ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ফনিন্দ্র সরকার

প্রধানমন্ত্রীর দিল্লী সফর

প্রকাশিত: ০৯:১৩, ১৩ অক্টোবর ২০১৯

প্রধানমন্ত্রীর দিল্লী সফর

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চারদিনের ভারত সফর শেষে দেশে ফিরেছেন। নানা কারণে এবং সাম্প্রতিক বিশ্ব রাজনৈতিক বাস্তবতায় এবারের ভারত সফর খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ভারত বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু রাষ্ট্র। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগিতার কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণযোগ্য। প্রতিবেশী বৃহৎ গণতান্ত্রিক একটি দেশ ভারতের সঙ্গে ভাব বিনিময় বিভিন্ন পর্বের মধ্য দিয়ে অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসামান্য চিন্তা পদ্ধতির প্রভাবে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা নতুন চিন্তার উদ্ভব ঘটেছে এই সফরের মধ্য দিয়ে। পারস্পরিকভাবে একটা গতিময় সংস্কৃতির সংস্পর্শের অসীম প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি উভয়পক্ষের উপলব্ধি হয়েছে বলে মনে হয়। যে উপলব্ধিটি এ যাবত ছিল না। সফরের প্রথম ২ দিন শেখ হাসিনা বিশ^ অর্থনৈতিক ফোরাম আয়োজিত ‘ইন্ডিয়া ইকোনমিক সামিট’-এ গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন। বিশে^র ৪০টি দেশের ৮০০ প্রতিনিধি ঐ সামিটে অংশগ্রহণ করেন। নিয়মানুবর্তী ও সৃজনশীল শক্তি তথা মানবোচিত শক্তির এক অসামান্য দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর বক্তৃতায় প্রতিভাত হয়েছে। তিনি ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের শিক্ষা, অটোমেটিক ও হালকা প্রকৌশল এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় শিল্পে বিনিয়োগ করার আহ্বান জানান বাংলাদেশে। এ অঞ্চলকে বিশ^ অর্থনীতির কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে যে কর্মপ্রক্রিয়া দরকার তার বিবরণ তুলে ধরেন। বাংলাদেশের ষোলো কোটি জনগণ ছাড়াও প্রায় ৩০০ কোটি মানুষের একটা বিশাল বাজারের যোগাযোগের পথ হিসেবে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করেন। একটা দেশের অলৌকিক উন্নয়নের বিস্ময়কর, সামাজিক মূল্যবোধ, জনগণের আস্থা যে প্রধান শক্তি, সে ব্যাখ্যা দেন তার বক্তৃতায়। তিনি এই উপমহাদেশ শুধু নয়, বিশ^কে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত করতে ঐকমত্যের ভিত্তিতে বিশ^ নেতাদের কৌশলগত কর্ম প্রক্রিয়ার ওপর জোর দিয়ে বক্তব্য রাখেন, যা তিনি জাতিসংঘের অধিবেশনেও উপস্থাপন করেছেন। তিনি বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার উদার বিনিয়োগের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে উপস্থাপন করেন। এর যৌক্তিকতাও বিশ্লেষণ করেন। গত বছরের এইচবিসির ভবিষ্যদ্বাণী স্মরণ করিয়ে তিনি বলেন- ‘২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশে^র ২৬তম বৃহত্তর অর্থনীতির দেশ হবে।’ এ সাফল্যের পেছনে তিনি ২টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন। এর একটি হচ্ছে উন্মুক্ত সমাজ ব্যবস্থা, ধর্মীয় সম্প্রীতি, উদার মূল্যবোধ ও ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতি। অন্যটি হচ্ছে জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ তরুণ। এই তরুণ সম্প্রদায় দক্ষ প্রযুক্তির ব্যবহারে সাবলীল এবং প্রতিযোগিতামূলক কাজে যুক্ত হতে প্রস্তুত। আধুনিক প্রযুক্তিতে তরুণদের সম্পৃক্ত করতে যে পরিবেশ দরকার, সে বিষয়ে শেখ হাসিনার সরকার যথেষ্ট সচেতন। উল্লেখ্য, ভারতও বহুমাত্রিক সম্পর্ককে আরও জোরদার করণে একমত পোষণ করেছে। চলমান সম্পর্কের উচ্চতা ধরে রাখতে পারস্পরিক কৌশলগত সুবিধার কথা মাথায় রেখে অমীমাংসিত বিষয়গুলো মীমাংসার পথে অনেকটাই অগ্রসর হয়েছে বলে ধারণা করা যেতে পারে। দীর্ঘদিনের ছিটমহল সমস্যা, সমুদ্রসীমা সমস্যা, পাহাড়ী সমস্যা ও গঙ্গা চুক্তির সমস্যার সমাধান হয়েছে শেখ হাসিনার আমলেই। গুরুত্বপূর্ণ দুটি সমস্যা যেমন- ছিটমহল ও সমুদ্রসীমা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে সমাধান হয়েছে। তাছাড়া ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে এক সময় বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহৃত হতো। শেখ হাসিনার দৃঢ়তা ও সাহসী নেতৃত্বের কারণেই ভারতবিরোধী সন্ত্রাসীরা সে সুযোগ আর পাচ্ছে না। ২০১০ সালে কংগ্রেস সরকারপ্রধান মনমোহন সিং ঢাকা সফরের সময় তিস্তা চুক্তির বিষয়টি ব্যাপক প্রচার পেলেও দ্বিপাক্ষিক আলোচনার এজেন্ডাতে ছিল না। সফরের প্রাক্কালে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে তিস্তা চুক্তি হবে না বলে প্রচার করলেও বাংলাদেশের সে সময়কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ দীপু মণি সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দৃঢ়তার সঙ্গেই উচ্চারণ করেছিলেন যে, এই সফরেই তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর হবে। কিন্তু হয়নি। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের খবরই সত্য হয়েছিল। তার পর যমুনার জল অনেক দূর গড়ালেও তিস্তার গভীরতা খুঁজে পাওয়া গেল না। তিস্তায় ‘মমতা বাধাকে’ অজুহাত হিসেবে রাজনীতির কূটনীতি তার গতিপথ বদলে দিল। আসলে কেন যে তিস্তার কথা আমরা আলোচনা করি, তার অর্থ খুঁজে পাই না। তিস্তা নিয়ে ভারত একটা রাজনীতি করবে, এটা তাদের কৌশল। এই কৌশলের সঙ্গে কৌশল নিয়ে চলতে হবে। ভারতের সঙ্গে আমাদের প্রায় ৫৪টি নদী রয়েছে। এই নদীগুলোর পানির ন্যায্য হিস্যা প্রাপ্তির বিষয়ে জোরালো আলোচনাই সমাধানের পথ বাতলে দিবে। সে আলোকেই এবারের সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পানি সমস্যার পথ পরিষ্কার করতে পেরেছেন। এ সফরে ৭টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষা, সংস্কৃতি, পানিসম্পদ অন্যতম। এ ছাড়া ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ৩টি প্রকল্প যৌথভাবে উদ্বোধন করেছেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী। ভারতে এলপিজি রফতানির বিষয়েও সমঝোতা হয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব বিশে^র মধ্যে একটি বিস্ময়কর উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী। বিগত ১০ বছরে বিভিন্ন কাজে সফলতার স্বীকৃতি হিসেবে শেখ হাসিনাকে ঠাকুর শান্তি এ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্ক আগামী ২০২১ সালে ৫০ বছর পূর্তি হবে। যৌথভাবে ৫০ বছর পূর্তি উৎসব পালিত হবে দুই দেশে। কূটনীতিতে স্থায়ী বন্ধু, স্থায়ী শত্রু বলে কোন কথা নেই। কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে কোন ছেদ ঘটেনি। মাঝেমধ্যে ছন্দপতন ঘটেছে, এই যা। ভারত বাংলাদেশের চাইতে অনেক শক্তিশালী রাষ্ট্র। প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের উচ্চতাকে বৃদ্ধি করতে হলে প্রতিবেশীকেও শক্তিমান ও নির্ভয় করে গড়ে তুলতে সহযোগিতা করতে হবে। প্রতিবেশীর বিনাশ সাধনে ভারত যদি তার স্বীয় শক্তি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যবহার করে, তবে উচ্চতা ধপাশ করে ভেঙ্গে যাবে। একটি অসমশক্তি সম্পন্ন রাষ্ট্রকে অবহেলা করতে নেই। সেটি গোটা পৃথিবীর জন্য ভয়ের কারণ হতে পারে। কাজেই বড় দেশকে প্রতিবেশী বন্ধু সম্পর্কিত ছোট দেশগুলোকে বিভিন্নভাবে শক্তিধর হতে অনুপ্রাণিত করতে হবে। এটাই আদর্শ মানবিক রাষ্ট্র চরিত্র। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এই মানবিক মূল্যবোধের ওপর গড়ে উঠুক, সেটা দুই দেশের জনগণের প্রত্যাশা। প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক ইচ্ছা বা আকাক্সক্ষা পূরণের জন্য দরকার স্বাধীন ইচ্ছাপ্রসূত ভাবনা। মানবীয় শক্তিকে মানুষের কল্যাণে কাজে লাগাতে না পারলে সমাজ ধ্বংস হবে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রও অকেজো হয়ে পড়বে। বর্তমান বিশে^ অহিংস নীতি অবলম্বনকারীদের মধ্যে মহাত্মা গান্ধীই শ্রেষ্ঠ। সেই গান্ধীর অনুসারী আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর পথ ধরে শেখ হাসিনা রাজনীতিতে যে আলো ছড়িয়েছেন, তা বিস্ময়কর। যে বার্তা বহন করে শেখ হাসিনা বিশে^র বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সভায় বক্তৃতা করছেন, তা অনুসরণ করলে বিজ্ঞান সভ্যতার এ পৃথিবী শান্তিময় বাসযোগ্য ভূমিতে রূপান্তরিত হবে। শেখ হাসিনা লক্ষ্য অর্জনের পথ থেকে টলে পড়েননি কখনও। বিশ^ সভাগুলোতে তিনি মানব কল্যাণের বার্তাই পৌঁছে দিচ্ছেন। ভারত সফরে নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। কিন্তু তার সব আলোচনার সারমর্ম ছিল, এই উপমহাদেশের সাধারণ মানুষের মঙ্গলজনক চিন্তার প্রতিফলন। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক হবে এমন এক ভবিষ্যতের, যা সত্যিকারের মানুষ গঠনমূলক দর্শনভিত্তিক। লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক। [email protected]
×