ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জৈবিক বা অন্তর্গত নানা কারণে মানুষ বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হতে পারে

প্রকাশিত: ০২:০৫, ১১ অক্টোবর ২০১৯

জৈবিক বা অন্তর্গত নানা কারণে মানুষ বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হতে পারে

অনলাইন ডেস্ক ॥ বাংলাদেশের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে ঢাকা পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গেছে শিশু কিশোরদের আঠার শতাংশের বেশি বিষণ্ণতায় আক্রান্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ধারণা ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বে আর্থ সামাজিক ক্ষেত্রে বড় সংকটের তৈরি করতে যাচ্ছে এই বিষণ্ণতা। গবেষক ও চিকিৎসকরা মনে করে সাধারণভাবে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন তার জীবদ্দশায় কখনো না কখনো বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন বা হতে পারেন। বিষণ্ণতা আসলে কি? বিষণ্ণতাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ শুরুতেই এর প্রতি যথাযথ দৃষ্টি না দিলে এ থেকে গুরুতর সমস্যা তৈরি হতে পারে। মনঃচিকিৎসক মুনতাসীর মারুফ বলছেন বিষণ্ণতায় আক্রান্তদের মধ্যে পনের শতাংশের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হয়ে থাকে। তবে বিষণ্ণতা বলতে অনেকে মন খারাপকে বুঝে থাকেন। মনোবিদ ডা: মেখলা সরকার বিবিসিকে বলছেন বিষণ্ণতা মানুষের মনের একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। একজন মানুষের কোনো বিষয়ে প্রত্যাশা পূরণ না হওয়া বা এ ধরণের নানা কারণে মন বিষণ্ণ হতেই পারে। "কিন্তু যখনি রোগ হবে সেটা একটু ভিন্ন। বিষণ্ণতা হতে পারে বিভিন্ন মাত্রা কিংবা গভীরতায়। মনে রাখতে হবে টানা দুই সপ্তাহ মন খারাপ থাকা বা আগে যেসব কাজে আনন্দ লাগতো সেসব স্বাভাবিক কাজগুলোতে আনন্দ না পাওয়ার মতো হলে এটিকে বিষণ্ণতার লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।" ডা: মুনতাসীর মারুফ বলছেন একজন মানুষের মধ্যে যে কোনো আবেগ গত পরিবর্তন অনেক দিন ধরে দেখা যাচ্ছে এবং সেটা দৈনন্দিন কাজকে প্রভাবিত করছে তখনি আপনাকে সতর্ক হওয়া উচিত। বিষণ্ণতার লক্ষ্মণ কোনগুলো : আমেরিকান সাইক্রিয়াটিক এসোসিয়েশন বিষণ্ণতার নয়টি লক্ষ্মণ উল্লেখ করে বলেছে কারও মধ্যে এর মধ্যে অন্তত পাঁচটি টানা দু সপ্তাহ বা তারচেয়ে বেশি সময় দেখা গেলে সেটি বিষণ্ণতা হতে পারে। এগুলো হলো: দিনের বেশির ভাগ সময় মন খারাপ থাকা যেসব কাজে আনন্দ পেতো সেসব কাজে আনন্দ ও আগ্রহ কমে যাওয়া ঘুম অস্বাভাবিক কম বা বাড়তে পারে খাবারে অরুচি তৈরি হওয়া বা রুচি বেড়ে যাওয়া ওজন কমে যাওয়া কাজে ও চিন্তায় ধীরগতি হয়ে যাওয়া নিজেকে নিয়ে নেতিবাচক চিন্তা করা বা নিজেকে দায়ী মনে হওয়া সবকিছুতে সিদ্ধান্তহীনতা বা মনোযোগ কমে যাওয়া এবং খুব তীব্র হলে আত্মহত্যার চিন্তা পরিকল্পনা ও চেষ্টা করে ডা: মেখলা সরকার বলছেন প্রতিক্রিয়া দুভাবে হতে পারে যেমন ঘুমের সমস্যার ক্ষেত্রে কারও ঘুম কমে যেতে পারে আবার কারও ঘুম বেড়েও যেতে পারে, আবার কারও ছাড়াছাড়া ঘুম হতে পারে। "আবার দেখা যাচ্ছে ঘুম হচ্ছে কিন্তু ঘুম থেকে যে শক্তি আসার কথা শরীরে তা না এসে উল্টো ক্লান্তি অনুভূত হচ্ছে। সেটিও বিষণ্ণতার লক্ষ্মণ হতে পারে।" তিনি বলেন অনেকের ক্ষেত্রে খাবারের স্বাদে পরিবর্তন হয়। ফলে খাবার বেড়েও যেতে পারে, তেমনি আবার কমেও যেতে পারে কিন্তু সব মিলিয়ে শরীরের ওজন কমে যায় অনেকের ক্ষেত্রে। কেউবা আবার মুটিয়ে যায়। "বিষণ্ণতার কারণে হতাশা বোধ হয়। মনে হয় যে সামনে ভালো কিছু নেই। নিজের সব কিছু নেতিবাচক মনে হতে পারে। তার দ্বারা ভালো কিছু হবেনা মনে হয়। অর্থাৎ আত্মবিশ্বাস কমে যায়। আর এসব তার দৈনন্দিন জীবনাচরণে প্রভাব ফেলে"। এর বাইরেও কিছু লক্ষ্মণের কথা চিকিৎসকরা বলে থাকেন যার মধ্যে রয়েছে- নানা ধরণের শারীরিক