ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জলবায়ু বিপর্যয় সত্ত্বেও সভ্যতা টিকে থাকবে

প্রকাশিত: ০৮:৫১, ১৫ অক্টোবর ২০১৯

জলবায়ু বিপর্যয় সত্ত্বেও সভ্যতা টিকে থাকবে

এক মুহূর্তের জন্য কল্পনা করুন, আমরা ২০১৯ সালে নেই, বরং এই শতাব্দীর মাঝামাঝি পৌঁছে গেছি। সালটা ২০৫০। কিছু সময়ের জন্য আমরা স্মৃতিচারণ করছি, আমাদের ফেলে আসা সময়টুকুর যে সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত তীব্রতম সমস্যার মোকাবেলা আমাদের করতে হয়েছে। তাই বলে সমস্যাটির মোকাবেলা আমাদের আর করতে হচ্ছে না তা নয়, এখনও হচ্ছে। তবে ইতোমধ্যে পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে আমাদের সমাজ ও অর্থনীতিকে নাটকীয়ভাবে খাপ খাইয়ে নিতে হয়েছে। এ ছাড়া আমাদের আর কোন পথ ছিল না। ২০২০ সালের পর একটা পর্যায় এসেছিল, যখন মৌলিক কিছু বিষয় আমাদের সমষ্টিগতভাবে চিন্তা করতে হয়েছে। উপলব্ধিতে এসেছে যে, জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের আঘাত হানতে শুরু করেছে। যার দৃষ্টান্ত হচ্ছে আক্ষরিক অর্থে স্বর্গ বলে পরিচিত ক্যালিফোর্নিয়া নগরী মাত্র দুই ঘণ্টার দাবানলে পরিণত হয়েছে নরকে। দ্বিতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যার কিছু কিছু সমাধান প্রকৃতপক্ষে আমাদের হাতে এসে গিয়েছিল। ২০২০ সাল নাগাদ সারা বিশ্বেই বিদ্যুত উৎপাদনের সবচেয়ে সস্তা উপায়টি ছিল নবায়নযোগ্য জ্বালানিÑ বলা যায় এর চেয়ে সস্তা উপায় আগে আর ছিল না। সেই নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস হচ্ছে সৌরশক্তি ও বায়ুশক্তি। ব্যাটারির দামও কমে এসে নবায়নযোগ্য জ্বালানির খরচের প্রায় সমান হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং রাতের আঁধার নেমে এলেও কোন চিন্তা নেই। সূর্যরশ্মিকে পরে ব্যবহারের জন্য মজুদ রাখার উপায় আমাদের হাতে এসে গিয়েছিল। তৃতীয় উপলব্ধিটা হলো, এসব নতুন প্রযুক্তি দ্রুত ও পূর্ণোদ্যমে আমরা ব্যবহার করছিলাম না তার সবচেয়ে বড় কারণ জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পের রাজনৈতিক শক্তির বাধা। তিন দশকের প্রচারাভিযানের মধ্য দিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা ওই শিল্পের অধিপতিদের সমস্ত মিথ্যাচার, তথ্যবিকৃতি ও কারসাজি উন্মোচন করে দিয়েছে। ট্রাম্প তো প্রেসিডেন্ট হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই আমেরিকাকে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বের করে এনেছিলেন। প্যারিস চুক্তির সমস্ত অঙ্গীকার যদি সব দেশ রক্ষা করত, তার পরও তাপমাত্রা তিন ডিগ্রী সেলসিয়াসের বেশি বাড়ত। আমরা যদি পৃথিবীকে ওই পর্যন্ত উত্তপ্ত হতে দেই তাহলে আমাদের এই সভ্যতা টিকে থাকবে না। মনে রাখতে হবে, ঐতিহাসিকভাবে আমেরিকাই অন্য যে কোন দেশের তুলনায় বায়ুম-লে বেশি পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড উদ্গিরণ করেছে। ২০১৬ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশটি মাথাপিছু ১৪.৯৫ টন কার্বন বায়ুম-লে ছেড়েছে। এরপর স্থান কানাডার ১৪.৯১ টন, দক্ষিণ কোরিয়ার ১১.