ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

মাঠের আন্দোলনে ইতি টানলেন শিক্ষার্থীরা

সন্ত্রাস-সাম্প্রদায়িকতা রুখে দেয়ার শপথ বুয়েটে

প্রকাশিত: ১০:৫৫, ১৭ অক্টোবর ২০১৯

সন্ত্রাস-সাম্প্রদায়িকতা রুখে দেয়ার শপথ বুয়েটে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আবরার হত্যার প্রেক্ষাপটে সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তি রুখে দেয়ার শপথ নিয়ে মাঠের আন্দোলনে ইতি টানলেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা। শপথবাক্যে তারা বলেছেন, এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির উত্থান আমরা সম্মিলিতভাবে রুখে দেব। অনুষ্ঠানে বুয়েট উপাচার্য, বিভিন্ন হলের প্রভোস্টরা শপথ নেন। অবশ্য মিলনায়তনে দর্শক সারিতে উপস্থিত শিক্ষকরা শপথ নেননি। তবে বুয়েট শহীদ মিনার ফলকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ছবি সংবলিত ডিজিটাল ব্যানারে লেখা ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’ থেকে ‘ছাত্রলীগ’ শব্দটি মুছে ফেলার ঘটনায় বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এর আগে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রশাসনের তৎপরতায় সদিচ্ছা দেখে মাঠের আন্দোলনে ইতি টানার কথা জানিয়ে শিক্ষার্থীরা খুনীদের স্থায়ী বহিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত ক্লাস পরীক্ষায় অংশ না নেয়ার ঘোষণা দেন। বুয়েট শহীদ মিনারে সংবাদ সম্মেলন থেকে আন্দোলনকারীরা এই ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, ‘তবে বুধবার বুয়েটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে এক ‘গণশপথে’ ক্যাম্পাসে সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তি রুখে দেয়ার বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবেন তারা। আর এর মধ্য দিয়েই তাদের মাঠের আন্দোলনের ‘আপাতত’ ইতি টানা হবে’। ঘোষণা অনুসারে বুধবার সকাল এগারোটার দিকে শিক্ষার্থীরা মিলনায়তনে জড়ো হন। দুপুর একটার দিকে হয় শপথ অনুষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ মিনারে শপথ গ্রহণের কথা থাকলেও বৈরী আবহাওয়ার কারণে অনুষ্ঠান হয় বুয়েট অডিটরিয়ামে। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে আবরার ফাহাদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। মঞ্চে বুয়েট উপাচার্য অধ্যাপক সাইফুল ইসলামসহ কয়েক শিক্ষকও শপথে অংশ নেন। তবে দর্শকসারিতে থাকা অন্য শিক্ষকরা শপথ নেননি। শপথ পড়ান বুয়েটের ১৭ তম ব্যাচের ছাত্রী রাফিয়া রিজওয়ানা। শপথে শিক্ষার্থীরা বলেন, এই আঙ্গিনায় যেন আর কোন নিষ্পাপ প্রাণ ঝরে না যায়, নিরপরাধ আর কেউ যেন অত্যাচারের শিকার না হয়, আমরা সবাই মিলে তা নিশ্চিত করব। নৈতিকতার সঙ্গে অসামঞ্জস্য সব ধরনের বৈষম্যমূলক অপসংস্কৃতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার আমরা সমূলে উৎপাটিত করব।’ শপথে আরও বলা হয়, প্রতিটি অন্যায়, অবিচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সবাই সর্বদা সোচ্চার থাকব। শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক একেএম মাসুদ, বিভিন্ন অনুষদের ডিন, বিভিন্ন হলের প্রভোস্টরাও এ সময় উপস্থিত ছিলেন। তবে সবাই শপথগ্রহণ করলেও শিক্ষকরা শপথ নেননি। শুধু প্রশাসনিক দায়িত্বে রয়েছেন যারা, তারা শপথ নেন। শপথ গ্রহণশেষে আন্দোলনকারী ছাত্র সায়েম বলেন, ধন্যবাদ জানাতে চাই। আমাদের দাবি মেনে নিয়ে তা বাস্তবায়নের দিকে যাওয়ার জন্য বুয়েট প্রশাসনকে। আজকে শপথের মাধ্যমে মাঠের আন্দোলন শেষ হলেও ১০ দফা দাবির বিষয়ে আমাদের পর্যবেক্ষণ চলবে। শপথগ্রহণ শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে উপাচার্য সাইফুল ইসলাম জানান, তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পরই আবরার হত্যায় জড়িতদের সবাইকে বুয়েট থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হবে। একক সিদ্ধান্তে কোন কিছু হবে না। তদন্ত প্রতিবেদন লাগবে, ডিন লাগবে, সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেব। আপনারা অধৈর্য্য হবেন না, কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। এদিকে বুয়েট শহীদ মিনারের ফলকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ছবি সংবলিত ডিজিটাল ব্যানারে লেখা ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’ থেকে ‘ছাত্রলীগ’ শব্দটি মুছে ফেলার ঘটনা নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মীর হাতে শিক্ষার্থী আবরার হত্যাকা-ের পর ক্যাম্পাসে সব ধরনের সাংগঠনিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের কক্ষ ও আহসানুল্লাহ হলে ব্যবহৃত ছাত্রলীগের অফিস কক্ষ সিলগালা করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ছবি সংবলিত ডিজিটাল ব্যানারের নিচে লেখা ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’ থেকে ‘ছাত্রলীগ’ শব্দটিও সাদা রং দিয়ে মুছে দেয়ার ঘটনায় অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে প্রগতিশীল শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মাঝে। ধারণা করা হচ্ছে রাতে এ অপরাধ করেছে ক্যাম্পাসে সক্রিয় সরকারবিরোধী কোন বিশেষ গোষ্ঠী। তবে এটি কে বা কারা করেছে সে সম্পর্কে কেউ নিশ্চিত করতে পারেননি। ফলকের মধ্যে ব্যানার দু’বছর ধরে এভাবেই চলছিল। এখন হঠাৎ করে সেটি মুছে দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে ক্যাম্পাসজুড়ে আলোচনা চলছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কেউ এ বিষয়ে কোন বক্তব্য দিতে চাননি। শিক্ষার্থীদের অনেকেই অভিযোগ করেছেন, আন্দোলন শুরু পর থেকেই সরকারবিরোধী উগ্রবাদী একটি গ্রুপ ফায়দা লুটতে সক্রিয় হয়েছে। এদের সঙ্গে শিক্ষকদের একটি অংশের যোগসাজশ আছে। যারা এসব অপকর্মে জড়িত, সিসিটিভি ফুটেজ দেখলেই সেসব অপরাধীকে চেনা যাবে। গুগল ম্যাপে ‘শহীদ আবরার হল’! বুয়েট শেরেবাংলা হলের নাম এখন ‘শহীদ আবরার হল’। আর হলের ভেতরে থাকা চারটি টয়লেট বা শৌচাগারের নামকরণ করা হয়েছে নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করা আবরার ফাহাদের খুনীদের নামে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বা সরকারীভাবে এমন নামকরণ করা না হলেও গুগল ম্যাপে অবকাঠামোগুলোর নাম দেখাচ্ছে এমনই। বুধবার সকাল থেকেই কোন স্থান খোঁজার জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিন গুগল ম্যাপে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের নাম পরিবর্তিত হয়ে দেখাচ্ছে ‘শহীদ আবরার হল’। হলের মসজিদের নাম হয়েছে ‘শহীদ আবরার হল মসজিদ’। এই হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে গত ৬ অক্টোবর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মারধরে নিহত হন আবরার ফাহাদ। নতুন করে নামকরণ করা হয়েছে হলের চারটি টয়লেটেরও। এর