উপসর্গ দেখা দেয়া, হাত পা জ্বালা পোড়া করা, কান দিয়ে গরম ধোয়া বের হওয়ার অনুভূতি কিংবা ভীষণ মাথা ধরা এবং কোষ্ঠকাঠিন্য। মেখলা সরকার বলেন আসলে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হলে জীবন ধারণ বোধটাই কঠিন হয়ে যেতে থাকে যেটি ব্যক্তির মধ্যে ধীরে ধীরে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি করে। বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হওয়ার নির্দিষ্ট বয়স আছে? ডা: মেখলা সরকার বলছেন যে কোনো বয়সেই বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। "প্রাপ্ত বয়স্কদেরই বেশি দেখা দেয়। তবে যে কোনো বয়সী মানুষ এতে আক্রান্ত হতে পারেন পারিপার্শ্বিক নানা কারণে।" জেলা পর্যায়ে একটি হাসপাতালে কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে ডা: মুনতাসীর মারুফ বলছেন প্রাপ্ত বয়স্কদের অনেকেই হাসপাতালে আসেন নানা শারীরিক সমস্যা নিয়ে। "কিন্তু যখনই একটু ডিটেইলসে যাওয়ার চেষ্টা করি তখন দেখতে পাই শারীরিক সমস্যা আসলে নেই। সমস্যাটা মানসিক এবং বিষণ্ণতা থেকে এগুলো হচ্ছে।" তবে শিশু কিশোরদের মধ্যে নানা কারণে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হবার সুযোগ বেশি। যেমন প্রেমে ব্যর্থতার কারণে অনেকে এই সমস্যায় আক্রান্ত হন তাই এ ধরণের ক্ষেত্রে শিশু কিশোরদের মানসিক সহায়তা জরুরি বলে মনে করেন মিস্টার মারুফ। কেনো মানুষ বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়? মনোবিদ মেখলা সরকারের মতে অনেকগুলো কারণের মধ্যে বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ জীনগত ত্রুটি। "জেনেটিক কারণে অনেকে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হতে পারেন। বিবেচনায় রাখা দরকার বায়োলজিক্যাল অসুখ বিসুখকে। এছাড়া নেতিবাচক মানসিক গঠন। কিংবা আশপাশের পরিবেশ যা সে মনে করে যে তার সাথে আর যাচ্ছেনা"। তিনি বলেন আবার ব্রেক আপ, ডিভোর্স কিংবা পরিবারের কেউ অসুস্থতায় আক্রান্ত হলে সেখান থেকেও বিষণ্ণতা হওয়ার আশংকা থাকে। আবার চারপাশে সব ঠিক আছে কিন্তু তারপরেও জৈবিক বা অন্তর্গত নানা কারণে একজন মানুষ বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হতে পারে। বিষণ্ণতা কাটানোর উপায় কি ? মেখলা সরকারের মতে বিষণ্ণতা তিন ধরণের হয়- মৃদু, অল্প বা বেশি। "মৃদু বিষণ্ণতা নিজে থেকেই ঠিক হয়ে যায়। আবার অল্প হলে কারও সাথে শেয়ার করা বা সামাজিক মিথস্ক্রিয়া বাড়ালে কাজে লাগে। অর্থাৎ বিচ্ছিন্ন না থাকা। সবার সঙ্গে মেশা। যাদের সঙ্গ ভালো লাগে তাদের কাছে থাকা। মানুষের কাছ থেকে দুরে সরে না যাওয়ার মাধ্যমেও কিছুটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।" তিনি বলেন বিষণ্ণতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো নিজেকে গুটিয়ে নিতে ইচ্ছে করে। "এজন্য আমরা বলি শারীরিক পরিশ্রম বা শরীরচর্চা করা। রেগুলার ৩০ মিনিট হাঁটা খুবই ভালো। কেউ বাইরে যেতে নর পারলে ঘরের মধ্যেই ঘোরাফেরা করতে পারে তাতেও উপকার পাবে।" তিনি বলেন একজন মানুষ যতোটা শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকবে ততটাই তার সমস্যা কাটবে। "সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানসিকভাবে দৃঢ় থাক ও আত্মবিশ্বাস রাখা যে আমি পারবো। এজন্য নিজের ইতিবাচক বিষয়গুলোকে ফোকাস করা যেতে পারে এবং ভালো কাজগুলোর চর্চা করা।" তবে দৈনন্দিন জীবন যাপনের কাজ কিংবা পড়ালেখা বা পরিবারের সাথে সম্পর্ক খারাপ হতেই থাকলে বা কেউ যদি ক্রমাগত নিজে গুটিয়ে নিচ্ছে মনে হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। তার মতে বিষণ্ণতা অনেকটাই নিরাময়যোগ্য তাই একে অবহেলা করা উচিত হবেনা। একই মত দিয়ে ডা: মুনতাসীর মারুফ বলেন বিষণ্ণতার ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সে অনুযায়ী জীবনাচরণ পরিচালনা করতে পারলে এ থেকে সহজেই উত্তরণ করা সম্ভব। সূত্র : বিবিসি বাংলা
×