ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চক্করে চক্করে বালিখলা

প্রকাশিত: ১২:৫১, ১১ অক্টোবর ২০১৯

চক্করে চক্করে বালিখলা

উড়ন্ত মনে যতসব বাড়ন্ত ভাবনা। সেই ভাবনা থেকেই ঠিক করলাম, এবার মোটর বাইকে চড়ে ৬৪ জেলার নানা প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো দেখব। তারিখটি ছিল ১০ আগস্ট। সঙ্গী দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের সদস্য মারুফ। সকাল প্রায় পৌনে নয়টায় এ্যাভেঞ্জার বাইক স্টার্ট। সাভার, আশুলিয়া হয়ে বাইক ছুটছে নরসিংদী। ডগ ট্যুরিস্ট হিসেবে খেতাব পাওয়া, ছোট ভাই রুহেল আমিনের ম্যাপ মোতাবেক আমাদের এই ভ্রমণ শুরু। গাজীপুর, নরসিংদী হয়ে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার মুড়াপাড়া জমিদার বাড়িতে কষে একখান ব্রেক। মানে পুরো বাড়িটা সময় নিয়ে দেখব। প্রথম দর্শনেই চোখ জুড়িয়ে যায়। বাড়ির পুরো দেয়াল জুড়ে দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য। সামনে-পিছনে রয়েছে শাণবাধাঁনো পুকুর। ১৮৮৯ সালে জমিদার রাম রতন ব্যানার্জী এই বাড়িটির নির্মাণ শুরু করান। আর শেষ করেন তার নাতি ১৯০৯ সালে। জমিদার বাড়িতে রয়েছে শতাধিক কক্ষ। আরও রয়েছে বিশাল উঠোন। ৪০ একরের জমিদার বাড়িটি এখন, মুড়াপাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাড়ির সামনে যতটা আকর্ষণীয়, ঠিক তার উল্টো পিছনের অংশটা। দিনের আলোতেই ভূতুড়ে পরিবেশ। জরাজীর্ণ ভগ্নদশায় থাকা ইমারতে, খানিকটা সময় ফটোসেশন। অতঃপর স্থানীয় কিশোর-তরুণদের সঙ্গে কিছুক্ষণ আড্ডা মেরে, আবারও ছুটে চলা। আমি আর মারুফ যৌথ রাইডার। পোড় খাওয়া সরলমনা ছেলেটার ওপর, আমার যথেষ্ট আস্থা রয়েছে। তাই ওঁ চালালে আমি নিশ্চিত মনে বসে থাকতে পারি। বাইক চলছে। যে পথে যাই, সেই পথে না ফিরে অন্য পথে চলি। এতে ভ্রমণের মজাই আলাদা। নতুন কিছু দেখা ও চেনা যায়। চলতে চলতে রূপগঞ্জের ফেরিতে ভেসে, তিনশ ফিট পেরিয়ে জিন্দা পার্কের সামনে। স্থানীয় এক মসজিদে জহুর নামাজ আদায় করে, বসে যাই পথের পাশে এক ঝুপড়ি হোটেলে। লাকড়ির চুলোয় রান্না করা। ভাত-ভর্তা, ডাল, গোস্ত আর বাইম মাছ। স্বাধের কথা আর নাই লিখলাম। জাস্ট ৫জনের ভাত দু’জনেই সাবাড়। গলা পর্যন্ত খেয়ে কোমল পানিয়র বোতলে চুমুক দিই। হাল্কা বিশ্রামের সুযোগে, ফেসবুক ওপেন করতেই পেয়ে যাই কিশোরগঞ্জের তরুণ লেখক তরিকুল ইসলামকে। নক করতেই রিপ্লাই। মুহূর্তেই মাওয়া যাবার সিদ্ধান্ত বাতিল করে কিশোরগঞ্জের পথে। বাইক রাইডে এখানেই মজা। মনের চাহিদা, পুরোটাই নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে। কালীগঞ্জ, মিরের বাজার, রাণীগঞ্জ, কাপাসিয়া, বিন্নাটির মোড় পেরিয়ে কিশোরগঞ্জ শহরের একরামপুর। তরিকুলের সঙ্গে দেখা হয়নি কখনও। কিন্তু নিবিড় ভালবাসার টানে, সে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরের গ্রাম মরিচখালী হতে রিসিভ করতে এসেছে। আগে জানলে নিশ্চিত তাকে ফাঁকি দিয়ে, অন্য পথ ধরতাম। আমাদের পেয়ে সে মহা খুশি। প্রায় ১৫ শত বছর আগেই তো লিখা রয়েছে, আখেরি জামানায় আপন হবে পর আর পর হবে আপন। থাক সেসব অমূল্য বাণী। ঘুরতে এসেছি ঘুরি। প্রথমেই গেলাম গুরুদয়াল কলেজের সামনে থাকা মুক্ত মঞ্চে। রাতের আঁধারে যতটুকুন বুঝলাম, পড়ন্ত বিকালে এখানে ঘুরার মজাই হবে ভিন্নরকম। এরপর যাই, জেলার ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ। এশার নামাজটা সেখানেই আদায় করে নিই।প্রায় আড়াইশত বছরের পুরনো, চমৎকার সৌন্দর্যের একটি মসজিদ। নরসুন্দা নদীর তীরে মসজিদটি অবস্থিত। পাগলা মসজিদটিকে দেশের সবচাইতে ধনী মসজিদও বলা হয়। কারণ এর দান বাক্স হতে কোটি টাকা পর্যন্ত মিলে। দিনের আলোর চাইতে পাগলা মসজিদ, নিঃসন্দেহে রাতের ঝলকানো বাতিতে আরও অনেক বেশি দৃষ্টিনন্দন। তবে সেটা শরীয়াহ সমর্থন করে কিনা তা যথেষ্ট প্রশ্নবোধক। ঘুরেফিরে আবারো লেখায় আসে ভাবগাম্ভীর্য বয়ান। না এসেই বা উপায় কি! ঘুরতে গিয়ে আমি বিনোদনের পাশাপাশি, যাপিতজীবনের ওপর শিক্ষা লাভেরও চেষ্টা করি। ভ্রমণ হল একটি বই। যে বইটি মনোযোগ দিয়ে পড়লে, জীবনটাকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা যায়। ইতোমধ্যে বত্রিশ এলাকার আরেক ভ্রমণ পাগলা আলমগীর অলিক এসে হাজির। দেখা হয়নি কখনও কিন্তু মহব্বতে গদগদ। ঠিক এই জায়টাতেই মনে হয় আমার জীবনের সফলতা। নরসুন্দা নদীর তীরে সব ভ্রমণ পাগলা আড্ডা দিয়ে,যাচ্ছি এবার তরিকুলের বাড়ি। শহরের যানজট পিছনে ফেলে সাদকখালী সড়কে যখন গেলাম, তখন রিতীমত কান্না পাচ্ছিল। সারাদিনের ধকল, তার ওপর এখন ভাঙ্গা সড়ক। ২০ মিনিটের সড়ক আর শেষ হয় না। ভাবতেই বেশ কষ্ট হচ্ছিল, প্রাণবন্ত রাষ্ট্রপতির জম্মভূমি সড়কের এতটা বেহাল দশা। বাড়ি পৌঁছে, জম্পেশ খানাদানা শেষে এক ঘুম। পরদিন ফজর পরেই ভাগি। গন্তব্য ধনু নদীর তীর বলিখেলা। সঙ্গী এবার লেখক মুস্তাফিজ মারুফসহ ছয়জন। গ্রামের পথ ধরে বাইক চলে। চামড়া বন্দর ক্রস করে বলিখলা সড়কে যেতেই, আনন্দে চোখেমুখে হাসির ঝিলিক। বিশাল জলরাশীর মাঝে পিচ করা সড়কে এগিয়ে যাই। বাতাসের ঝাপটা এসে ক্লান্তি দূর করে। যতদূর চোখ যায়, শুধু পানি আর পানি। বাইক পার্ক করে ট্রলারে চড়ি। ভেসে