ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মাটি ও মানুষের নিবিড় অনুগামী

প্রকাশিত: ১২:৪৪, ১১ অক্টোবর ২০১৯

মাটি ও মানুষের নিবিড় অনুগামী

গ্রাম বাংলার খেটে খাওয়া মানুষের জীবন সংগ্রামকে রঙতুলির আঁচড়ে তুলে ধরা প্রবাদপ্রতিম শিল্পী এসএম সুলতান। তাঁর চিত্রকর্মের অন্তর্নিহিত শক্তির উত্থান ঘটেছে অত্যন্ত জোরালোভাবে। কৃষি এবং কৃষকের অবয়ব নির্মাণে তিনি যে নতুন ধারা দেখিছেন এর আগে কোন শিল্পী এভাবে কল্পনা করেননি। এ জন্য তাকে কাল্পনিক কৃষি সভ্যতার জনক বলা হয়। সে সময় যখন অন্য শিল্পীরা আধুনিকতার সঙ্গে মিথ মিশিয়ে তথাকথিত এ্যাবস্ট্রাক্ট চিত্র নির্মাণের দিকে ঝুঁকে পড়েন, তখন সুলতান নিম্নবৃত্ত খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের জীবনচিত্রকে সহজ ভঙ্গিমায় কিছুটা দৃঢ়ভাবে দেখিয়ে বিশ্ব সমাজের কাছে প্রমাণ করলেন শিল্পের বিষয়বস্তু এমনই হতে হয়। তাঁর ক্যানভাস জল ও তেল রং এর আঁচড় ছিল গতানুগতিকতার চেয়ে একেবারে আলাদা। এখানেই সুলতানের স্বার্থকতা; পরিপক্কতা। অন্যদের কাছে এটি আধুনিক না হলেও তাঁর কাছে এটি ছিল সর্বাধুনিক। আর এ সত্তা ধারণ ও বহন দুটোই তিনি করেছেন একসঙ্গে। এজন্য অনেকে তাঁকে ছন্নছাড়া, ভবঘুরে, বহেমিয়ান বলে থাকেন। কিন্তু এসএম সুলতান এসব সমালোচনার অনেক উর্ধে। তাই একটি গোষ্ঠী বা শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী এসব সমালোচকদের সমালোচনা তিনি পায়ে পিষে চলেছেন। এদিক থেকে দার্শনিক চিন্তাধারার সর্বোচ্চ চূড়াতে ছিল তাঁর অবস্থান। সহজে বলা যেতে পারে একজন শিল্পীর শৈল্পীক পরিচয় শুধু শিল্পগুণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তাঁর জীবনযাপনও হতে হয় সহজ সরল, সুন্দর ও কোমল। এস এম সুলতান এই জিনিসটি ধারণ করতেন এবং করেও দেখিয়েছেন। তাই তো মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত প্রকৃতি মাটি-মানুষ থেকে কেউ তাকে আলাদা করতে পারেনি। কোন খ্যাতি-যশ প্রভাব প্রতিপত্তি পুরস্কার তাকে এই চেতনা থেকে বের করতে পারেনি। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের যে মধুর সম্পর্ক তিনি এঁকেছেন তাই মনেপ্রাণে ধারণ করেছেন নির্দ্বিধায়। তাঁর ব্যক্তিগত আচার-আচরণ পোশাক-পরিচ্ছদ রং-ঢং এ সেগুলোই প্রকাশ পায়। তিনি শাড়ি, চুড়ি, পায়েল পরে নেচেছেন আপন মনে। কখনও পরেছেন আলখাল্লা বা ফকিরি পোশাক। যেখানে ছবি এঁকেছেন সেখানেই ফেলে চলে এসেছেন। কোন নাম-যশের তোয়াক্কা করেননি কখনও। কলকাতা আর্ট স্কুলের সেরা ছাত্র পরীক্ষা না দিয়ে পলিয়ে যাওয়া; এরপর সিমলা, লাহোর, ইংল্যান্ড, আমেরিকা প্রভৃতি দেশে চিত্র