ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রফেসর ড. মোঃ সাজ্জাদ হোসেন

নবযুগের নবসূচনা

প্রকাশিত: ০৮:৫৪, ১৫ অক্টোবর ২০১৯

নবযুগের নবসূচনা

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বা ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভুলিউশনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে বিশ্বের সব উন্নত দেশ। আসন্ন এই বিপ্লবের মাধ্যমে সবাই নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থান আরও দৃঢ় করে তোলার পরিকল্পনা করছে। এই বিপ্লব মূলত প্রযুক্তির বিপ্লব, যা পৃথিবীর মানুষের জীবনকে নিয়ে যেতে যায় এক ধাপেই শতবর্ষ এগিয়ে। এই পরিবর্তন সব মানুষের জীবন মান উন্নত করবে, আয় বাড়াবে সব শ্রেণীর মানুষের। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে ইন্টারনেট অব থিংসের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। তাই এই শিল্প বিপ্লব থেকে লাভবান হওয়ার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত এবং উন্নয়নশীল রাষ্ট্র। প্রযুক্তির উৎকর্ষ কাজে লাগিয়ে পরিবর্তিত-পরিবর্ধিত হবে শিল্প-অর্থনীতির সকল ক্ষেত্র। গণ তিন শ’ বছরে প্রযুক্তির বিকাশ মানবসভ্যতার উন্নয়নে অভূতপূর্ব ভূমিকা রেখেছে। পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলো কৃষি থেকে শিল্পায়নে স্থানান্তরিত হয়েছে। থমাস নিউকোমেনের বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে প্রথম শিল্প বিপ্লব শুরু হয়েছিল ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। প্রথম শিল্প বিপ্লব আমাদের উপহার দেয় যান্ত্রিকীকরণের সূচনা, কৃষি ফসলের ওপর ভিত্তি করে শিল্প ভিত্তি প্রবর্তন, খনির শিল্পের অগ্রগতি বিশেষত লোহা ও কয়লা উত্তোলন। পরবর্তীতে আমরা ১৯ শতকের শুরুতে অর্থাৎ ১৮৭০ সালে বিদ্যুত আবিষ্কারের মাধ্যমে দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবে প্রবেশ করে পাই আলোকিত পৃথিবী। তৃতীয় শিল্প বিপ্লবটি ছিল ডিজিটাল বিপ্লব, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিস্তার যা নতুন ‘জ্ঞান অর্থনীতির‘ (কহড়ষিবফমব ঊপড়হড়সু) জন্ম দিয়েছে ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেটের আবিষ্কারের মাধ্যমে। এটি জগণকে এনেছে হাতের মুঠোয়। এই বিপ্লবের ফলে হাজার হাজার নতুন ব্যবসা এবং লাখ লাখ নতুন চাকরি তৈরি হয়েছে এবং একবিংশ শতাব্দীতে একটি টেকসই বৈশ্বিক অর্থনীতির ভিত্তি স্থাপন করেছে। উন্নত প্রযুক্তির কয়েকটি উদাহরণ আপনার বাসার সকল আসবাব ইন্টারনেট এবং স্মার্টফোনের সঙ্গে যুক্ত- এই সিস্টেমকেই বলা যায় ইন্টারনেট অব থিংস। যেমনÑ আপনার বিদ্যুতের বিল দেয়া নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না, বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে যাবে আপনার স্মার্টফোনে। বাসায় কি বাজার নেই তা জানিয়ে দেবে ফ্রিজ! আপনার শরীরে কি পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি, তাও জানিয়ে দেবে আপনার স্মার্টফোনের স্ক্রিন! তখন আপনার চিন্তিত হওয়ার কি কারণ থাকতে পারে? দূর নিরাপত্তা, কারখানার বিপজ্জনক কাজ, স্থাপনার শ্রমিক, কিংবা স্রেফ নিরাপত্তা প্রহরী বা গৃহস্থালি কাজ সব কাজই করতে শুরু করবে রোবট। ‘পায়ের ওপর পা তুলে খেতে’ এখন কেবল একটি রোবটেরই অপেক্ষা! অটোমেশন কারখানার সবগুলো মেশিন এমন একটি সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত থাকবে, যেটি স্বয়ংক্রিয় চালনা থেকে