৫০ টন, রাশিয়ার ১০ টন, জাপানের ৯ টন, জার্মানির ৮.৮৮ টন, চীন ৬.৫৭ টন, যুক্তরাজ্য ৫.৬৫ টন, ইতালি ৫.৩৭ টন, ফ্রান্স ৪.৩৮ টন, ব্রাজিল ২ টন, ভারত ১.৫৭ টন। তবে সামগ্রিকভাবে জীবাশ্ম জ্বালানিঘটিত সর্বাধিক কার্বন নির্গমনকারী দেশগুলোর মধ্যে ২০১৭ সালে শীর্ষস্থানে ছিল চীন। ওই বছর বিশ্বব্যাপী মোট ৩ হাজার ৬শ’ ২০ মেট্রিক টন কার্বন উদ্গিরণ হয়েছিল বায়ুম-লে এবং এর মধ্যে ২৭.২ শতাংশের জন্য দায়ী ছিল চীন। বাকিরা হলো যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ দেশগুলো, ভারত, রাশিয়া ও জাপান। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী বায়ুম-লে অধিক থেকে অধিকতর মাত্রায় গ্রীন হাউস গ্যাসের সমাবেশ। ১৯০০ সালে জীবাশ্ম জ্বালানির প্রায় পুরোটাই ছিল কয়লা এবং তা থেকে উদ্গিরণ হয়েছিল প্রায় ২শ’ টন কার্বন ডাই অক্সাইড। ১৯৫০ সাল নাগাদ শিল্প-কারখানা থেকে নির্গত কার্বনের পরিমাণ ছিল এর তিনগুণ। আজ নির্গত কার্বনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তারও ২০ গুণের কাছাকাছি। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই বিস্ফোরণ বিংশ শতাব্দীতে যা কিছু তৈরি হয়েছে, তার সব কিছু থেকে অবিচ্ছেদ্য। জীবাশ্ম জ্বালানি পণ্য উৎপাদন, উত্তাপ সঞ্চার ও পরিবহনের জন্য এনার্জি প্রাপ্তির নজিরবিহীন সুযোগ সৃষ্টি করা ছাড়াও পৃথিবীর অন্যান্য সম্পদের প্রায় সব কিছুকে দারুণভাবে প্রাপ্তিসাধ্য করে তুলেছে। কিন্তু এই জীবাশ্ম জ্বালানিই আবার মানবজাতির কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল যে, শিল্প-কারখানা থেকে নিঃসৃত কার্বন ডাই অক্সাইডের প্রায় পুরোটাই সাগর-মহাসাগর শুষে নেয়। পরে জানা যায় যে, তা বায়ুম-লে গিয়ে মিশছে। ১৯৬৫ সালে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, বায়ুম-লে কার্বনের মাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে। ১৯৬৫ সালে বায়ুম-লে কার্বনের মাত্রা ছিল প্রতি মিলিয়নের (পিপিএম) ৩২০ অংশ। এটা তখন নজিরবিহীন হলেও দুই শতাব্দী আগে যা ছিল তা থেকে মাত্র ৪০ পিপিএম বেশি। পরবর্তী ৪০ পিপিএম বেড়ে যাওয়ার জন্য লেগেছে মাত্র তিন দশক। এর পরের ৪০ পিপিএম বেড়েছে দুই দশকে। কার্বন ডাই অক্সাইয়ের মাত্রা এখন ৪০৮ পিপিএম এবং তা বছরে ২ পিপিএম করে বেড়ে চলেছে। কার্বন ডাই অক্সাইড একমাত্র গ্রীন হাউস গ্যাস নয়। মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডও তাপ ধরে রাখে। তেমনি রাখে জলীয় বাষ্প। সব কিছু মিলে উত্তাপ বাড়াচ্ছে পৃথিবীর। তবে কার্বনের মাত্রা ও প্রভাব সর্বাধিক। ১৯৭০ এর দশকের পর থেকে প্রতিটি দশকই আগেরটির চেয়ে উষ্ণতর হয়েছে। তাতে প্রধান ভূমিকা রেখেছে জীবাশ্ম জ্বালানি ঘটিত কার্বন। ১৯৯২ সালে প্রথম জলবায়ু বিষয়ক শীর্ষ বৈঠক হওয়ার পর থেকে মানুষ জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে আরও ৭৬ হাজার ৫শ’ কোটি টন কার্বন বায়ুম-লে ছেড়েছে। ২০১০ এর দশক ছিল ১৯৮০ এর দশকের চেয়ে গড়ে ০.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেশি উষ্ণ। ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা এখন প্রাক-শিল্প যুগের তাপমাত্রার চেয়ে ১ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেশি এবং তা প্রতি দশকে ০.