ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

মুনতাসির সিয়াম

টিফিন বক্স

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ১২ অক্টোবর ২০১৯

টিফিন বক্স

রাবেয়া বিদ্যাময়ী সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। অল্প কিছুদিন বাদেই তার পিএসসি পরীক্ষা। এ সময় সবাই পড়ালেখায় আরও মনোযোগী হয়ে উঠেছে। কিন্তু রাবেয়ার বেলায় এর উল্টো। গত কয়েকদিন ধরে কেমন যেন গা ছাড়া ভাব নিয়ে স্কুলে আসছে সে। পুরোটা সময় জুড়ে মনমরা হয়ে বসে থাকে। রাবেয়ার স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষকের নাম নাছিমা আক্তার। তিনি প্রতিদিনই একবার করে প্রতিটা ক্লাস পরিদর্শনে যান। শিক্ষকরা কেমন করে পড়াচ্ছেন, শিক্ষার্থীদের সেসব পড়া বুঝতে কোন অসুবিধে হচ্ছে কিনা খোঁজ খবর নেন। এভাবেই তার চোখে রাবেয়ার উদাসী ভাবটা ধরা পড়ল একসময়। ক্লাস টিচারের থেকে তিনি রাবেয়ার স¤পর্কে খোঁজ খবরও নিলেন। জানতে পারলেন, মেয়েটি পড়ালেখায় ভীষণ মনোযোগী। প্রতিটা পরীক্ষাতেই ফার্স্ট হয়ে এতদূর এসেছে সে। কিন্তু মাসখানেক ধরে ওর মাঝে একটা অমনোযোগী ভাব খেয়াল করছেন সব শিক্ষকরাই। পড়ালেখায় যেন একেবারেই মন নেই রাবেয়ার। মডেল টেস্ট পরীক্ষাতেও ভাল রেজাল্ট হয়নি তার। সবকিছু শুনে নাছিমা আক্তার জিজ্ঞেস করলেন, বাচ্চাটার কোন সমস্যা হচ্ছে কি না পড়ালেখার ক্ষেত্রে জানতে চেয়েছিলেন আপনি? -ক্লাসে দাঁড় করিয়ে বকাবকিও করেছি ওকে। সামনেই বোর্ড পরীক্ষা, তাই যেন পড়ালেখায় আবারও মনোযোগ দেয়। কিন্তু লাভ হয়নি। -বকাবকি করে কি একজনকে পড়ালেখায় মনোযোগী করানো যায়? এই সময়টা ছেলেমেয়েদের বেড়ে ওঠার বয়স। তাই নানা রকম মানসিক সমস্যায় ভুগতে শুরু করে ওরা। বা পারিবারিক কোন সমস্যাও তো থাকতে পারে। মেয়েটিকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলুন প্লিজ। পিয়ন গিয়ে রাবেয়াকে ডেকে আনল ম্যাডামের রুমে। রাবেয়া ভেতরে ঢুকে একটা সালাম দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। সালামের উত্তর নিয়ে রাবেয়াকে বসতে বললেন নাছিমা আক্তার। রাবেয়ার পাশের চেয়ারে একটা টিফিন বক্স হাতে করে নিয়ে এসে বসলেন তিনিও। বললেন, এখন তো টিফিন পিরিয়ড চলছে মা। চল আমরা খেয়ে নেই। তুমি কি টিফিন নিয়ে এসেছ বাড়ি থেকে? রাবেয়া ম্যাডামের কথাগুলো বুঝে উঠতে পারছে না। সে ভেবেছিল, মড়েল টেস্ট পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ করার জন্য ডেকে পাঠানো হয়েছে তাকে। হয়ত পড়ালেখায় মনোযোগী হওয়ার কথা বলবেন তিনি। ম্যাডামের প্রশ্নের উত্তর দিল রাবেয়া, না মিস। আমার বাড়ি তো স্কুলের কাছেই। তাই টিফিন পিরিয়ডে বাড়িতে গিয়ে ভাত খেয়ে আসি। -বাহ তুমি তো লাকি রাবেয়া। টিফিনের সময়ও মায়ের হাতের রান্না করা গরম গরম ভাত খেতে পার তুমি। কিন্তু দেখ, তোমারই অনেক বন্ধু হয়ত দূরে বাড়ি হওয়ায় বাড়ি যেতে পারে না এই সময়। সকালে মা যেগুলো টিফিন বক্সে করে দেয়, সেগুলোই খেতে হয় ওদের। সে যাই হোক, আজ তোমার এই মায়ের হাতের রান্না করা খাবার খাও। খেয়ে দেখ তো, তোমার কোন মায়ের হাতের রান্না বেশি ভাল লাগে তোমার! এরপর রাবেয়াকে নিয়ে একসঙ্গে খেতে বসলেন নাছিমা আক্তার। খেতে খেতেই প্রশ্ন করলেন তিনি, বড় হয়ে কি হতে চাও রাবেয়া? রাবেয়া মাথা তুলে উত্তর দিল, ডাক্তার হতে চাইতাম। -চাইতে কেন! এখন কি তোমার অন্য কিছু হতে ইচ্ছে করে? এবার আর কোন উত্তর দিতে পারল না রাবেয়া। সে কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। জলে