আগে এসব টয়লেটের কোন নাম না থাকলেও গুগল ম্যাপ বলছে, টয়লেটগুলোর নাম এখন ‘কিলার রবিন পাবলিক টয়লেট’, ‘কিলার অনিক সরকার পাবলিক টয়লেট’, ‘অপ্রেসার (নির্যাতনকারী) রাসেল পাবলিক টয়লেট’ ও ‘অমিত সাহা পাবলিক টয়লেট’। রবিন, অনিক, রাসেল, অমিত প্রত্যেকেই ফাহাদ হত্যাকা-ের প্রধান অভিযুক্ত। তবে এমন নামকরণের পেছনের রহস্য এখনও জানা যায়নি। সাধারণত গুগলের কমিউনিটি মেম্বারদের রেফার থেকে কোন বিষয়ে নামকরণ করা হয় গুগল ম্যাপে। তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গুগল কমিউনিটি মেম্বার থেকে এক বা একাধিক সদস্য স্থাপনাগুলোর এমন নামকরণ করে রেফার করেছেন। যা অনেকটা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই আপডেট হয়েছে গুগলের ম্যাপে। তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা, গুগল কর্মকর্তাদের নজরে এলে মুছে যাবে নতুন নামগুলো। আবরার হত্যা মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নেয়া হবে : আইনমন্ত্রী ॥ আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার চার্জশীট দেয়ার পর দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে প্রসিকিউশন। সচিবালয়ে তার দফতরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। আইনমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেছেন, আবরার হত্যা মামলায় যেই মুহূর্তে অভিযোগপত্র দেয়া হবে, তখন থেকেই মামলাটাকে দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য যেসব ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন সেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। আমি এ বিষয়ে ইতোমধ্যেই প্রসিকিউশন সার্ভিসকে এই মামলা হ্যান্ডেল করার জন্য তৈরি হওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। তিনি আরও বলেন, একটা ফৌজদারি মামলার প্রথম কাজ এজাহার দিয়ে শুরু হয়। এরপর তদন্ত। আপনারা জানেন, আবরার হত্যা মামলার তদন্ত শুরু হয়ে গেছে। আসামিরা অনেকেই গ্রেফতার হয়েছেন, অনেকে হত্যাকা- বিষয়ে তাদের স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। এই তদন্ত কিন্তু চলছে। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তদন্ত শেষ হলেই কিছুদিনের মধ্যে অভিযোগপত্র দেয়া হবে। আইনমন্ত্রী বলেন, দায়িত্ব দ্রুত পরিচালনার জন্য আমরা একটা টিম গঠন করেছি। সে হিসেবেই অভিযোগপত্র দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রসিকিউশন টিমকে মামলা রিসিভ করার জন্য আমি প্রস্তুত করছি। র‌্যাগিংয়ের মাধ্যমে যদি কোন অপরাধ করা হয় তা ধারা ৩২৩ অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী। বলেন, কেউ যদি র‌্যাগিংয়ের শিকার হয় আইনানুযায়ী নালিশ করলে র‌্যাগিংকারীকে শাস্তির আওতায় আনা হবে। আনিসুল হক বলেন, আপনারা সব সময় বলেন এটার ব্যাপারে আইন নেই, আইন থাকলেও পরিবর্তন করতে হবে। র‌্যাগিং কথাটার জন্য হয়তো আইন নেই, র‌্যাগিংয়ের মাধ্যমে যদি কোন অপরাধ করা হয় যদি থাপ্পড়ও দেয়া হয় সেটাও কিন্তু পেনাল কোডে অপরাধ হিসেবে ধারা ৩২৩ এ শাস্তিযোগ্য। র‌্যগিংয়ের কথাগুলো এখন উঠে আসছে- আপনাদের অনুরোধ করব যারা র‌্যাগিংয়ের ভিকটিম তাদের উৎসাহ দেবেন তারা যেন নালিশ করে। নালিশ করলে আমাদের যথেষ্ট আইন রয়েছে যেগুলোর আওতায় র‌্যাগিংয়ের মাধ্যমে করা অপরাধ আমরা বিচার করতে পারব। নিশ্চয়ই আমরা বিচার করব, বিচারিক প্রক্রিয়া হচ্ছে নালিশ করতে হবে।
×