প্রদর্শনীর কৃতিত্ব পুরস্কার, ডকুমেন্ট ভিডিও সবকিছু ফেলে আবার খালি হাতে দেশে ফিরে আসা প্রমাণ করে তিনি মুঠো ভরতে এসব দেশে গমন করেননি। বরং প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য উপভোগের জন্যই তাঁর এ যাত্রা। অবশেষে তাঁর প্রাণ প্রকৃতিতে ভরপুর সেই মাটি মায়ের কাছেই শেষমেশ পদার্পণ। তাঁর এ প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসা ছোটবেলা থেকেই। যখন তিনি লাল মিয়া তখনই চিত্রা নদীর পাড়ে বসে একান্তে ছবি আঁকা, নৌকার পাল তুলে ছুটে চলা, পাখির কল-কাকলির মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন নিজের আসল ঠিকানা। হাতের কাছে যা পেতেন তাই দিয়েই ছবি আঁকতেন। তাই তার ছবি আঁকার উপকরণ হয়েছে কখনো পাতার রস, পুঁইশাক গাছের লাল বীজের রস, পোড়ামাটি, কয়লা, ইটের টুকরা ইত্যাদি। প্রকৃতিকে আঁকতে তিনি যেন প্রাকৃতিক উৎসই বেছে নিয়েছিলেন। মাটি ও মানুষের সঙ্গে একাকার হয়ে মিশে যাওয়া লাল মিয়া শৈশব-কৈশোর-যৌবনের অধিকাংশ সময়ই ব্যয় করেছেন সৃষ্টির সৌন্দর্য উপভোগ করে। কিশোর বয়সে তাঁর এ প্রতিভা নজরে আসা শিক্ষক রঙ্গলালের বড় মেয়ে অররার সঙ্গে লালমিয়ার প্রেমও হয়েছিল। কিন্তু এ সম্পর্ক মাস্টার মশাই না মেনে নিয়ে অররাকে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দেন। এতে লালমিয়া চলে আসেন নড়াইলে। পরে জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সহযোগিতায় এবং বিখ্যাত শিল্পী সমালোচক শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি লাল মিয়া থেকে শেখ মুহাম্মদ সুলতাল হলেন বটে, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির মুখে লাথি মেরে ফিরে গেলেন প্রকৃতির কাছেই আবার। তিনি কাশ্মীরে আদিবাসীদের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন এবং পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্যের ভালবাসায় জড়িয়ে গেলেন। এ সময়ে তাঁর জীবজন্তুর প্রতি ভক্তি ভালবাসা বেড়ে যায়। এখানে অবস্থানকালে তিনি অনেক বিখ্যাত ছবি আঁকেন। সিমলায় প্রদর্শনীতে স্থান পায় বেশ কিছু ছবি। তখন দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ চলছে। তিনি সৈনিকদের ছবি আঁকতেন। পয়সা নিতেন। হিংসা, দলাদলি, সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি তাঁর কাছে কখনও পাত্তা পায়নি। সারাক্ষণ বুদ হয়ে থাকতেন আপন সৃষ্টির মধ্যে। তাই তো তিনি ৪৭ সালের দেশ ভাগ সম্পর্কেও তেমন অবগত ছিলেন না। মিলেটারিদের হাতে ধরা পড়ে জানতে পারেন তিনি পাকিস্তানে ঢুকে পড়েছেন। পাকিস্তানের লাহোরে ছবি প্রদর্শনীর পর ইউরোপে তার চিত্রকর্ম