২ ডিগ্রী করে বেড়েছে। ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তির স্বাক্ষরদাতারা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রাক-শিল্প যুগের তাপমাত্রার চেয়ে উর্ধে অনধিক ২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে ধরে রাখা এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত সীমিত রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিল। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধি ১.৫ সেলসিয়াস পর্যন্ত ধরে রাখতে হলে কার্বন নির্গমন ক্রমান্বয়ে কমাতে কমাতে ২০৫০ নাগাদ সময় লেগে যাওয়ার প্রয়োজন হবে। আর ২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের বেশ নিচে রাখতে হলে আরও দু’-এক দশক বেশি সময় লাগবে। আর সেটার জন্য প্রয়োজন হবে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। বলা যেতে পারে এক বিপ্লব। গ্যাস, তেল ও কয়লা পোড়ানো, জেনারেটর চালানো বা চাকা ঘোরানো যেসব জিনিসের জন্য প্রয়োজন, তার সব কিছুই বদলে ফেলতে হবে। ইস্পাতের যাবতীয় কাজকর্ম নতুন করে গড়তে হবে। ঢেলে সাজাতে হবে সিমেন্টের কাজ। প্লাস্টি পুনর্প্রক্রিয়াজাত করতে কিংবা সেটার বিকল্প কিছু বের করতে হবে। মহাদেশের খামারগুলোর রূপান্তর ঘটাতে হবে। আর এসব কিছুই করতে হবে জনগোষ্ঠীর চাহিদা ও আশা-আকাক্সক্ষা মেটানোর জন্য অর্থনীতির যথেষ্ট সম্প্রসারণ ঘটিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে। মনে রাখতে হবে, ২১০০ সালের জনসংখ্যা হবে আজকের জনসংখ্যার দেড়গুণ। কার্বন নিঃসরণ ২০৫০ সাল নাগাদ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে গেলে বর্তমান উদ্গিরণ ২০৩০ সালের মধ্যে অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে। কিন্তু কোন দেশই সেই পথে চলছে না। তবে প্যারিস চুক্তির অঙ্গীকার যদি পূরণ করা হয়, তা হলে ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী কার্বন উদ্গিরণ মোটামুটি আজকের সমান হয়ে দাঁড়াবে। এমনকি তার পরও যদি কার্বন উদ্গিরণ হ্রাস পায়, তাহলে ৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। ২০৩০ সাল নাগাদ কার্বন উদ্গিরণ অর্ধেক কমিয়ে আনার একটা পদক্ষেপ হলো নবায়নযোগ্য জ্বালানির দ্বারা বিদ্যুত উৎপাদন মোট উৎপাদনের অর্ধেক পর্যন্ত বাড়িয়ে তোলা। তার অর্থ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসের উৎপাদন ক্ষমতা ৫ থেকে ১০ গুণ বাড়াতে হবে। পানি বিদ্যুত ও পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের প্রসার ঘটানো গেলে কয়েক বর্গকিলোমিটার জুড়ে স্থাপিত সৌর প্যানেল ও লাখ লাখ উইন্ডমিলের ওপর চাপ কমবে সন্দেহ নেই, কিন্তু বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধির ফলে পরে এগুলোর ওপর চাপও বাড়বে। গত বছর বিশ্বে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছিল ৩.