ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হাওড়ের একদল তরুণের পদক্ষেপ

প্রকাশিত: ১২:৩৪, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯

হাওড়ের একদল তরুণের পদক্ষেপ

সম্প্র্রতি তরুণদের দেশের মধ্যে নানা জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার প্রবণতা এখন আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। ফেসবুকভিত্তিক বিভিন্ন গ্রুপের মাধ্যমে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে জাদুকরী সব দৃশ্যের মোহনীয় রূপ ছড়িয়ে যাচ্ছে। ভিড় করছে আমাদের পর্যটকরা। এমনই এক স্থান সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চল। হাওরের সৌন্দর্য্যে বিমোহিত হয়ে হাজার হাজার পর্যটক প্রতি বছর ছুটে যাচ্ছেন জলমগ্ন সুনামগঞ্জ দেখতে। কয়েকদিনের জন্য তৃপ্তি নিয়ে ফিরে আসছেন ব্যস্ত জীবনে। কিন্তু সারা বছর যারা এই জলমগ্ন পরিবেশে থাকেন তারা আসলে কেমন থাকেন? শহরে বসে উপলব্ধি করা অসম্ভব! আর তাই ভ্রমণের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেদক ছুটেছিল সে সব তরুণের খোঁজে, যারা দিনবদলে ভূমিকা রাখছেন, যাদের স্বপ্নে নতুন করে স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। পানির সঙ্গে যুদ্ধ হাওড়বাসীর নিয়তিতেই যেন লেখা। হঠাৎ বন্যায় সর্বস্ব ভেসে যাওয়া, দুর্গমতা, বিচ্ছিন্নতা এসব নিত্য সঙ্গী হাওড়বাসীর। বছর বছর অকাল বন্যায় ফসলহানি আর নিঃস্ব হওয়াই যেন হাওড়বাসীর নিয়তি। রাতারাতি বন্যায় চোখের সামনে বড় গৃহস্থ পরিবারকে পথের ভিখারিতে পরিণত হতে দেখেছেন হাওড়বাসী। আজকের গল্পটা কাসমির রেজা নামের এক তরুণের। সুনামগঞ্জে বসবাসরত এই তরুণ এবং তার মতো হাওড় এলাকা থেকে বেড়ে ওঠা আরও কয়েক তরুণ সমব্যথী হয়ে উঠছিলেন। কিছু একটা করার তাড়না ঘুরপাক খাচ্ছিল তাদের মাথায়। বছর বছর এভাবে চলতে পারে না! হাওড়ের সঙ্গে তাদের নিবিড় সম্পর্ক। কি করা যায় বা কি করা উচিত সেটাও সম্ভবত তারা জানতেন। তবে ভাবনা শুধু নিজেদের মাথায় থাকলে হবে না। ছড়িয়ে দিতে হবে, ভাবনার বাস্তবায়ন করতে হবে। সেই ভাবনা থেকে ২০১০ সালে তারা গঠন করলেন ‘পরিবেশ ও হাওড় উন্নয়ন সংস্থা।’ শুরুর দিকে সংস্থাটির বড় একটি পর্যবেক্ষণ হল হাওড় এলাকার মানুষজন নিজেদের অধিকার নিয়ে যথেষ্ট সচেতন নয়। প্রতি বছর দুর্যোগের শিকার হতে হতে যেন দুর্যোগকে জয় করার চিন্তা করাও অনেকে ভুলে গেছে। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ঢাকা, সিলেট, সুনামগঞ্জসহ নানা জায়গায় সেমিনারের মাধ্যমে প্রথমে হাওড়বাসীকে সচেতন করে তুলতে শুরু করে তারা। সরকারের শীর্ষ মহল থেকে সাধারণ জনগণের কাছে সংস্থাটি তুলে ধরছে হাওড় সমস্যার কারণ। জানাচ্ছে প্রতিকারের উপায় নিয়েও। ২০১১ সালের শুরুতে টাঙুয়ার হাওড় পাড়ে পৈন্ডুব বাজারে একটি হাওড় সমাবেশ করে সংগঠনটি। সাধারণ জনগণের দাবি সেদিন উচ্চারিত হয়। সমাবেশে উপস্থাপিত হাওরবাসীর নানা পরামর্শ সুনামগঞ্জে একটি সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরা হয়। সংগঠনের পক্ষ থেকে হাওড় সমস্যার সমাধানে একটি হাওড় উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা গ্রহণের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়। মহাপরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করে পরিবেশ ও হাওড় উন্নয়ন সংস্থা। সরকার তাদের মহাপরিকল্পনার ওপর ভিত্তি করে ২০১২ সালে ২০ বছর মেয়াদি একটি হাওড় উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে। চলতে থাকে সংস্থাটির কার্যক্রম। হাওরপাড়ে কৃষক সমাবেশ, হাওর