ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নিরঞ্জন রায়

আবরার ও ডেভান- একই পরিস্থিতির শিকার!

প্রকাশিত: ০৮:৫৩, ১৫ অক্টোবর ২০১৯

আবরার ও ডেভান- একই পরিস্থিতির শিকার!

বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ সেই প্রতিষ্ঠানের কিছু সহপাঠীর দ্বারা নির্মমভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে নিহত হন। এই জঘন্য বর্বরোচিত ঘটনার নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই। আমরা শুধু তার আত্মার শান্তি কামনা করি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের জানাই সমবেদনা। এই ঘটনাটি যেদিন ঘটে, সেদিনই টরন্টোর সন্নিকটে একটি ছোট শহর হ্যামিলটনে ১৪ বছর বয়সী ডেভান সেল্ভি নামের এক স্কুলছাত্র একইভাবে তার সহপাঠীদের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে নিহত হন। এই ঘটনাটি আরও বেশি নির্মম এই জন্য যে ডেভানকে স্কুলের সামনে তার মার উপস্থিতিতেই নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যা করে সেই স্কুলেরই কয়েকজন সহপাঠী। এই জঘন্য হত্যাকা-ের বিচার নিশ্চয়ই হবে এবং দোষীরা প্রত্যেকেই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। বাংলাদেশে আবরার হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে যাদের নাম এসেছে, তাদের প্রত্যেককেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী খুবই দ্রুততম সময়ের মধ্যে আটক করতে সক্ষম হয়েছে। কানাডার হ্যামিলটন শহরের পুলিশও অভিযুক্ত দুই সহপাঠীকে আটক করেছে এবং ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে। এখানকার পুলিশ অবশ্য আরও কয়েকজনকে আটক করে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দিয়েছে। যেহেতু ঘটনাদুটো নিয়ে প্রচ- ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রকাশ অব্যাহত আছে এবং পুলিশও বেশ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত শুরু করেছে, তাই এ ব্যাপারে আমাদের মন্তব্য করার সুযোগ নেই। দুই দেশের দুটো হত্যাকা-ের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিরাজমান যে অব্যবস্থার কথা উঠে এসেছে, তা সকলের জন্যই ভয়ঙ্কর উদ্বেগের কারণ। আবরার এবং ডেভান দুজনেই অকালে প্রাণ দিয়ে এই সমাজকে দেখিয়ে দিয়ে গেল যে, উন্নত-অনুন্নত সকল দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই শিক্ষার আলো ছড়ানোর পেছনে কি ভয়ঙ্কর অন্ধকার জগত বিরাজ করছে! অপরাধের ধরন, মাত্রা এবং কারণ মোটামুটি একই রকমের। যদিও আবরার হত্যার জন্য তার ফেসবুক পেজে একটি স্ট্যাটাস দেয়াকে দায়ী করা হচ্ছে, কিন্তু মূল কারণ সে বুয়েটে র‌্যাগিং-এর নির্মম শিকার। আবরার হত্যার প্রতিবাদ করতে এসে অনেক ছাত্রই এখন মুখ খুলে বুয়েটে র‌্যাগিংয়ের নামে নির্যাতনের কথা স্বীকার করছেন। অনেক অভিভাবকও ভয়ে নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে অকপটে স্বীকার করছেন যে, তাদের সন্তানরাও র‌্যাগিংয়ের শিকার হয়ে অনেক মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন সহ্য করেছে। এমনকি শিক্ষকরাও এখন মুখফুটে বলছেন যে, বুয়েটে র‌্যাগিংয়ের নামে ছাত্র নির্যাতনের ঘটনা দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। বাংলাদেশের মতো কানাডায় প্রকাশ্যে প্রতিবাদ বিক্ষোভের প্রচলন নেই এবং এর প্রয়োজনও হয় না। তবে ডেভান নিহত হবার পর এক শোকসভার আয়োজন করা হয়েছিল, যেখানে শত শত মানুষ সমবেত হয়ে তাদের নীরব প্রতিবাদ ও ক্ষোভ জানিয়েছেন। সেখানে নিহত ডেভানের মা প্রকাশ্যে অভিযোগ করেছেন যে, তার ছেলে কিছু দিন ধরেই বুলিংয়ের শিকার হয়ে আসছিল। স্কুল কর্তৃপক্ষ বুলিংয়ের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে ডেভানকে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হতো না। সেই শোকসভায় আগত অনেক অভিভাবকই প্রকাশ্যে অভিযোগ করেছেন যে, তাদের ছেলেমেয়েরাও বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন এবং এখানকার স্কুলগুলোতে বুলিং একটি মারাত্মক সমস্যা, যা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এখানকার স্কুল পরিচালনা সংক্রান্ত বিধিবিধানে স্পষ্ট করেই বলা আছে যে, বুলিংয়ের