ভেসে বেড়াই করিমগঞ্জের বলিখলা হাওড়, মিঠামইন হাওড়, ইটনার শিমুলবাগ। বর্ষায় গ্রাম-বাংলার হাওর, সমুদ্রের সৌন্দর্যের চাইতেও কম নয়। দেখা হয় সাদাসিধে মানুষ দেশের মহামান্যর বাড়ি। খনিকের জন্য হেঁটে বেড়াই, যতটুকুন জেগে থাকা সাব-মার্সিবেল সড়কে। এসব রাস্তা বছরের ৬ মাস পানির নিচে থাকে। হাওড় জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দে, প্রখর রৌদ্রও হার মানে। চরম তাপমাত্রা উপেক্ষা করেও হাওড়ের বিশুদ্ধতায় মুগ্ধ হই। ভাললাগে আপন মনে জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য। যাত্রীবাহী ট্রলার ছুটে চলে তার গন্তব্যে। ভরা বর্ষায় হাওরাঞ্চলের গ্রামগুলো, মূল ভূখ- হতে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দূর থেকে তখন একেকটি গ্রাম দ্বীপের মতো দেখা যায়। তেমনি একটি গ্রাম বজকপুরে নোঙ্গর গাড়ি। পরিচিত হই তাদের যাপিত জীবন সম্পর্কে। মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়াটাও একটা ভ্রমণ অনুষঙ্গ। এরপর ইটনার শিমুলবাগ হিজল বনে যাই। দূর থেকে মনে হয়, এ আরেক সোয়াম্প ফরেস্ট। টইটুম্বুর পানির বুকে, চকচকে গাঢ় সবুজ পাতার - হিজল গাছের মাথাগুলো জেগে আছে। নয়নাভিরাম নৈসর্গিক এক পরিবেশ। শত হিজলের মেলায়, নজরকাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। ঝিরঝির বাতাসে পানির ঢেউয়ে ট্রলার দোলে। সেই সঙ্গে দোলে আমাদের মন। একটা সময় লাফিয়ে পড়তে চাই, ডুব সাঁতারে মেতে উঠব বলে। কিন্তু মাঝির সাবধান বাণী। কি আর করা। ভ্রমণে আর অতি উৎসাহী হওয়া যাবে না। মাঝিকে ক্যাপ্টেন মেনে, ফিরতি পথে ছুটি। চলেন যাই : ঢাকার মহাখালী ও সায়েদাবাদ হতে কিশোরগঞ্জগামী এসি/নন এসি বিভিন্ন পরিবহনের বাস সার্ভিস রয়েছে। ভাড়া ২২০/= হতে ৪০০/= টাকা। এছাড়া ট্রেনে চড়েও যাওয়া যাবে। কমলাপুর হতে সকাল ৬টা ৩০ মিনিট হতে ১০টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত তিনটি ট্রেন ছেড়ে যায়। দুপুরেও ট্রেন আছে। তবে দিনে দিনে ফেরার জন্য সকালের ট্রেনে যাওয়াই ভাল। শহর হতে করিমগঞ্জের রৌহা মোড় পর্যন্ত সিএনজি যায়। সেখান থেকে অটোতে বলিখেলা। ট্রলার ভাড়া তিন ঘণ্টার জন্য ভাড়া নেবে ১০০০ টাকা হতে ১২০০ টাকা। দরদাম করে নেয়াটাই উত্তম হবে। থাকবেন-খাবেন কোথায় : সকাল-সকাল গেলে থাকার প্রয়োজন নেই। তারপরেও থাকতে চাইলে, শহরে বেশ কিছু ভালমানের থকা খাওয়ার হোটেল রয়েছে। সতর্কতা : যারা মোটরবাইকে যেতে ইচ্ছুক, তারা অবশ্যই বাইক রাইডের- সেফটি গার্ড ব্যবহার করবেন। ভ্রমণ তথ্য :- হাওড়ে আরও এক পক্ষকাল পানি থাকবে।
×