৭ শতাংশ। ১১ বছর ধরে এ হারে চাহিদা বেড়ে গেলে ২০৩০ সাল নাগাদ চাহিদা ২০১৮ সালের চাহিদার অর্ধেকের মতো বিশাল আকার ধারণ করবে। বলা বাহুল্য, নতুন উৎপাদন ক্ষমতার পুরোটাই হতে হবে জীবাশ্ম জ্বালানিমুক্ত। সমস্ত শিল্প-কারখানা থেকে মোট যত কার্বন নির্গত হয়, বিদ্যুত উৎপাদনকেন্দ্র থেকে নির্গত বিদ্যুতের পরিমাণ তার ৪০ শতাংশেরও কম। শিল্প প্রতিষ্ঠান ও পরিবহন যান থেকে নির্গত কার্বন হ্রাসের ক্ষেত্রে অগ্রগতি মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। বিশ্বের যানবাহনের মাত্র ০.৫ শতাংশ বিদ্যুতচালিত। কার্বন নির্গমন বৃদ্ধি না ঘটিয়ে এমন যানবাহনের সংখ্যা ৫০ শতাংশে উন্নীত করতে গেলে জীবাশ্ম জ্বালানিমুক্ত বিদ্যুতের উৎপাদন আরও বাড়িয়ে তুলতে হবে। এ সব কিছু ঘটানোর জন্য যে পরিমাণ বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে, তা নজিরবিহীন। তেমনি ক্ষতি হবে জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর অর্থনীতির কিছু অংশের। ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বে কার্বন নির্গমন যেখানে অর্ধেকে নামিয়ে আনার কথা, তখন বড় তেল কোম্পানিগুলোর নতুন নতুন তেলক্ষেত্রে অর্থ ব্যয়ের পরিকল্পনা অর্থহীন হয়ে পড়বে। এর তাৎপর্য ভূরাজনীতিতেও প্রসারিত হবে। যে বিশ্বে তেলের দামের আর কোন কদর নেই, তা হবে বিগত শতাব্দীর বিশ্ব থেকে অতিমাত্রায় আলাদা। সেই বিশ্বে ব্যাপক পরিসরে অভিযোজন অর্থাৎ পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার প্রয়োজন হবে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিশ্বের উষ্ণায়ন এ পর্যন্ত যতটুকু হয়েছে, তারই ধকল সামলাতে হচ্ছে আমাদের। আগামীতে আরও বেশি হবে। উত্তপ্ত হয়ে ওঠা ভূম-লে বেশ কিছু জরুরী অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। দাবানল এখন সারা বছরই বিশ্বের কোথাও না কোথাও ঘটছে। সাগর-মহাসাগর উত্তপ্ত হয়ে ওঠায় হ্যারিকেন এবং টাইফুনের সংখ্যা ও তীব্রতা বাড়ছে। এগুলোর ধ্বংসযজ্ঞের ব্যাপকতাও বাড়ছে। সুমেরু ও কুমেরুর বরফ গলতে থাকায় সাগর পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। এতে উপকূলীয় এলাকা বিশেষ করে এশিয়ার নিম্নাঞ্চলগুলো তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বকে ধান যোগানোর জন্য অপরিহার্য এলাকা হিসেবে বিবেচিত মেকং অববাহিকার নিম্নাঞ্চলে ফুলে ওঠা সাগরের লোনা পানি এসে ঢুকছে। আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে বন্যা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠার একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা। এশিয়ার আরও কিছু নগরীও একই বিপদের সম্মুখীন। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলও তা থেকে ব্যতিক্রম নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের আরেক অভিশাপ হচ্ছে খরা ও মরুবিস্তার। এর ফলে এশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্য আমেরিকার বিপুল সংখ্যক মানুষ অন্যত্র পাড়ি জমাতে বাধ্য হচ্ছে। জাতিসংঘের অনেক আগে থেকেই একটা হিসাব ছিল যে, জলবায়ু পরিবর্তন ঘটিত কারণে চলতি শতাব্দীতে এক শ’ কোটি লোক উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। তেমন একটা আশঙ্কা এখন সত্য হতে শুরু করেছে বলে মনে হয়। অনেক স্থানে