সমাবেশ, মিছিল, মানববন্ধন, সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে প্রতিদিনই উচ্চারিত হতে থাকে। সমাজে সরকারের শীর্ষমহলে পৌঁছাতে থাকে হাওরের দুর্গম এলাকার মানুষের কথা। ২০১৭ সালে হাওরবাসী এই সংস্থার হাত ধরে তাদের দীর্ঘদিনের এক চাহিদার বাস্তবায়ন পায়। সবার দাবির প্রেক্ষিতে ‘কাবিটা নীতিমালা ২০১৭’ নামে নতুন একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু কি আছে এই নীতিমালায়? কেনই বা মানুষের দীর্ঘ চাওয়া ছিল এটি? কাশ্মীর রেজা জানান, ‘প্রতিবারের মতো এই প্রশ্নের একই উত্তর দিতে যাচ্ছি। হাওড় রক্ষা বাঁধ নির্মাণে নীতিমালায় বেশকিছু বিষয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ঠিকাদারি পদ্ধতি বাদ দেয়া। এবার সকল বাঁধ নির্মাণ হয়েছে পিআইসির (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির) মাধ্যমে। স্থানীয় কৃষকদের নিয়ে এই কমিটি গঠিত হয়। নিজেদের ফসল সুরক্ষার দায়ে কৃষকরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেন। যদিও এই প্রথা বাস্তবায়নে কিছু সমস্যা ছিল তবুও এর সুফল আমরা পেয়েছি। আরেকটি পরিবর্তন হল আগে পিআইসিতে স্থানীয় সংসদ সদস্যগণ মনোনীত প্রতিনিধি থাকত। তারা অনেক সময় বেশি প্রভাব বিস্তার করতেন। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী সংসদ সদস্যগণ পিআইসিতে কোন সদস্য মনোনীত করেন না। তবে কাগজপত্রে তারা মনোনয়ন না দিলেও কার্যত তাদের মনোনয়ন ছিল। এতে নীতিমালার বাস্তবায়ন জরুরী। আরও কিছু পরিবর্তন রয়েছে।’ কাশ্মীর রেজা হাওড়ের একটি পরিচিত মুখ। ২০১৯ সালের বর্ষায় তাহিরপুর যাওয়ার পথে মাঝিকে তার কথা জানতে চাইলে উত্তর ভেসে আসলো ‘কে না চিনে তাকে?’ অথচ শুরুর পথটা কিন্তু মসৃণ ছিল না। প্রভাবশালীদের চোখ রাঙানি ছিল নিত্যসঙ্গী। অনেকের মনে প্রশ্ন ছিল এরাও কি সমাজের প্রভাবশালী হয়ে উঠতে চায়? বাঁধা এসেছে প্রতি পদক্ষেপে। সাধারণ মানুষও ছিল দ্বিধায়। তাদের জন্য আজ কাশ্মীর রেজার উত্তর তিনি শুধুই সামাজিক দায়িত্বটা পালন করছেন যেটা তার আগেই অনেকেই করতে পারতেন। গভীর রাতে বাঁধ ভেঙ্গে একরের পর একর ফসল তলিয়ে যাচ্ছে। বাঁধ মেরামতের কেউ নেই। হাওরেরবাসীর ফোন থেকে ডায়াল চলে যায় কাশ্মীর রেজার নম্বরে। সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করেন তিনি এবং তার সহযোগীরা। এই তরুণদের কাছে এক পরম পাওয়া এটা। প্রতিদিনই মানুষ ফোন দিচ্ছেন। ভাল-মন্দ তাদের জানাচ্ছেন। মানুষের স্বার্থে অনেক সময় দাঁড়িয়েছেন অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধেও। মানুষের জন্য কাজ করতে পারছেন- সংগঠনটির গর্ব যেন এখানেই। কাশ্মীর রেজা আরো জানান সমাজের বিত্তশালী ও কর্পোরেট গ্রুপের সাহায্যে হাওড়াঞ্চলের প্রায় দশ হাজার পরিবারকে ত্রাণ সহায়তা প্রদান করেছে তারা। দুই ঈদে প্রায় ২ হাজার শিশুকে নতুন বস্ত্র উপহার দেয়া হয়েছে। হাওরের শীতার্থ মানুষের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ এবং বিনামূল্যে মেডিক্যাল ক্যাম্প করেছি। উল্লেখ্য হাওরে স্বাস্থ্যসেবা বেশ অপ্রতুল। ২০১১ সাল থেকে অর্জন অনেক। হাওড়বাসীর পক্ষ থেকে কাশ্মীর রেজা চান হাওড়ের বাঁধগুলো যেন সময় মত নির্মাণ করা হয়। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে এই বাঁধগুলো রেখে বাকি সময় এদের কেটে ফেলতে হয়। এ ছাড়াও শিক্ষার আলো যাতে ঘরে ঘরে পৌঁছায় সেই প্রত্যাশাও রাখেন তিনি। হাওড় থেকে সমাজের শীর্ষস্থানে পৌঁছানো মানুষরা নিজ অঞ্চলের দিকে নজর ফেরাবে বলেও স্বপ্ন দেখেন তিনি। সমাজ বদলের স্বীকৃতিস্বরূপ পরিবেশ ও হাওড় উন্নয়ন সংস্থা জয়বাংলা ইয়ূুথ অ্যাওয়ার্ড লাভ করে।
×