শুরু করে পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ ও অত্ত্বাবধান করবে- একেই বলা হচ্ছে অটোমেশন। এতে বাঁচবে শ্রম খরচ, কমবে মানবিক ত্রুটি। একাধিক কাজ যখন একটি যন্ত্র করতে পারবে, তখন খরচ নিয়েও আর ভাবতে হবে না! সুস্থতায় বংশগত রোগ কমাতে আসবে নিরোগ জীন, কঠিন অসুখের প্রতিষেধক। আর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অস্ত্রোপচার করতে ছুরিকাঁচি ছাড়া কম্পিউটারের দক্ষ হাতের বহুল ব্যবহার শুরু হবে এই বিপ্লবে। মানুষ হয়ত অমর হবে না, কিন্তু পৌঁছে যাবে অমরত্বের কাছাকাছি! পৃথিবীর বিপুল জনসংখ্যা নিয়ে ভিন্ন গ্রহে বসতি গড়তে মানুষকে আর মাথা ঘামাতে হবে না। মানুষকে নিরাপদ রাখতে আসছে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন শক্তিশালী কোয়ান্টাম কম্পিউটিং। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব পৃথিবীকে আক্ষরিক অর্থেই এষড়নধষ ঠরষষধমব-এ পরিণত করবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা হবে অভাবনীয় উন্নত, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হবে পাড়ার দোকানে কেনা-বেচার মতোই সহজ। ডিজিটাল বিপ্লবের এই শক্তির চিত্রটি বিশ্বব্যাংকের সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ডিজিটাল ডিভিডেন্ডস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, ইন্টারনেটের মাধ্যমে এখন এক দিনে বিশ্বে ২০ হাজার ৭০০ কোটি ই-মেইল পাঠানো হয়, গুগলে ৪২০ কোটি বিভিন্ন বিষয় খোঁজা হয়। এক যুগ আগেও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে এ পরিবর্তনগুলো ছিল অকল্পনীয়। অতিরিক্ত জনসংখ্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো বিভিন্ন প্রতিকূলতার মুখে এক সময় মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে হিমশিম খাওয়া বাংলাদেশের পক্ষে যে একদিন প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে, তা অনেকেই কল্পনা করতে পারেনি। কিন্তু বর্তমান সরকারের সদিচ্ছা এবং প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে আজ আমরা প্রযুক্তি খাতে বিস্ময়কর অগ্রগতি অর্জন করেছি। দেশের সব প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে ফোরজি ইন্টারনেট প্রযুক্তি, যা যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার পাশাপাশি আমাদের শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জনে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। যোগাযোগ মাধ্যম আরও দৃঢ় করার লক্ষ্যে মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে দেশের প্রথম নিজস্ব স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠছে ২৮টি হাই-টেক পার্ক, যা আমাদের তরুণ উদ্যোক্তা ও প্রকৌশলীদের এগিয়ে চলার পথকে আরও সুগম করে তুলছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষ এবং উদ্ভাবনের ফলে দেশের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে গড়ে উঠছে উন্নত ও আধুনিক ল্যাব। বর্তমান সরকারের এমন প্রশংসনীয় পদক্ষেপের কারণে আমাদের দেশে সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্ম গড়ে উঠছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব থেকে আমরা যদি লাভবান হতে চাই, তাহলে আমাদের দেশকে প্রযুক্তিবান্ধব করে গড়ে তোলার বিকল্প নেই। বিশ্বজুড়ে চলমান মন্দার মধ্যেও বাংলাদেশ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ৭ থেকে ৮ শতাংশ স্থিতিশীল জিডিপি