ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

একশো আটটি মাটির প্রদীপ ও পদ্মফুল নিবেদনে মহানবমী অনুষ্ঠিত

প্রকাশিত: ০৭:০০, ৭ অক্টোবর ২০১৯

 একশো আটটি মাটির প্রদীপ ও পদ্মফুল নিবেদনে মহানবমী অনুষ্ঠিত

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সকাল থেকেই মন্ডপে মন্ডপে বাজে ঢাক। টানা পুরোহিতের মন্ত্রপাঠ, অজ্ঞলি, শঙ্খ, কাসের ধ্বণি, ধূপ, উলোধ্বণী আর চারপাশের যাগযঞ্জ জানান দিচ্ছিল মহাধুমধামেই চলছে মহানবমী। কিন্তু ভক্তদের মুখে যেন বিষাদের ছাপ। মন ভালো নেই কারো। আজ বিজয়া দশমি পূজার মধ্য দিয়ে দূর্গতিনাশিনী দেবী দূর্গা বাপের বাড়ি ছেড়ে যাবেন কৈলাসের দেবালয়ে। তাই বিষাদের সুর যেন সবখানেই। সোমবার মহানবমীতে দুর্গাদেবীর কল্পারম্ভ ও বিহিত পূজা অনুষ্ঠিত হয়। শেষ দিনে রাজধানী সহ সারাদেশের পূজা মন্ডপ গুলোতে ছিল ভক্তদের উপচেপড়া ভীড়। রাজধানীতে মধ্যরাত পর্যন্ত প্রতীমা দর্শন করেন সকল ধর্মের মানুষ। মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির আয়োজনে ঢাকেশ^রী জাতীয় মন্দিরে এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর তিনি সনাতন সম্প্রদায়ের লোকদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় ও প্রতীমা দর্শন করেন। বিভিন্ন পূজা কমিটির উদ্যোগে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আজ দশমীর মধ্যদিয়ে শেষ হবে পাঁচদিনব্যাপী শরোদোৎসবের। বিকাল তিনটায় ঢাকেশ^রী জাতীয় মন্দির থেকে বের হবে বিজয়া শোভাযাত্রা। এপর ওয়াইজঘাট সহ তিনটি স্থানে হবে প্রতীমা বিসর্জন। ‘যেও না নবমী-নিশি, না হইও রে অবসান’ নবমীর দিন এলেই মনে হয়, পূজা তো শেষ। আরমাত্র কিছু সময়। এরপরই বিদায়। দরজায় কড়া নাড়ছে বিজয়া দশমী! মাকে বিদায় দেবার পালা। ‘বিদায়’ কথাটি মন খারাপ করে দেয়ার মতোই। কিন্তু সত্য যে বড়ই কঠিন। তা মেনে নেয়া ছাড়া উপায় কি। আবেগ আর ভালোবাসা দিয়ে তো সবকিছু ধরে রাখা যায় না। কখনও কখনও বুকে চাপা কষ্ট রেখেও সত্যিটা মেনে নিতে হয়। আবার আসবেন মা। এই শান্তনা নিয়েই ভক্তরা নিজেদের হয়ত সামলে নেবেন। শা¯্রজ্ঞরা বলছেন, নবমী পূজার বিশেষ মাহাত্ম্য আছে। নবমীর পূণ্য তিথিতে অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে পৃথিবীতে শুভ শক্তির প্রকাশ ঘটান দেবী দুর্গা। নবমী তিথি শুরু হয় সন্ধিপূজা দিয়ে। অষ্টমীর শেষ ২৪ মিনিট আর নবমীর প্রথম ২৪ মিনিট মোট ৪৮ মিনিটে সন্ধিপূজা হয়। মূলত দেবী চামুন্ডার পূজা করা হয় এসময়। এই ৪৮ মিনিটেই দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন। আর রাবণকে বধ করেছিলেন রামচন্দ্র। শান্তি ফিরে এসেছিল দেবরাজ্যে। নবমীর সূচনাপর্বে