ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ইতিহাস প্রসিদ্ধ শহর

প্রকাশিত: ০৮:২৭, ১৪ অক্টোবর ২০১৯

 ইতিহাস প্রসিদ্ধ শহর

হাজারও মানুষের প্রাণের শহর ঢাকা। আয়তনের তুলনায় অতিরিক্ত মানুষের বসবাস একমাত্র জীবিকা নির্বাহের জন্য। কেননা এই রাজধানীতেই মানুষ খুঁজে পায় তার বেঁচে থাকার একটু আশ্বাস। আজকের এই আধুনিকনগরী ঢাকা শহরকে আমরা যেভাবে দেখছি, এর আগে এর স্বরূপ ছিল ভিন্ন। সবচেয়ে বড় কথা, এর ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ। মধ্যযুগের বিভিন্ন রাজা-বাদশা থেকে শুরু করে ইংরেজ ও পাকিস্তানীদের রাজত্ব ছিল লক্ষণীয়। তাদের রাজত্বেরই ধারাবাহিকতায় আমাদের এই আজকের রাজধানী ঢাকা। ঢাকা নামের উৎপত্তি সম্পর্কে স্পষ্ট করে তেমন কিছু জানা যায় না। এ সম্পর্কে প্রচলিত মতগুলোর মধ্যে, এক সময় এ অঞ্চলে প্রচুর ঢাক গাছ (বুটি ফ্রনডোসা) ছিল; গুপ্তাবস্থায় থাকা দুর্গা দেবীকে (ঢাকেশ্বরী দেবী প্রতিমা) এ স্থানে পাওয়া যায়; রাজধানী উদ্বোধনের দিনে ইসলাম খানের নির্দেশে এখানে ঢাক বাজানো হয়েছিল; ‘ঢাকা ভাষা’ নামে একটি প্রাকৃত ভাষা এখানে প্রচলিত ছিল; রাজতরঙ্গিণী-গ্রন্থে ঢাক্কা শব্দটি ‘পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র’ হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে এবং এলাহাবাদ শিলালিপিতে উল্লিখিত সমুদ্র গুপ্তের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ডবাকই হলো ঢাকা। খ্রিস্টীয় ৭ম শতক থেকে বর্তমানের ঢাকায় লোক বসবাস শুরু হয়েছিল। নবম শতকে সেন শাসন শুরু হওয়ার আগে ঢাকা বৌদ্ধ রাজ্য কামরূপের অধীনে ছিল। সেন পরবর্তী যুগে ঢাকা তুর্কি ও আফগান শাসনাধীন হয়। এ সময় ঢাকা দিল্লী সালতানাত নির্ধারিত শাসকদের দ্বারা শাসিত হয়। তিনটি প্রাদেশিক কাঠামোর মধ্যে ১৩৩৮ সালে সোনারগাঁয়ে স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলা দিল্লীর নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। শুরু হয় বাংলায় স্বাধীন সুলতানি শাসন। দিল্লীর শাসন কাঠামো থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন থাকার পরও এই কালপর্বেই বাংলায় শিক্ষা, শিল্প-সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সার্বিক বিকাশ ঘটে। সুলতানি পর্বে পূর্ববাংলায় সোনারগাঁও ও উত্তর বাংলার গৌড় বা লখনৌতি ছিল স্বাধীন সুলতানি বাংলার রাজধানী। গোটা বাংলায় সুলতানি যুগে গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক অঞ্চল গড়ে উঠেছিল। ঢাকা, বাগেরহাট, ঝিনাইদহের বারবাজার, রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চলে পাওয়া সুলতানি স্থাপনা ও লিপিসাক্ষ্য এর প্রামাণ্য দলিল হয়ে আছে। ইতিহাস বলে, ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দের দিকে ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ প্রথমত বাংলায় একজন স্বাধীন সুলতান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। আর তাঁর হাত ধরেই সোনারগাঁওয়ে শুরু হয় দুইশ’ বছরব্যাপী বাংলার স্বাধীন সালতানাতের যাত্রা, যা দিল্লীর সালতানাত থেকে ছিল পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। আর তখন থেকেই একটি ছোট্ট শহর হিসেবে ঢাকার অস্তিত্ব ইতিহাসের সূত্রে পাওয়া যায়। যা কালেক্রমে বিকশিত হয়ে আমাদের আজকের রাজধানী শহর ও সবার গর্বের ঢাকা। তখন ইসলাম খান ঢাকাকে সুবাহদারের বাসস্থান হিসেবে উপযুক্ত করে নির্মাণের সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বর্তমান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে এ দুর্গের অবস্থান চিহ্নিত করা হয়। প্রাচীন ঢাকা শহরটি পাকুড়তলির (বর্তমান বাবুবাজার এলাকা) সীমিত এলাকা ঘিরে গড়ে ওঠেছিল। পরে মুঘল সুবাহর রাজধানী হওয়ার পর এর পরিধি বৃদ্ধি পায়। এ সময় বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা শহরটি পশ্চিমে দুর্গ থেকে শুরু করে পূর্বদিকে বর্তমান সদরঘাট পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। লক্ষ্মীবাজার, বাংলাবাজার, সূত্রাপুর, জালুনগর, বানিয়ানগর, গোয়ালনগর, তাঁতীবাজার, সুতারনগর, কামারনগর, পাটুয়াটুলি, কুমারটুলি ইত্যাদি এলাকা মুঘল-পূর্ব যুগে হিন্দু প্রভাবাধীন এলাকা ছিল। রাজধানী সোনারগাঁয়ের নিকটবর্তী হওয়ায় বাণিজ্য বিস্তার করতে গিয়ে ঢাকার এ অঞ্চলে ক্রমে নাগরিক জীবনের বিস্তার ঘটে। সোনারগাঁও থেকে ঢাকার নগরায়ণের পথ প্রশস্ত হয় বুড়িগঙ্গা নদীপথের যোগাযোগ থাকায়। দীর্ঘ বিরতির পর ১৬০৮ থেকে ১৬১০-এর মধ্যে মুঘল সুবাদার ইসলাম খাঁর হাতে ঢাকার পতন এর স্বাধীনতার অবসান ঘটায়। বাংলা পরিপূর্ণভাবে মুগল সুবার অন্তর্ভুক্ত হয়। সুবাদার ইসলাম খাঁ ঢাকাকে বাংলা সুবার রাজধানী করেন। আর সম্রাটের নামে ১৬১০ সালে ঢাকার নামকরণ করা হয় জাহাঙ্গীরনগর। এভাবে প্রায় আড়াইশ’ বছর পর বাংলা আবার দিল্লীর প্রদেশে পরিণত হয়। আর দ্বিতীয়বারের মতো প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদা পায় ঢাকা। বাংলার নওয়াবদের রাজনৈতিক ক্ষমতার পতন এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উত্থানে ১৮ শতকের শেষভাগে ঢাকার প্রশাসনিক গুরুত্ব ম্লান হয়ে যায়। উপরন্তু, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক ও উৎপাদন নীতি নগরীর আর্থিক ভিত্তিকে ধ্বংস করে দেয়। ফলে ভূতপূর্ব শাসকগোষ্ঠীর গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ বহুসংখ্যক লোক বেকার হয়ে পড়ে এবং বিকল্প জীবিকার সন্ধানে তারা নগরী ত্যাগ করে বিভিন্ন স্থানে ও পল্লী এলাকায় চলে যায়। এভাবে ঢাকার জনসংখ্যা দ্রুত হ্রাস পায়। স্বাভাবিকভাবেই নগরীর প্রাকৃতিক বিস্তার এতটাই সংকুচিত হয়ে যায় যে, উনিশ শতকের প্রারম্ভে ঢাকা হয়ে পড়ে তার পূর্বের অবস্থার ছায়ামাত্র। প্রকৃত অর্থে এর প্রশাসনিক গুরুত্ব, এর ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্প উৎপাদন কার্যত বিলুপ্ত হয়ে যায়। একইভাবে ঢাকার সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কার্যক্রমেরও মারাত্মক অবনতি ঘটে। উন্নয়নের নতুন ধারা এবং সমৃদ্ধির নতুন যুগের সূত্রপাতের মাধ্যমে ১৮৪০-এর দশক থেকে ঢাকার নগর ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হয়। নগর উন্নয়নের এই যাত্রা তখন থেকেই অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। যে উপাদানগুলো নগরের পুনরুদ্ধারের কাজ সম্পন্ন করেছে, সেগুলোই প্রাথমিক পর্বে নগরের উত্থানে সহায়ক ছিল। এগুলো হলো- একটি সম্পদশালী পশ্চাদভূমি (কার্যত সমগ্র দক্ষিণ ও পূর্ব বাংলা), একটি উপযুক্ত ভৌগোলিক অবস্থান, প্রশাসনিক উন্নতি, এবং নতুন ধরনের শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, উৎপাদন ও শিল্প কারখানার আবির্ভাব। একই সময়ে ইউরোপের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের পরবর্তীকালে যে সাংস্কৃতিক রেনেসাঁর সূচনা হয়, তার ফলে বিভিন্ন শিক্ষা বিষয়ক, রাজনৈতিক ও সামাজিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে ক্রমাগতভাবে এবং নিশ্চিতভাবেই একটি গুরুত্বপূর্ণ নগরকেন্দ্র হিসেবে ঢাকার ক্রমবিকাশকে সাহায্য করেছে। লেখক : শিক্ষার্থী, নটর ডেম কলেজ, ঢাকা
×