পাবলো পিকাসো, সালভাদোর ডালির মতো বিখ্যাত শিল্পীদের সৃষ্টিকর্মের সঙ্গে স্থান করে নেয়। এভাবে ইংল্যান্ডে আমেরিকায় ছবি প্রদর্শনীর মাধ্যমে তিনি যখন খ্যাতির চুড়ায় পৌঁছে যাচ্ছেন, তখন সবকিছু ছেড়ে দেশে ফিরে আসলেন মায়ের টানে, প্রকৃতির নিজ মাটির টানে। এ জন্যই এস এম সুলতাল তাঁর শিল্প সাধনায় সবার থেকে আলাদা। প্রকৃতি এবং জীবজন্তুর প্রতি তাঁর কী নিঃস্বার্থ ভালবাসা ছিল তা তাঁর বিখ্যাত চিত্রকর্মগুলোতেও ফুটে উঠেছে। তিনি এঁকেছেন মাটি, মানুষ, নারী, শিশু, গাছপালা, জীব-জন্তুর ছবি। জেলে, কৃষক-কৃষাণির অবয়ব। অবয়ব নির্মাণে তিনি গ্রামের কৃষক বউদের দেখিয়েছেন দৃঢ়-বলিষ্ঠ রূপে। এবং তাদের চাষের গরুগুলোকেও অত্যন্ত স্বাস্থ্যবান শক্তিবান হিসাবে দেখিয়েছেন। তিনি মনে করেন প্রকৃতিটাকে সবচেয়ে কাছ থেকে দেখে কৃষক। তাদের অর্থনীতি, জীবন ধারণ সবকিছু প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার। তাঁর ছবিতে বিশ^সভ্যতার কেন্দ্র হচ্ছে গ্রাম আর এই কেন্দ্রের রূপকার হচ্ছেন কৃষক। তাঁর ছবির ধরন সম্পর্কে নিজেই বলেছেন, ‘আমাদের দেশের মানুষ তো অনেক রুগ্ন, কৃশকায়। যে কৃষক সে তো একবারেই রোগা। তার গরু দুটো বলদ দুটো সেগুলোও রোগা। আমার ছবিতে তাদের বলিষ্ঠ হওয়াটা আমার কল্পনার ব্যাপার। মন থেকে ওদের যেভাবে আমি ভালবাসি সেভাবেই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমাদের দেশের এই কৃষক সম্প্রদায়ই এক সময় ব্রিটিশ স¤্রাজ্য গড়েছিল। দেশের অর্থবিত্ত এরাই জোগান দেয়। আমার ছবিতে কৃষকের অতিকায় দেহগুলো থেকে এই প্রশ্ন জাগায় যে ওরা কৃশ কেন? রোগা কেনÑযারা আমাদের অন্ন যোগায় ফসল ফলায়, তাদের বলিষ্ঠ হওয়া উচিত।’ তাঁর ছবিতে প্রাণির অস্তিত্ব ছিল অবধারিত। কারণ জীবজন্তুকে তিনি অত্যন্ত ভালবাসতেন। তিনি মনে করতেন তারা পবিত্র এবং মানুষের চেয়ে মূল্যবান। খেতে বসলে ১০/১২টি বিড়াল কোথা থেকে এসে কোলে চড়ে বসত। সুলতান তাদের খেতে দিতেন যতœ করে। বলতেন এগুলো ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ প্রাণী।’ শিশুদের মতো করে তিনি তাঁর ছোট্ট চিড়িয়াখানার প্রাণীদের সঙ্গে খেলতেন। মাছিমদিয়া গ্রামের লোকজনের মুখে শোনা যায় তিনি যখন পোষা ভল্লুক, খরগোশ, বানর, সাপ, পাখিদের সামনে আসতেন তখন ভয়ঙ্কর সাপও সুলতানের ভালবাসা গ্রহণ করতে উদগ্রীব থাকত। প্রাণী এবং মানুষের মাঝে এমন ভালবাসা হতে পারে; সে অনুভূতি চোখে না দেখলে বর্ণনা করা যাবে না। এমন হয়েছে তিনি যে প্লেটে খাচ্ছেন সেই প্লেটে একসঙ্গে কুকুর ও বিড়াল খেতে শুরু করেছে। তার চিড়িয়াখানায় ভয়ঙ্কর অজগর সাপ কুকুরকে পেঁচিয়ে শুয়ে থাকত এবং