অর্জন করেছে। বিশ্বে সপ্তম জনবহুল (১৬০ মিলিয়ন) দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ সামাজিক ক্ষেত্রে ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে এগিয়ে যাচ্ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে ন্যানোম্যাটেরিয়ালের বাণিজ্যিক ব্যবহার দেখা যাবে। এসব ন্যানোম্যাটেরিয়াল স্টিলের চেয়েও ২০০ গুণ শক্ত, কিন্তু চুলের চেয়েও পাতলা। থ্রিডি প্রিন্টেড লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট হবে। ১০ শতাংশের বেশি গাড়ি হবে চালকহীন। সরকার, ব্যবসা ও সাধারণ মানুষের জীবনেও এর প্রভাব দেখা যাবে। আগামীর বাংলাদেশ পৃথিবীর এসব উন্নত প্রযুক্তিগুলোকে গ্রহণের মাধ্যমে এগিয়ে যাবে। ভবিষ্যতে মোবাইল সুপার কম্পিউটিং, চালকহীন গাড়ি, কৃত্রিম বুদ্ধিমান রোবট, নিউরো প্রযুক্তির ব্রেন, জেনেটিক এডিটিং দেখা যাবে। প্রযুক্তির এসব সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দেশের মানুষের জন্য আমাদেরকে উন্নয়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, ৪ হাজার ৫৫৪টি ইউনিয়ন ডিজিটাল কেন্দ্র, শতাধিক সহজলভ্য জনসেবা, ই-তথ্য সংগ্রহ ও স্মার্ট স্বাস্থ্য কার্ড বাংলাদেশকে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের পথে নিয়ে যাচ্ছে। ৪র্থ শিল্প বিপ্লব তথা ডিজিটাল বিপ্লবের ফলে সবকিছুর পরিবর্তন হচ্ছে গাণিতিক হারে। এর প্রভাবে পাল্টে যাচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিয়া, ব্যবস্থাপনা, এমন কী রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থাও। এক কথায়, ৪র্থ শিল্প বিপ্লব হচ্ছে ডিজিটাল অবকাঠামোর ওপর নির্মিত মানবসভ্যতার নতুন একটি যান্ত্রিক অনুভূতিপ্রবণ সিস্টেমে পদার্পণ, যা একগুচ্ছ ইমার্জিং টেকনোলজি সমন্বিত ও নিখুঁত ক্রিয়াকলাপের ফল। এটা ইন্টারনেটের কল্যাণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিং লার্নিং, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের নিউরো-প্রযুক্তির নতুন ক্ষমতার প্রকাশ আর প্রচলিত কর্ম সম্পাদন ও ব্যবস্থাপনার ধরনকে বিদায় জানিয়ে নতুনতর এক জগতের সূচনা। ৪র্থ শিল্প বিপ্লব বৈশ্বিক শ্রমবাজার, ভবিষ্যতের কাজকর্মের ধরন, আয়ের অসমতা, ভূ-রাজনৈতিক নিরাপত্তা, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের কাঠামোকে প্রতিনিয়ত প্রভাবিত করছে। এই প্রভাবের ফলে পালটে যাচ্ছে সব কিছু। এমনকি সু-প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা, কৃষি, অর্থনীতি, শিক্ষা ব্যবস্থা, চিকিৎসা ক্ষেত্রেও আসছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের ফলে যেমন ভাঙ্গন ধরেছে পুরনো সকল প্ল্যাটফর্মগুলোতে, তেমনি উন্মোচিত হয়েছে নব নব সম্ভাবনার দ্বার। এই পরিবর্তনই আমাদের জন্য নিয়ে আসবে সকল সেক্টরে নতুন উন্নয়নের জোয়ার। সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রসমূহে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাব মোকাবেলা করতে আমাদের তরুণরাই সক্ষম হবে। দক্ষ মানব সম্পদ সৃষ্টি করতে পারলেই প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সকল ক্ষেত্রে আমরা সঠিকভাবে এগুতে পারব। তাহলেই সম্ভব হবে অতিরিক্ত কর্মক্ষম জনসম্পদকে কাজে লাগানো আর চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং উন্নত ও সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তোলা। লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন
×