ব্যাপারে স্কুল কর্তৃপক্ষ শূন্য সহিষ্ণুতা বা জিরো টলারেন্স প্রদর্শন করবে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলো, এখানকার স্কুলগুলোতে বুলিংয়ের মতো জঘন্য ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে এবং এখানে এটি একটি মারাত্মক সমস্যা। আবরার হত্যার পর জাতিসংঘের বাংলাদেশ প্রতিনিধিসহ উন্নত বিশ্বের কয়েকটি দেশের এ্যাম্বাসি বা হাইকমিশন থেকে বিবৃতি দিয়ে তীব্র নিন্দা জানিয়ে ঘটনার দ্রুত ন্যায়বিচার দাবি করেছে। খুবই ভাল কথা। তবে আমরা বেশি সন্তুষ্ট হতে পারতাম, যদি তারা একই রকম নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিত কানাডায় ডেভান হত্যার ব্যাপারে। তাদের তো জোরালো কণ্ঠে বলা উচিত ছিল যে, বিশ্বের প্রতিটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বুলিং বা র‌্যাগিং নির্মূল করতে হবে। কেউ বুলিং বা র‌্যাগিংয়ের মতো অপরাধ করলে কঠোর শাস্তির বিধান করতে হবে। এমনকি এখন আর কিশোর অপরাধীকে কিশোর সুবিধা দিয়ে বিচার করার সুযোগ নেই। কিশোর হলেও কিশোর সুবিধা দিয়ে হত্যার মতো অপরাধের বিচার করার সুযোগ এখন আর থাকা উচিত নয়। আমেরিকা-কানাডার মতো উন্নত আইনের শাসনের দেশে বুলিংয়ের শিকার হয়ে মায়ের সমনে ছেলের এমন নির্মম মৃত্যুর মতো জঘন্য ঘটনা একটিও ঘটা উচিত নয়। এ রকম দুএকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা যে শুধু কানাডাতেই ঘটছে, তা নয়। স্কুল-কলেজে বুলিং, গোলাগুলি এবং হতাহতের ঘটনা আমেরিকা-কানাডায় হরহামেশাই ঘটছে এবং অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীকে আটক করাও সম্ভব নয় না। এখানকার এ রকম একটি ঘটনাও বাংলাদেশে সংঘটিত দশটি ঘটনার চেয়ে অনেক বেশি উদ্বেগজনক। অথচ এত বেশি উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটলেও সে ব্যাপারে জাতিসংঘসহ উন্নত বিশ্বের প্রতিনিধিদের তেমন মন্তব্য করতে দেখা যায় না। মূল কথা এই, উন্নত বিশ্ব, বিশেষ করে আমেরিকা তথ্যপ্রযুক্তির নামে হাতের নাগালে ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রকাশ্য এবং গোপনীয় সমস্ত বিষয়য়ই অবারিত করে বিশ্বব্যাপী যে উন্মাদনা সৃষ্টি করেছে, তাতে এই ধরনের অবাঞ্ছিত ঘটনা যে ঘটবে, তাতে অবাক হবার কিছু নেই। এরসঙ্গে যোগ হয়েছে অবাধ ড্রাগ বা মাদকাসক্তির প্রভাব। তথ্যপ্রযুক্তির মাত্রারিক্ত অপব্যবহার এবং মাদকাসক্তির কুপ্রভাব সমগ্র সমাজব্যবস্থাকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দিতে শুরু করেছে। আজ ফেসবুক না থাকলে আবরার সেখানে খুব সহজে স্ট্যাটাস দিতে পারত না। তখন হয়ত তাকে এমন নির্মম হত্যাকা-ের শিকারও হতে হতো না। জানি না, এই উন্মাদনা কোথায় গিয়ে শেষ হবে এবং আদৌ শেষ হবে কিনা! কেননা এই উন্মাদনার পেছনে রয়েছে বিশাল অর্থের বাণিজ্য। আজ আমেরিকার অর্থনীতির যে রমরমা অবস্থা, তার পেছনে আছে তথ্যপ্রযুক্তি ভিত্তিক কোম্পানিগুলোর অবদান। এখন বলাই হয়ে থাকে যে, আমেরিকার অর্থনীতি চলছে পাঁচটি তথ্যপ্রযুক্তি ভিত্তিক কোম্পানির দ্বারা। অর্থাৎ ফেসবুক, এ্যাপেল, আমাজান, নেটফ্লিক্স ও গুগল। আমেরিকার এসব বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার মূল্যের তথ্যপ্রযুক্তি ভিত্তিক কোম্পানিগুলো কোনদিন নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব হবে না এবং বিশ্বব্যাপী সৃষ্ট সামাজিক উন্মাদনাও থামবে না। আর সেই উন্মাদনার শিকার যে কোন ব্যক্তি যে কোন সময় যে কোন দেশে হতে পারে, তা সে বাংলাদেশেই থাকুক আর আমেরিকা কানাডাতেই বাস করুক। আমরা আশা করব, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেভাবে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং অভিযুক্ত সকলকেই আটক করতে সক্ষম হয়েছে, তাতে তারা সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে সক্ষম হবেন। সরকারও এ ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে যাতে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত কেউ পার না পায়। এ রকম কিছু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে অবস্থার উন্নতি হতে পারে। লেখক : ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা [email protected]
×