কুকুর সাপের শরীর চেটে দিত। তিনি দেশে ফিরে শিশুদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠার কথা ভাবলেন। অনেক পরিশ্রম করে বানালেন চারুপিঠ ও শিশুস্বর্গ। তিনি বিশ^াস করতেন আঁকাআঁকি শিশুদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারলে তারা আর বিপথগামী হবে না। এবং তাদের প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যেতে হবে। এ উদ্দেশ্য তিনি ১২ লাখ টাকা ব্যয় করে একটি বড় নৌকা তৈরি করেন। এই নৌকায় করে যেন নদীপথে বিভিন্ন স্থান ঘুরে ছবি আঁকতে পারে শিশুরা। তিনি যখনই সুযোগ পেতেন সব ছেড়ে এক ফ্লাক্স গরম চা ভরে চলে যেতেন রাস্তা পেরিয়ে দিগন্ত জোড়া মাঠ-পান্তরে। কারও সঙ্গে কথা না বলে একমনে দেখতেন প্রকৃতির রূপ রহস্য। নড়াইলের পুরাতন জমিদার বাড়ী পরিষ্কার করে সাপ পোকা জীবজন্তুর সঙ্গে ঘুমিয়েছেন। কখনও তাকে পাওয়া গেছে খড়ের গাদায়। কখনও কুকুরের সঙ্গে শুয়ে থাকতে দেখা গেছে। একা আনমনে বাঁশি বাঁজাতে বাঁজাতে গাছতলাতেই রাত পার করে দিয়েছেন। এজন্য স্থানীয় লোকজন তাকে ঐশ^রিক ক্ষমতাসম্পন্ন পীর বলেও ধারণা পোষণ করত। একান্ত লোকচক্ষুর আড়ালে যখন এস এম সুলতান একাকী চালিয়ে যাচ্ছেন তার শিল্পসাধনা। তখনও এদেশের মানুষ তাকে চিনেনি। তার কিছু ভক্তদের মাধ্যমে প্রথম শিল্পকলায় তাঁর আঁকা ছবি প্রদর্শনীর আয়োজন হলো। তাঁর ছবির অদ্ভুত অবয়ব ও নির্মাণ কৌশল সবার নজর কাড়ে। বিশেষ করে বাঙালীত্বের যে চেতনা ধারণ করা আমাদের প্রয়োজন তার সবটুকু খুঁজে পাওয়া যায় সুলতানের চিত্রের মধ্যে। কিন্তু তিনি সারাবিশ^ দাঁপিয়ে বেড়ানো এ মানুষটি নিজ দেশের মানুষের কাছে একেবারে জীবনের শেষদিকে পরিচিত হবেন এটা সত্যিই এদেশের জন্য লজ্জার। যার সম্পর্কে জার্মান নোবেল বিজয়ী গু-ার গ্রাস মন্তব্য করেন, এসএম সুলতানকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ হয় না। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য! অনেক পরে তাঁকে স্বীকৃতি দিলো এদেশের মানুষ। তবে তিনি তো ছিলেন সম্পূর্ণ প্রচারবিমুখ একজন মানুষ। জীবনে সব স্বীকৃতিকে পদদলিত করে করে যিনি মানবতার জয়গান নিয়ে প্রকৃতি মাটি ও মানুষের সংস্পর্শে থাকতে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেছেন তিনিই আমাদের গর্ব এস এম সুলতান। তিনিই প্রকৃত শিল্পী, শ্রষ্ঠা একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। তাইতো শেষ জীবনে পরিপূর্ণতা নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেনÑ আমি সুখী। আমার কোন অভাব নেই। সকল দিক দিয়ে আমি প্রশান্তির মধ্যে দিন কাটাই। আমার সব অভাবেরই পরিসমাপ্তি ঘটেছে।
×