সন্ধিপূজা বিশেষভাবে পালিত হয়। একশো আটটি মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে ও একশো আটটি পদ্মফুল দেবীর চরণে নিবেদন করা হয়। পূজা শেষে অঞ্জলিতে ভীড় জমে হাজারো ভক্তের। নবমীর বিশেষত্ব হলো হোমযজ্ঞ অনুষ্ঠান। আঠাশ বা একশো আটটি নিখুঁত বেলপাতা লাগে যজ্ঞের জন্য। বালু দিয়ে যজ্ঞস্থান তৈরি করে তাতে বেলকাঠ সাজিয়ে আগুন জ্বালাতে হয়। বেলপাতাগুলো ঘি এর মধ্যে চুবিয়ে যজ্ঞে দিতে হয়। হোমযজ্ঞের মাধ্যমে অশুভ শক্তির বিনাশ হয়। আশ্বিনের শারদপ্রাতে শুরু হয়েছিল দেবী পক্ষ। মহালয়া থেকে দেবীপক্ষের সূচনা। দুর্গাপূজার আনন্দ মূলত তখন থেকেই শুরু হয়। শাস্ত্র অনুযায়ী, মহানবমী তিথি অন্যান্য তিথির তুলনায় ‘শুভ’। তাই এই তিথিতে দেবীর আরাধনা করলে পূণ্য লাভ হয়। গুলশান বনানী সার্বজনীন পূজা ফাউন্ডেশনের সভাপতি সুবল চন্দ্র সাহা বলেন, নবমী পূজার অঞ্জলী হয়েছে সকাল সাড়ে ১১ টায়। পূজা শেষে প্রসাদ বিতরণ করা হয়েছে। গুলশান বনানী সার্বজনীন পূজা ফাউন্ডেশনের ১২ বছরে পদার্পন উপলক্ষ্যে এবারের আয়োজনে একটু ভিন্নতা আছে। নিরাপত্তাসহ পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পঞ্জিকা অনুযায়ী, আজ সকাল নয়টা ৫৭ মিনিটের মধ্যে দশমী পূজা শেষ হবে। এরমধ্য দিয়ে মাটির প্রতীমায় আর প্রাণ থাকে না। পূজোর শুরুতে মন্ত্রের মধ্য দিয়ে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর বিসর্জনের আনুষ্ঠানিকতা। পুরোহিতরা জানান, দশমী পূজা শেষে ঘট বিসর্জন দিতে হবে। তারপর ভক্তরা মঙ্গল কামনায় মায়ের পায়ে সিঁদুর ও বই ছোয়াবেন। মাকে সিঁদুর দেয়া ও মিষ্টিমুখ করার পর্বও রয়েছে। দশমী দিনে মায়ের বিদায় বেলায় সকলের মঙ্গলার্থে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি বাড়ি ‘যাত্রা’ পাতা হয়। সকালে লাড্ডু, নারিকেল, চিড়া, নাড়– দিয়ে আপ্যায়ন করা হয় সবাইকে। দশমী উপলক্ষে আজ দুপুর ১২টায় ঢাকেশ^রী মন্দিরে স্বেচ্ছায় রক্তদানের আয়োজন করা হয়েছে। এ বছর সারা দেশে ৩১ হাজার ৩৯৮টি ম-পে দুর্গা পূজার আয়োজন করা হয়। যা গতবারের চেয়ে ৪৮৩টি বেশি। রাজধানীতে ২৩৬টিসহ ঢাকা বিভাগে ৭ হাজার ২৭১টি ম-পে এবার পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এছাড়া চট্টগ্রামে ৪ হাজার ৪৫৬টি, সিলেটে ২ হাজার ৫৪৫টি, খুলনায় ৪ হাজার ৯৩৬টি, রাজশাহীতে ৩ হাজার ৫১২টি, রংপুরে ৫ হাজার ৩০৫টি, বরিশালে ১ হাজার ৭৪১টি, ময়মনসিংহে ১ হাজার ৬৩২টি ম-পে দুর্গা পূজার আয়োজন হয়েছে। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, দশভূজা দেবী দুর্গা অসুর বধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতি শরতে কৈলাস ছেড়ে কন্যারূপে মর্ত্যলোকে আসেন। সন্তানদের নিয়ে পক্ষকাল পিতার গৃহে কাটিয়ে আবার ফিরে যান দেবালয়ে। আশ্বিন শুক্লপক্ষের এই ১৫টি দিন দেবীপক্ষ, মর্ত্যলোকে উৎসব। বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা মতে মঙ্গলবার বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে দুর্গোৎসব শেষে বছরের জন্য ‘দুর্গতিনাশিনী’ দেবী ফিরে যাবেন কৈলাসে দেবালয়ে। আট অক্টোবর বিজয়া দশমীর মধ্য দিয়ে পাঁচদিনব্যাপী উৎসবের সমাপ্তি ঘটবে। এদিন বিকাল তিনটায় ঢাকেশ^রী জাতীয় মন্দির থেকে বিজয়া শোভাযাত্রা বের হবে। পরে নগরীর ওয়াইজঘাট, তুরাগ, ডেমরা, পোস্তগোলা ঘাটে হবে প্রতিমা বিসর্জন। সারা দেশে মঙ্গলবার রাত ১০টার মধ্যে নিরঞ্জন (প্রতিমা বিসর্জন) শেষ করার নির্দেশনা দিয়েছে পূজা উদযাপন পরিষদ। বিজয়া শোভাযাত্রার রুট ॥ ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সার্বজনীন দুর্গাপূজা উপলক্ষে বিজয়া শোভাযাত্রা শ্রী শ্রী ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির হতে শুরু হয়ে ওয়াইজ ঘাট গিয়ে শেষ হবে। শোভাযাত্রায় বিপুল সংখ্যক পূর্ণার্থী অংশগ্রহণ করবেন। ফলে শোভাযাত্রার রুট ও তার আশপাশ এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হবে। শোভাযাত্রা চলাকালীন যানজট পরিহারের লক্ষ্যে উক্ত এলাকায় চলাচলরত গাড়ি চালক/ব্যবহারকারীদের বিকাল তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত নি¤েœাক্ত রুট বাদ দিয়ে চলাচলের অনুরোধ করা হয়েছে। বিজয়া শোভাযাত্রার রুটের মধ্যে রয়েছে, শ্রী শ্রী ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির হতে পলাশী বাজার-জগন্নাথ হল-কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার-দোয়েল চত্ত্বর-হাইকোর্ট-সরকারী কর্মচারী হাসপাতাল-গোলাপ শাহ্ মাজার-গুলিস্তান (সার্জেন্ট আহাদ বক্সের সামনে)-নবাবপুর রোড-বাহাদুর শাহ্ পার্ক-পাটুয়াটুলী হয়ে ওয়াইজ ঘাট পর্যন্ত। শোভাযাত্রা চলাকালীন সম্মানিত নগরবাসীকে বিকল্প সড়কে যানবাহন চলাচল করতে অনুরোধ করা হয়েছে। এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ নগরবাসী, যানবাহন মালিক ও শ্রমিকদের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা কামনা করছে। দুর্গোৎসবের অংশ হিসেবে ১৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে লক্ষীপূজা, ২৫ অক্টোবর বিজয়া সম্মিলনের আয়োজন করেছে ঢাকা মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি। ২৭ অক্টোবর শ্রী শ্রী শ্যামাপূজা ও সন্ধ্যায় দিপাবলী। সহস্র প্রদীপ জ্বালিয়ে দীপাবলি উদযাপনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির পক্ষ থেকে।
×