ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মো. জোবায়ের আলী জুয়েল

শরত ঋতু শিউলি ফোটার দিন

প্রকাশিত: ১৩:০৩, ১১ অক্টোবর ২০১৯

শরত ঋতু শিউলি ফোটার দিন

বর্ষা শেষে যখন বৃষ্টির মাত্রাটা একটু কমে আসে, আকাশে ঘন কালো মেঘের বদলে তুলোর মতো সাদা মেঘদল ঘুরে বেড়ায়, ঝক ঝক আকাশের উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে, তখন আমরা বুঝতে পারি শরত এসেছে। শিশির স্নাত উজ্জ্বল শারদ প্রভাতে ঝরা শেফালীর মদির সুবাসে আকাশ বাতাস ভরপুর। তাই কবি বলেন- আজিকে তোমারে মধুর মূরতি হেরিনু শারদ প্রাতে হে মাতঃ বঙ্গ শ্যামল অঙ্গ ঝলিছে অমল শোভাতে। প্রকৃতির পালা বদলের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনও বদলে যেতে থাকে। বর্ষার বৃষ্টিমুখর অনুজ্জ্বল দিনের পর শরতের মেঘের মতো আমাদের মনও যেন হালকা হয়ে যায়। শরতের দিনগুলোকে স্বপ্নের মতোই মনে হয়। চারপাশে অনেক স্বপ্ন ছড়িয়ে আছে। আমরা সে সব স্বপ্ন কুড়িয়ে নিয়ে নানা কিছু ভাবতে বসি। আমাদের ভাবনাগুলোকে সতেজ করে শরতের শুভ্রতা। কেনো শরত সাদা বা শুভ্র? শরত এলেই যে কাশ আর শিউলি ফুল ফোটে, আর আকাশে ভেসে বেড়ায় পেঁজা তুলোর মতো তুলতুলে সাদা মেঘ। শরতের আকাশে, শরতের নদীতে, শরতের ফুল সবকিছুই কেমন মায়াময়। শরতের এই শুভ্র রূপ পবিত্রতার প্রতীক। বিলের শাপলা, নদী তীরের কাশ ফুল, আঙিনার শিউলি, এরা সবাই কোমল পবিত্র। দেখলেই মন ভাল হয়ে যায়। যখন শিশিরের শব্দের মতো টুপ টাপ শিউলি ঝরে তখন শরতের গন্ধ পাই। কাশবনে দলবেঁধে আসে চড়ুই পাখিরা। এ ভাবে শুরু হয় শরতের যাত্রা। শরতের এই স্নিগ্ধ শোভাকে আরও মোহময় করে এ মৌসুমের বিচিত্র ফুলেরা। নদী কিংবা জলার ধারে ফোটে কাশ-ফুল, ঘরের আঙিনায় ফোটে শিউলি-শেফালী, খাল-বিল-পুকুর ডোবায় থাকে অসংখ্য জলজ ফুল। আর শেষ রাত্রের মৃদু কুয়াশায় ঢেকে থাকা মায়াবি ফুলের যেন আরও রূপসী হয়ে ওঠে। শিশির ভেজা শিউলি, বাতাসে মৃদ দোল খাওয়া কাশবনের মঞ্জরি পদ্ম-শাপলা-শালুকে আচ্ছন্ন জলাভূমি শরতের চিরকালীন রূপ সত্যিই বিচিত্র রূপ নিয়ে শরত আমাদের চেতনায় ধরা দেয়। আমাদের অন্যান্য ঋতুগুলো অনেক ফুলের জন্য বিখ্যাত হলেও মাত্র কয়েকটি ফুল নিযেই শরত গরবিনী। কাশ-শিউলির শোভা উপভোগ করতে হলে আমাদের শরতের কাছেই যেতে হবে। শরত মানেই একধরনের ভাললাগা, এই সুখ বা আনন্দ একেবারেই আমাদের নিজস্ব। শরত মানেই শিউলি ফোটার দিন। শিউলির মধু গন্ধ ভেসে বেড়ানোর দিন। শিউলির আরেক নাম শেফালী। শেফালী ফুলকলিরা মুখ তোলে সন্ধায়। তাই শরতের রাত শিউলির গন্ধে ভরপুর। সূর্যের সঙ্গে এদের আড়ি, নিশি ভোরেই ঝরে পড়ে মাটিতে। শরতের শিউলি তলা শিশুদের খুবই প্রিয়। ফুল কুড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লেও ফুল যেন শেষ হতে চায় না। এর পাপড়িরা বহুক্ষণ গন্ধ বিলায়, বোঁটার হলুদ রং টিকে থাকে বহুদিন। শিউলির মালা দিয়ে ঘর সাজানো যায়্ আর শিউলির মালা খোঁপায়ও পড়া যায়। প্রাচীনকালে এর বোটার রং পায়েস বা মিষ্টান্নে ব্যবহার করা হতো। হিন্দুদের পুজার উপকরণ হিসাবে এর কদর অনেক। এছাড়াও শিউলির আছে অনেক ঔষধিগুণ। কবিরাজরা গাছের বিভিন্ন অংশ ওষুধ তৈরিতে কাজে লাগান। শরতের সকালে একটু একটু শীত অনুভূত হয়। হেমন্ত পেরিয়ে শীত আসবে এ যেনো তারই পদধ্বনি। কুয়াশার রহস্য জাল কাটিয়ে চন চনে রোদ আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে আকাশে, সবুজ শস্য ক্ষেতে ঝলমলে রোদ এসে মিষ্টি চুম্বন এঁকে দেয়। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ খুব চমৎকার ভাষায় শরতের রূপকল্প তুলে ধরেছেন তার গানে- আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরির খেলা, আকাশে আজ কে ভাসালো সাদা মেঘের ভেলা। শরত উৎসবের ঋতু। শরতের বহুমাত্রিক রূপের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য হয়ে আছে গ্রাম বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের আবহমান কালের দুর্গাপূজা। শরতের স্নিগ্ধ রূপ আমাদের সাহিত্যেও ঠাঁই করে নিয়েছে। শারদ সকালের অপূর্ব সৌন্দর্য নিয়ে লেখা হয়েছে বহু কবিতা, বহুগান, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের অনেক কবিতা ও গানে, জীবনানন্দ দাশের কবিতায় শরতের স্নিগ্ধ শোভা অপূর্ব সৌন্দর্যে চিত্র রূপ ময়তা পেয়েছে। আবহমান বাংলার চিরায়ত রূপে শরতকালের স্নিগ্ধ সকাল জাগায় ভিন্ন ব্যঞ্জনা, যা অমলিন, অবিনশ্বর। শরতের স্তব্ধতা ঘুমপাড়ানি গানের মতো শান্ত, মধুর। নদীতে পালতোলা নৌকা, আকাশে পালতোলা মেঘ। প্রকৃতিতে সাদা কাশফুলের মেলায় মনটা কেবল উদাস হয়ে যায়। এ যেন শরতের এক স্নিগ্ধ স্বপ্নের জগত। শেষ লগ্নে শরত আবার কানে কানে বলে যায় আবার আসব এক বছর পরে-তোমাদের আঙ্গিনায় শিশির ভেজা শিউলি আর কাশ ফুলের বন্যা নিয়ে।
×