ভরে এসেছে তার চোখ দুটো। নাছিমা আক্তার এবার রাবেয়াকে চেয়ার থেকে উঠিয়ে নিয়ে হাত ধুয়ে দিলেন। নিজেও আর কিছু খেলেন না। রাবেয়াকে অভয় দিয়ে বললেন, আমাকে তোমার কোন সমস্যা হলে বলতে পার মা। আমি নিজের সাধ্যমতো চেষ্টা করব তোমার জন্য। পড়ালেখায় কত ভাল তুমি! ফার্স্ট বাদে কখনও সেকেন্ড হওনি। অথচ এখন পড়ালেখায় মন দিতে অসুবিধে হচ্ছে। সারাক্ষণ মনমরা হয়ে ক্লাসে বসে থাক। আমাকে কি বলা যায় মা? মায়ের মতো স্নেহ মেশানো এমন জিজ্ঞাসায় আর চুপ করে থাকতে পারল না রাবেয়া। খুলে বলল তার সমস্যা, সে ছোট থেকেই ডাক্তার হতে চাইত। ডাক্তার হয়ে ওদেরই মতো গরিব পরিবারের মানুষদের ফ্রিতে চিকিৎসা সুবিধা দেয়ার স্বপ্ন ছিল। তাই ছোট থেকে এখনও পর্যন্ত পড়ালেখায় কখনই অমনোযোগী হয়নি সে। রাবেয়ার বাবা নেই। মা-ই এতদিন যাবত কষ্ট করে ওর পড়ালেখার খরচ যুগিয়েছে। কিন্তু বেশ কিছুদিন যাবত সেই মাও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। পড়ালেখার খরচ চালাতে পারছেন না তিনি। এরই মাঝে এক দূরের আত্মীয় এসে মাকে বিভিন্ন ভাবে বুঝিয়েছেন যেন মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেয়। কারণ, মেয়ের বাবা নেই। মাও অসুস্থ। হুট করেই যদি কিছু একটা হয়ে যায় তবে এমন অল্প বয়সী মেয়েটার কি হবে! নাছিমা আক্তার এবারে থামিয়ে দিলেন রাবেয়াকে। সবটাই বোঝা হয়ে গেছে তার। বললেন, একটা ছুটির আবেদনপত্র লিখে ফেল তো মা। আজ আর তোমাকে ক্লাস করতে হবে না। কাল থেকে নিয়মিত সব ক্লাস কর। রাবেয়া এবারও কিছু বুঝল না। ম্যাডামের কথা মতো ছুটির আবেদনপত্র লিখল শুধু। ছুটির আবেদনপত্রে সিগনেচার করে স্কুল থেকে নাছিমা আক্তার রাবেয়াকে নিয়ে বাইরে এলেন। বললেন, এখান থেকে তোমার বাড়ি হেঁটে যাওয়া যায়? - কেন মিস? -আমি যদি তোমার বাড়িতে বেড়াতে যেতে চাই তাহলে রাগ করবে তুমি? ম্যাডামের কথা শুনে এবারে হেসে দিল রাবেয়া। উত্তর দিল, কি বলছেন মিস! রাগ কেন করব। চলুন আমার বাড়িতে। স্কুল থেকে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই রাবেয়ার বাড়ি। বাড়িতে পৌঁছানোর পর নাছিমা আক্তার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার মা কোথায় রাবেয়া? -মা ঘরেই শুয়ে আছে হয়ত। ঘরে চলুন মিস। ঘরে ঢুকেই রাবেয়ার মায়ের সঙ্গে কুশল বিনময় করলেন নাছিমা আক্তার। এরপর রাবেয়ার স্বপ্ন এবং বিস্তারিত সমস্যাগুলোর কথা খুলে বললেন তিনি। উত্তরে রাবেয়ার মাও কিছুটা হতাশা নিয়েই বললেন, তিনিও স্বপ্ন দেখতেন মেয়ে বড় হয়ে ডাক্তার হবে। কিন্তু এখন তিনি অসুস্থ হওয়ার পর থেকে আর কাজ করতে পারেন না। হুট করেই তার কিছু একটা হয়ে গেলে মেয়েটার কি হবে! -আপনি কিচ্ছু চিন্তা করবেন না। এখন থেকে রাবেয়ার পড়ালেখাসহ যাবতীয় খরচ আমিই দিতে চাই, যদি আপনি অনুমতি দেন। সেই সঙ্গে আপনার অবর্তমানেও ওর দায়িত্ব আমারই থাকবে কথা দিচ্ছি। রাবেয়ার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন এখন আমারও স্বপ্ন হিসেবেই কাজ করবে। তাছাড়া অল্প বয়সে একটা মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া তো আইনগত ভাবেও অপরাধ। আমি চাই না যে মেয়েটি একদিন বড় হয়ে ডাক্তার হবে, তার দুটো মা বেঁচে থাকার পরও এমন অপরাধের স্বীকার হতে হোক। নাছিমা আক্তারের হাত দুটো ধরলেন রাবেয়ার মা। বললেন, আপনার কথাগুলো শুনে ভরসা পেলাম ম্যাডাম। সত্যিই আপনি একজন আদর্শ শিক্ষক। রাবেয়াও মনে মনে ভাবতে লাগল, একজন আদর্শ শিক্ষকই পারে, একজন শিক্ষার্থীর স্বপ্ন পূরণ করতে। অলঙ্করণ : সোহেল আশরাফ
×