ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

শাকিল আহমেদ মিরাজ

ভারতীয় ক্রিকেটের মসনদে বাংলার দাদাবাবু

প্রকাশিত: ১২:২৩, ১৬ অক্টোবর ২০১৯

ভারতীয় ক্রিকেটের মসনদে বাংলার দাদাবাবু

বিশ্ব ক্রিকেটের অঘোষিত মোড়ল ভারত। মাঠ ও মাঠের বাইরে দেশটির আধিপাত্য এখন ওপেন সিক্রেট। আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল) যে বোর্ড অব কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়ার (বিসিসিআই) আজ্ঞাবহ সেটি নিয়েও খুব একটা দ্বিমত নেই। ক্রিকেট দুনিয়ায় অসীম ক্ষমতার আধার সেই সংস্থাটির সর্বোচ্চ পদে বসতে যাচ্ছেন এমন একজন যিনি বাংলায় কথা বলেন, বাংলাদেশ ও টাইগার ক্রিকেটের বড় ফ্যান। তিনি সৌরভ চন্ডিদাস গাঙ্গুলী, ওরফে সৌরভ গাঙ্গুলী, ওরফে ‘দাদাবাবু’। শুধু ওপার বাংলাই নয়, বর্ণিল জীবনে তার এই নতুন অলঙ্করণে বাংলাদেশ ক্রিকেটেও ছড়িয়ে দিচ্ছে বাড়তি আনন্দ। জল্পনা-কল্পনা আর নাটকীয়তার পর বিসিসিআইর মসনদে আসীন হচ্ছেন কলকাতার মহারাজ। নির্বাচনের এখনো এক সপ্তাহ বাকি। গত সোমবার ছিল আগ্রহী প্রার্থীদের মনোনয়ন পত্র জমা দেয়ার শেষ দিন। কিন্তু প্রতিদ্বন্দী প্রার্থী না থাকায় আগেই নিশ্চিত হয়ে যায় বিসিসিআইর অধিকর্তা হচ্ছেন সৌরভ। ৪৭ বছর বয়সী সৌরভ প্রাথমিকভাবে দায়িত্ব পাবেন দশ মাসের জন্য। সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে পরবর্তীতে আরও তিন বছরের জন্য তাঁকে একই পদে বহাল রাখা হবে। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড সংস্কারে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট গঠিত আরএম লোধা কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে দীর্ঘদিন ধরে বিসিসিআই পরিচালিত হচ্ছিল সিওএ (কমিটি অব এ্যাডমিনিস্ট্রেটরস) দিয়ে। যার সভাপতি সিকে খান্না ও প্রধান নির্বাহী রাহুল জহুরি। এবার বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর বোর্ড বিসিসিআইর মসনদে বসতে যাচ্ছেন বাংলার মহারাজ। সভাপতির পদে মূল লড়াইটি ছিল মুলত সৌরভ ও সাবেক প্রেসিডেন্ট এন শ্রীনিবাসন ঘনিষ্ঠ ব্রিজেশ প্যাটেলের সঙ্গে। কোন কোন মহলের ধারণা ছিল ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির ক্ষমতার বলয়ে ব্রিজেশই শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন। কিন্তু তাতে জল ঢেলে দেন ক্রিকেটের বাইশগজে ছড়ি ঘোড়ানো সৌরভ। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এক খবরে জানানো হয়, মুম্বাইয়ে বিসিসিআইর হেড কোয়ার্টারে রবিবার মধ্যরাতেই বিজেপির সভাপতি ও বর্তমান কেন্দ্রনী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে সৌরভের বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে যায়। সিকে খান্নার স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন বাংলার দাদা। ব্রিজেশকে ভারতীয় ক্রিকেটের আরও একটি বড় পদ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) গর্ভনিং কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সৌরভ বলেন, ‘আমি এই মনোনয়নে খুশি, কারণ এই মুহূর্তে বিসিসিআইÑএর ভাবমূর্তি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত এবং আমার কিছু করে দেখানোর এটা দারুণ সুযোগ। নির্বাচনে কেউ আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুন বা না করুণ, বিশ্বের বৃহত্তম ক্রিকেট সংগঠনের দায়িত্ব পাওয়াটা সবসময়ই বড় ব্যাপার। সবাই জানে ভারত ক্রিকেট দুনিয়ার পাওয়ার-হাউজ। সুতরাং আমার জন্য কাজটা চ্যালেঞ্জিং।’ তৃতীয় ভারতীয় অধিনায়ক হিসেবে বিসিসিআইর মসনদে বসতে যাচ্ছেন সৌরভ। ভিজিয়ানাগ্রাম মহারাজকুমার তথা ‘ভিজি’ ১৯৫৪ সালে প্রথম এই পদে আসীন হয়েছিলেন। যিনি ১৯৩৬ সালে ইংল্যান্ড সফরে দেশের হয়ে ৩টি টেস্ট ম্যাচে ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আরেক সাবেক অধিনায়ক সুনীল গাভাস্কার অবশ্য ২০১৪ সালে অন্তবর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে কিছুদিনের জন্য বিসিসিআইর প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। বর্তমানে বেঙ্গল ক্রিকেট এ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট জাতীয় দলের নেতৃত্বে ছিলেন ২০০০-২০০৫ পর্যন্ত। তার অধীনে ২০০৩ বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছিল ভারত। নজিরবিহীন আগ্রাসী মনোভাবের দৌলতে তাঁর জামানায় ভারতীয় ক্রিকেটে অধিনায়কত্বের সংজ্ঞাটাই পাল্টে দিয়েছিলেন সুপার সৌরভ। একইসঙ্গে বহুযুগ পর পাল্টে গিয়েছিল উপমহাদেশের বাইরে ভারতের টেস্ট খেলার ধরনও। আলোচিত-বিতর্কিত অনুরাগ ঠাকুর বিসিসিআই প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরে যাওয়ার পরই দেশটির ক্রিকেটের অনেক মহল থেকে জোরালোভাবে সৌরভের নাম উঠে আসতে থাকে। অবশেষে সেই দাবি পূরণ হওয়ার পথে। বিশ্ব ক্রিকেটের অঘোষিত মোড়ল ভারতীয় ক্রিকেট প্রশাসনে এবার ‘দাদাগিরি’ যুগ শুরু হওয়া ¯্রফে সময়ের অপেক্ষা। এদিকে বিসিসিআইর সচিব হচ্ছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর ছেলে জয় শাহ। কোষাধ্যক্ষ হতে চলেছেন বিসিসিআই সাবেক সভাপতি ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুরের ভাই অরুণ ধুমাল। খবর শুনে সৌরভকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিনন্দন জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি দে সর্বসম্মতভাবে নির্বাচিত হওয়ার জন্য সৌরভকে অভিনন্দন জানাই। সৌরভ ও তার দলের প্রতি অনেক অনেক শুভকামনা। ভারত ও পশ্চিমবঙ্গকে গর্বিত করেছ তুমি। বেঙ্গল ক্রিকেট এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবেও তোমার কাজে গর্বিত আমরা সবাই। এই মাঠেও তোমার দুর্দান্ত আরেকটা ইনিংসের অপেক্ষায় থাকলাম আমরা।’ টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর বাংলাদেশ অভিষেক ম্যাচটি খেলেছিল ভারতের বিপক্ষে। প্রয়াত জগমোহন ডালমিয়াসহ প্রতিবেশী দেশটির বেশ কিছু ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের ক্রিকেটকে উৎসাহ দিয়ে গেছেন এবং যাচ্ছেন। তবে ভারতের মাটিতে বাংলাদেশের সঙ্গে সিরিজ নিয়ে বিসিসিআইয়ের বিমাতাসুলভ অবস্থান দেখা গেছে দীর্ঘদিন। এবার বাঙালী বাবু সৌরভ হচ্ছেন বিসিসিআইয়ের প্রেসডেন্ট। এটা কি বাংলাদেশের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ হবে? রবিবার মুম্বাইয়ে বিসিসিআইয়ের অনানুষ্ঠানিক এক সভায় বিসিসিআইর কর্তাব্যক্তিরা একমত হয়েছেন যে, সাবেক সফলতম অধিনায়কের হাতেই দায়িত্ব তুলে দেয়া হবে। এখন শুধু আনুষ্ঠানিকতার বাকী। খেলোয়াড় এবং অধিনায়ক হিসেবে তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন সৌরভ। বাংলাদেশেও তার লাখো ভক্ত আছে। তাদের আশা, এবার হয়তো ভারতের মাটিতে উল্লেখযোগ্য হারে আমন্ত্রণ জানানো হবে বাংলাদেশকে। গত দুই বছর আগেও বিসিসিআইয়ের কর্মকর্তারা বলতেন, বাংলাদেশের বিপক্ষে হোম সিরিজে দর্শক হয় না। এটা তাদের জন্য আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই মনোভাবের কারণে টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার ১৭ বছরে ভারতের মাটিতে সাদা পোশাকে খেলতে পারেনি টাইগাররা। শেষ পর্যন্ত ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথমবারের মতো ভারতের মাটিতে এটিমাত্র টেস্ট খেলে বাংলাদেশ। এরপর আবার বিরতি। আগামী নভেম্বরে দুটি টেস্ট আর তিনটি টি২০ খেলতে ভারতে যাবে টাইগাররা। ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর অভিষেক টেস্ট থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ভারতের বিপক্ষে মাত্র ৯টি টেস্ট খেলেছে বাংলাদেশ। যার দুটি ড্র হয়েছে, বাকী ৭টিতে জিতেছে ভারত। নবাগত আফগানিস্তান আর আয়ারল্যান্ড ছাড়া টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অনেক কম সুযোগ পায় সাদা পোশাকে খেলার। পাশাপাশি ঘরোয়া ক্রিকেট নামে মাত্র হওয়ায় টেস্টে বাংলাদেশের অবস্থানের উন্নতি হচ্ছে না। এবার সৌরভ বিসিসিআইয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের আশা থাকবে, প্রতিবেশী দুই দেশের ক্রিকেটীয় সম্পর্ক আরও জোরদার হবে।
×