেখের। নাজমুল হোসেন শান্ত দুই ম্যাচেই চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। তার বদলে নাইম এলেও শান্ত হয়ত সাব্বিরের জায়গায় চলে আসবেন। কিংবা একজন ব্যাটসম্যান কমিয়ে বাড়তি পেসার হিসেবে রুবেল হোসেনকে দেখা যেতে পারে একাদশে। বাংলাদেশ দল এবং সাকিব যে সর্বোচ্চ চেষ্টাই চালাবেন ফাইনাল জেতার সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কারণ, মাশরাফির পর এটাই সাকিবের জন্য মোক্ষম সুযোগ বাংলাদেশকে দ্বিতীয় কোন আন্তর্জাতিক শিরোপা এনে দেয়ার। গত মে মাসে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় ওয়ানডে সিরিজে প্রথমবার বাংলাদেশকে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব উপহার দিয়েছিলেন অধিনায়ক মাশরাফি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেই ফাইনালে খেলতে পারেননি সাকিব। এবার দেশের মাটিতে প্রথম এবং টি২০ ক্রিকেটে প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা হাতছানি দিচ্ছে সাকিবকে। সেই সুযোগ তিনি গত বছর মার্চে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় নিদাহাস টি২০ ট্রফিতে তার নেতৃত্বে ফাইনালে ভারতের কাছে হেরে হাতছাড়া করেছিলেন। অধিনায়ক হিসেবে এটি তার দ্বিতীয় সুযোগ বাংলাদেশকে শিরোপা জেতানোর। ক্যারিয়ারে শিরোপাজয়ী হওয়ার এমন সুযোগ পেয়েও সাকিব তা হারাতে দেখেছেন দলকে। ২০০৭ ওয়ানডে বিশ্বকাপের আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজে বারমুডা ও কানাডাকে নিয়ে হওয়া ত্রিদেশীয় সিরিজে অবশ্য হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বে দুর্দান্ত খেলা সাকিবেই সেরা দল হয়েছিল বাংলাদেশ। তবে সেখানে ট্রফি ছিল না। ২০০৯ সালে দেশের মাটিতে শ্রীলঙ্কা, জিম্বাবুইয়েকে নিয়ে হওয়া ত্রিদেশীয় ওয়ানডে সিরিজে মোহাম্মদ আশরাফুলের নেতৃত্বে ফাইনালে জিততে পারেনি বাংলাদেশ। তবে সিরিজ সেরা হয়েছিলন সাকিব। ২০১২ সালের ওয়ানডে এশিয়া কাপে সিরিজ সেরা নৈপুণ্য দেখিয়েও ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে হার দেখেছেন তিনি। মাশরাফির নেতৃত্বে ২০১৬ সালের টি২০ এশিয়া কাপ ফাইনালে ভারতের কাছে, ২০১৮ সালে দেশের মাটিতে ত্রিদেশীয় ওয়ানডে সিরিজের ফাইনালে শ্রীলঙ্কার কাছে এবং একই বছর সেপ্টেম্বরে ওয়ানডে এশিয়া কাপের ফাইনালে (ফাইনালে সাকিব খেলেননি) ভারতের কাছে হেরে চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি বাংলাদেশ। এর মাঝে ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আগে আয়ারল্যান্ডে হওয়া ত্রিদেশীয় ওয়ানডে সিরিজে মাশরাফির নেতৃত্বেও সাকিব শিরোপার স্বাদ নিতে পারেননি। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে এক ম্যাচ বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত হওয়ায় শিরোপা জেতা হয়নি দুর্দান্ত খেলা বাংলাদেশের। এবার দেশের মাটিতে আফগানদের বিপক্ষে জিতলে অধিনায়ক হিসেবেই সাফল্যটা পাবেন সাকিব। তাতে করে আফগানদের বিপক্ষে বারবার টি২০ ফরমেটে নাজেহাল হওয়ার প্রতিশোধটাও বেশ ভালভাবেই নেয়া হবে। আফগানরা টানা দুই ম্যাচ জিতে দারুণভাবে ত্রিদেশীয় এই টি২০ সিরিজ শুরু করেছিল। টানা ১২ ম্যাচ জেতার বিশ্ব রেকর্ডও গড়ে তারা। কিন্তু চট্টগ্রামে গিয়ে ছন্দপতন ঘটেছে। টানা দুই ম্যাচ হেরেছে তারা। কিন্তু এখনও বাংলাদেশের বিপক্ষে টি২০ ক্রিকেটে ৪-২ ব্যবধানে জিতে থাকা এবং স্পিন শক্তিতে বলীয়ান হওয়ায় আরেকবার জয় পেতে আত্মবিশ্বাসী তারা। অবশ্য মূল বোলিং স্তম্ভ ও অধিনায়ক রশীদের হ্যামস্ট্রিং ইনজুরিতে খেলা নিয়ে সংশয় আছে। কিন্তু সোমবার তিনি নিজেই জানিয়েছেন ১০ ভাগ ফিট থাকলেও খেলতে মরিয়া থাকবেন। আর গ্রুপ পর্বের হার নিয়ে খুব বেশি চিন্তাও করছেন না তারা। নিজেদের মৌলিক কাজগুলো করে বাংলাদেশকে আরেকবার হারাতে চান তিনি। আর মিরপুরে খেলা বলেই বাড়তি আত্মবিশ্বাস পাচ্ছেন তিনি। কারণ এখানে স্পিনের জন্য সুবিধা বেশি। ফেবারিট হওয়ার বিষয়টি নিয়ে রশীদ নিজেই বলেছেন, ‘আমার তাই মনে হয়, বিশেষ করে টি২০-তে গত ৩/৪ বছর ধরে যেভাবে আমরা ক্রিকেট খেলছি। আমরা যদি নিজেদের সেরা ক্রিকেটটা খেলতে পারি বিশ্বের যেকোন দলকেই হারাতে পারি। আমার মনে হয় আমাদের সেই দল এবং মেধা আছে। আমাদের শুধু সস্থির থেকে পারফর্ম করতে হবে। আমার যদি ১০ ভাগ সুযোগ থাকে খেলার, অবশ্যই তা আমি করব। কারণ আমি নিজের দেশকে ভালবাসি এবং আমার দেশটি জিততে চায়।’ উইকেট পেস সহায়ক হলেও সমস্যা দেখছেন না তিনি। রশীদ দাবি করেছেন যেকোন ধরনের উইকেটে খেলার মানসিক প্রস্তুতি রয়েছে তার দলের। টানা দুই হারেও তাই মনোবল বিন্দুমাত্র ভাঙ্গেনি আফগানদের। রশীদ বলেছেন, ‘আমাদের নিজেদের মৌলিক কাজগুলোর ঠিকঠাক রাখতে হবে। আর সেটা আমরা প্রথম দুই খেলাতে বেশ ইতিবাচকভাবেই করেছি। সবচেয়ে জরুরী বিষয় হচ্ছে আমরা এখন ফাইনালে। পূর্ববর্তী পরাজয় কিংবা জয় কখনোই কোন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় না। আমরা যেকোন ধরনের উইকেটে খেলতে প্রস্তুত। এটা টার্নিং হোক কিংবা ফ্ল্যাট।’ এতেই বোঝা যাচ্ছে বাংলাদেশের বিপক্ষে ফাইনালে নামার আগে কতটা আত্মবিশ্বাসী আফগানরা।
×