ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভালবাসি তোমাদের

প্রকাশিত: ০৯:২৭, ১৫ অক্টোবর ২০১৯

ভালবাসি তোমাদের

পূর্ণদ্যোমে জীবনযুদ্ধে নামা তরুণটিই একদিন প্রবীণে পরিণত হন। কিন্তু জীবনযুদ্ধ চলতেই থাকে। শুধু চলতে থাকে বললে ভুল হবে। অনেক সময় সেই যুদ্ধ হয়ে দাঁড়ায় অমানবিক। আরেকটু কি সহজ হতে পারত না এই যুদ্ধটা? এই ভাবনা থেকেই আবদুল্লাহ আল যোবায়ের আশির এবং আরও কয়েকজন নতুন প্রবীণদের জীবনমান উন্নয়ন নিয়ে কাজ শুরু করেন। তাদের সংগঠন ঢ়ধৎবহঃং ধমবরহম ভড়ঁহফধঃরড়হ এর মাধ্যমে এখন পর্যন্ত ৪০০০ এর বেশি প্রবীণের সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। বৃদ্ধাশ্রমে থাকা বা হারিয়ে যাওয়া প্রবীণদের বাড়ি ফেরাতে শুরু হয় ব্যাক-টু- হোম প্রজেক্ট যার আওতায় এখন পর্যন্ত বাড়ি ফিরেছেন ৭ জন। এ ছাড়াও প্রবীণদের স্বাস্থ্য উন্নয়ন, পরিবার থেকে বিতাড়িত প্রবীণদের পরিবারে ফেরত পাঠানোর মতো কার্যক্রম তো আছেই। ২০১৭ সালে ‘জয় বাংলা ইয়ুথ এ্যাওয়ার্ড’ জয়ী এই সংগঠনের স্বপ্নদ্রষ্টা মুখোমুখি হয়েছিল ডিপ্রজন্মের। আলাপচারিতায় তার গল্প, স্বপ্ন এবং ভাবনা তুলে এনেছেনÑ সারতাজ আলীম প্রবীণদের উন্নয়ন নিয়েই কাজ করতে চাইলেন কেন? প্রবীণ হওয়ার বিষয়টি অবশ্যই চিরন্তন। একটা সময়ে সবাইকে প্রবীণ হতে হবে। আমি, আপনি, আমাদের পিতামাতা সবাইকে। আমি যদি তরুণ সময়ে প্রবীণদের জন্য কিছু করে যেতে পারি তাহলে হয়ত আমার পিতামাতা এবং পরে আমি নিজেও প্রবীণ সময়ের দৈন্য অবস্থা থেকে কিছুটা মুক্তি পেতে পারব। আমি আজকের তরুণ হয়ে প্রবীণদের জন্য কিছু করলে, আগামী দিনে আমি প্রবীণ হলে আমাার জন্য সে সময়ের তরুণরা কিছু করবে আমার বিশ্বাস। সেই তাড়না থেকেই প্রবীণদের জন্য কিছু করার ভাবনা। আপনার সংগঠনটির যাত্রা শুরু কিভাবে? ২০১৬ সালের ২৫ জুন। প্রবীণ মানুষের পাশে থাকার লক্ষ্য নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু। প্রথমে ফেসবুকে সচেতনতা বৃদ্ধি শুরু করি। এক সময় আবিষ্কার করি আমি যে স্বপ্নটা দেখছি সেটা আরও অনেকের মধ্যেই আছে। নাহিদ, মিজান, ইমরান, রুকাইয়াসহ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া আরও কয়েকজনকে পেয়ে গেলাম। প্রবীণদের অধিকার নিয়ে এভাবেই কাজ শুরু করি। পরে কর্মসংস্থান, মেডিক্যাল ক্যাম্প, ঈদে উপহার বিতরণ, হারিয়ে যাওয়া প্রবীণদের বাড়ি ফেরানো, পরিবার থেকে দায়িত্ব নিতে না চাওয়া পরিবারকে তাদের দায়িত্ব মনে করিয়ে দেয়ার মতো কাজগুলো করতে শুরু করি। প্যারেন্টস এজিং ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবকের সংখ্যা এখন ৩২০০ জনের বেশি। স্বপ্নটা ছড়িয়ে গেছে সবার মধ্যে। কি ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছে? শুনতে অদ্ভুত শোনাবে, প্রবীণদের নিয়ে কাজ করাটাই যেন আমাদের প্রতিবন্ধকতা। একজন সুবিধাবঞ্চিত শিশুর জন্য যতটা মানুষ এদিয়ে আসতে চায় প্রবীণদের জন্য সেভাবে মানুষ এগিয়ে আসতে চায় না। প্রবীণদের ‘বাতিল’ বলে আমরা নিজেরা ভুলে যাই। আমরাও একদিন প্রবীণ হব। দুঃখের বিষয় আমাদের মধ্যে এতটুকু সচেতনতাও তৈরি হয়নি যে আমরা প্রবীণদের কল্যাণে এগিয়ে আসব। প্রবীণদের সুরক্ষার জন্য সরকারের পদক্ষেপ কি যথেষ্ট বলে মনে করেন? বাংলাদেশ সরকার যথেষ্ট প্রবীণবান্ধব। প্রবীণদের জীবনমান উন্নয়নে অনেক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। এই ঘাটতিগুলো পূরণ না হলে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রবীণদের জীবনমান বেশ কঠিন হয়ে পড়তে পারে। তখন দেশে প্রবীণের সংখ্যা হবে মোট জনসংখ্যার ২২%। পদক্ষেপগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে কি করা যেতে পারে? শুরু করতে হবে গ্রাম থেকে। বার্ধক্য বীমা, সার্বজনীন পেনশন চালু করা সময়ের দাবি। নিরাপদ আবাসন এবং আধুনিক প্রবীণ নিবাস স্থাপন করা দরকার। প্রবীণদের কাছ থেকে আমাদের তরুণদের কত কিছু শেখার আছে। তাই ভাল সম্পর্কের গুরুত্বটা শেখাতে হবে। প্রবীণ নীতিমালা-২০১৩ বাস্তবায়নে সমাজ, সরকার, গণমাধ্যম সবাইকে যুক্ত করতে হবে। নীতিমালায় গণপরিবহনে প্রবীণদের জন্য ৩টি সিট সংরক্ষিত থাকার কথা বলা হলেও বাস্তবে এর ব্যবহার নেই। ব্যাংকে পেনশন তুলতে গেলে একজন বৃদ্ধ লোকের ধাক্কাধাক্কি করে লাইনে দাঁড়াতে হয়। আমরা কয়েকটি ব্যাংকের সঙ্গেও এসব নিয়ে কথা বলেছি। এগুলো চর্চার বিষয়। এ রকম চর্চাগুলো বাড়াতে হবে। আর কর্মসংস্থানের কথা তো প্রতিবারই বলছি। ডিজিটাল বাংলাদেশের সমস্ত কার্যক্রমে প্রবীণদের সম্পৃক্ত করতে হবে। আগামী ১০ বছরে আপনাদের লক্ষ্য কী? ক্রমশ বাড়তে থাকা ষাটোর্ধ্ব মানুষের সংখ্যার আরেক নাম সিলভার সুনামি। ২০৫০ সালে তরুণের থেকে প্রবীণের সংখ্যা বেশি হবে। এটার জন্য বড় প্রস্তুতি দরকার। আমি মনে করি একমাত্র সচেতনতাই এনে দিতে পারে প্রবীণ অধিকারের নিশ্চয়তা। সচেতনতা বৃদ্ধি, আধুনিক প্রবীণ নিবাস (যার জন্য স্থান খোঁজা হচ্ছে) করা, প্রবীণ উপযোগী কর্মসংস্থান, বৃদ্ধাশ্রম বিলুপ্ত করা, প্রবীণদের মাঝে যোগাযোগ বাড়ানো (একাকীত্ব বিষণœতা দূর করতে এটা খুব জরুরী) এবং তাদের স্বাস্থ্য সচেতন করে তোলা। প্রবীণদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়। একজন ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি প্রযুক্তির ফলে কিন্তু তার সময়ের গানগুলো শুনতে পারবেন। অবসরে এটা তাকে প্রশান্তি দিতে পারে। আধুনিক প্রযুক্তি তাদের কি দরকার! এ রকম একটা প্রবণতা আমাদের মাঝে দেখা যায়। তাই উদাহরণ দিয়ে বলা। নিজেদের সংগঠনের অপূর্ণতাগুলো কি কি? শুধু আমাদের না, যে কোন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের জন্য অর্থ একটি বিরাট সমস্যা। আমাদের ৮৫% সদস্য শিক্ষার্থী। সংগঠন মূলত তাদের মাসিক চাঁদাতেই চলছে। অর্থ সঙ্কটে অনেকবার পড়তে হয়েছে। তার পরও কাজ থেমে থাকেনি। সম্প্রতি স্পন্সরের মাধ্যমে মেডিক্যাল ক্যাম্পের মতো কাজে সফল হয়েছি। ঢ়ধৎবহঃং ধমবরহম ভড়ঁহফধঃরড়হ-এর কাছে সফলতার অর্থÑ একটি প্রবীণবান্ধব দেশ গড়ে তোলা। প্রবীণদের মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা। আমাদের সংগঠনের প্রতিটি সদস্য মনে করে প্রবীণরাও দেশের সম্পদ। তাই তাদের জীবনমান উন্নয়নের সুযোগ করে দিতে পারলে সেটা সার্বিকভাবে দেশেরই উন্নতি। সমাজসেবী সংগঠনগুলোর জন্য আপনার প্রত্যাশাÑ ব্যক্তিস্বার্থের ওপরে গিয়ে সবাই একসঙ্গে মানবতার সেবা করতে হবে। স্বাধীনতা যেমন সকলের সম্মিলিত চেষ্টায় এসেছে তেমনি সম্মিলিত যে কোন প্রচেষ্টায় দেশ বদলে যেতে পারে। সংগঠনগুলোর মধ্যে অন্ত-সহযোগিতা বাড়াতে হবে। কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান? ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে প্রবীণদের জন্য সেরা রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাই কারণ আজকের নবীনই আগামী দিনের প্রবীণ। তারুণ্যের কাছে কি প্রত্যাশা করেন? বার্ধক্যের অবহেলা থেকে রক্ষা করতে আগাম প্রস্তুতি এবং তরুণ অবস্থায় আশপাশের প্রবীণদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রত্যাশা করি। দেশে নবীন প্রবীণ মেলবন্ধন তৈরি করে অন্যদের উৎসাহ দেয়াও জরুরী। সবশেষে সবার মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত হোক এটাও প্রত্যাশা করি।
×