তাপ প্রবাহ আক্ষরিক অর্থেই অসহনীয় হয়ে উঠেছে। রাত্রিকালীন তাপমাত্রা এক শ’ ডিগ্রী ফারেনহাইটের ওপরে থাকছে। একটা সময়ে কয়েক সপ্তাহ ধরে কিংবা কয়েক মাস ধরে বাইরের কাজকর্ম করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আজ আমরা এমনই এক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছিÑ জলবায়ু পরিবর্তনের হাত থেকে আমরা পরিত্রাণও পাচ্ছি না কিংবা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সমস্যার সমাধানও করতে পারছি না। এদিকে তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে, যদিও সেই বৃদ্ধির হার কমেছে। মানবেতিহাসের সবচেয়ে সুগভীর ও সবচেয়ে বিপজ্জনক ভৌত পরিবর্তনের সম্মুখীন হয়েছি আমরা। আমাদের সভ্যতা নিঃসন্দেহে এক টলায়মান অবস্থায়। বিপুল সংখ্যক মানুষকে অন্যায়ভাবে বিশাল মূল্য দিতে হচ্ছে। শীর্ষস্থানীয় জলবায়ু বিজ্ঞানী জেমস হানসেন বলেছেন, পৃথিবীতে আটকে পড়া বাড়তি তাপশক্তি এবং সেই সঙ্গে মানুষের আচরণের কারণে সৃষ্ট জলবায়ুর পরিবর্তন-দুটো মিলে এমন এক বিধ্বংসী শক্তি সৃষ্টি হয়েছে, যা প্রতিদিন পৃথিবীর বুকে হিরোশিমা শ্রেণীর ৫ লাখ পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরিত হলে যে পরিমাণ বিধ্বংসী শক্তি তৈরি হবে, তার সমান। এই বাড়তি তাপশক্তি সবটাই সারা বিশ্বে জীবন ও জীবিকার জন্য ক্রমবর্ধমান হুমকির সৃষ্টি করছে। বিশ্বের শীর্ষ আবহাওয়া ও জলবায়ু সংস্থাগুলো ১৮৮০-এর দশকে বৈশ্বিক তাপমাত্রার রেকর্ড রাখার কাজ শুরু করার পর থেকে গত পাঁচটি বছর ছিল উষ্ণতম বছর। আর গত জুলাই মাসটি ছিল জানা ইতিহাসের উষ্ণতম মাস। বাড়তি তাপশক্তির ৯০ শতাংশেরও বেশি সাগর-মহাসাগরে চলে যাচ্ছে এবং অতি প্রচ- হ্যারিকেনের ইন্ধন হিসাবে কাজ করছে। সামগ্রিকভাবে ২০১৭ ও ২০১৮ সালে আবহাওয়াজনিত বিপর্যয়ের কারণে বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে ৬৫ হাজার ৩শ’ কোটি ডলার। এত ক্ষতি এর আগে আর হয়নি কখনও। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত আরও যেসব বিপর্যয় সামনে আসছে, সেসব কথা ভাবলে শঙ্কিত হতে হয় যে, মানবসভ্যতা শেষ পর্যন্ত হয়ত টিকে থাকতে পারবে না। কিন্তু ইতিহাস বলে যে, বৈরী পরিবেশ-পরিস্থিতি মোকাবেলা করে এবং এর সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়ে টিকে থাকার বিস্ময়কর ক্ষমতা আছে মানুষের। এই খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা ও উদ্ভাবনী শক্তির জোরে উত্তপ্ত পৃথিবীতে মানুষের জীবন ও জীবিকা অব্যাহত থাকবে। পৃথিবী যে ধ্বংস হয়ে যাবে, তা নয়। মানবজাতিও বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়নি। এটা ঠিক, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অগণিত মানুষের জীবন হুমকির মুখে পড়বে, কোটি কোটি মানুষ স্থানচ্যুত ও উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে, শত শত কোটি মানুষ যেসব খামারের ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে, সেগুলো বিপর্যস্ত হবে। তার পরও উদ্ভাবনী শক্তি মানুষকে খাপ খাইয়ে নিয়ে বেঁচে থাকার নিত্য নতুন কৌশল যোগাবে। সূত্র : ইকোনমিস্ট/টাইম
×