ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সব্যসাচী দাশ

ঘুমন্ত শহরে অবিরাম বাজে রুপালি গিটার

প্রকাশিত: ১৩:২৪, ১৭ অক্টোবর ২০১৯

ঘুমন্ত শহরে অবিরাম বাজে রুপালি গিটার

ঘুমন্ত শহরে অবিরাম বাজে রুপালি গিটার। সত্যই প্রতি রাতে কোন না কোন শহরে আইয়ুব বাচ্চুর রেখে যাওয়া গিটারের টোন বেজে ওঠে! সঙ্গে তার শক্তিশালী কণ্ঠস্বর। গেয়ে যাচ্ছে নিরবধি। বিশেষ করে যখন উৎসবের আনন্দে পুরো দেশ উদ্ভাসিত হয়। আইয়ুব বাচ্চু তখন আমাদের কাছে অনিবার্য। এই তো গেল সপ্তাহে শেষ হলো সার্বজনীন দুর্গাপূজা। ছুটিতে দেশের বাড়িতে থাকায় পরিবারের সঙ্গে ভীষণ আনন্দে কেটেছে। কেবল এবার নয় বরাবরই পূজার ছুটিতে দেশের বাড়িতে থাকা হয়। বাড়ির পূজার বিশেষ অকর্ষণ থাকে ম-পের সামনে বড় স্টেজ করে স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনায় ব্যান্ডসঙ্গীতের আয়োজন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এলাকার সব মানুষ এই সঙ্গীত সন্ধ্যার অপেক্ষায় থাকেন। এবার নবমী পূজার দিন বাড়িতে যাই, সন্ধ্যায় পোশাক বদলে পূজা দেখতে বের হই এবং নিজেদের পূজাম-পের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু উপায় নেই। মানুষের এতবেশি সমাগম যে দূর থেকে ম-প কিংবা স্টেজ দেখাই দুষ্কর! শেষমেশ বন্ধুদের নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে গল্প করতে করতে শারদীয় উৎসব উপভোগ করছিলাম হাতে ঠা-া পানীয়Ñ এমন সময়ে কুড়ি-একুশ বছরের এক যুবক গিটার বাজিয়ে গেয়ে উঠলÑ ‘ঘুমন্ত শহরে রুপালি রাতে...লাইনটা শোনা মাত্র বুকের ভেতর হুহু করে উঠল। যে সময়টাতে দাঁড়িয়ে ওই তরুণ শিল্পীর কণ্ঠের আইয়ুব বাচ্চুর গাওয়া গান শুনছিলাম ঠিক তার সপ্তাহ খানেক পর তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। নিজে থেকে মনে হলো কি দুর্ভাগ্য আমাদের কত অল্প বয়সে সঙ্গীতের এই বরপুত্রকে আমরা হারিয়েছি। অথচ তার গাওয়া গান, বাজানো গিটারের টোন প্রতিদিনই আমাদের কানকে স্পর্শ করে যাচ্ছে। সত্যি বলতে কি শহর কি বন্দর আয়োজিত ব্যান্ডসঙ্গীতের অনুষ্ঠান মানেই আয়ুব বাচ্চুর গান। দর্শকদের মুহুর্মুহু করতালি কিংবা কান ফাটানো শিষ- পেতে হলে তার গান গাইতে হবে। আইয়ুব বাচ্চুর জীবদ্দশায় একাধিকবার তার কনসার্টে উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছে। নব্বইয়ের দশকে আমাদের দেশে ব্যান্ডসঙ্গীত সার্বজনীন রূপ পায়। সে সময় বয়সে কিশোর হলেও আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে আমাদের পরিচয় ছিল সমানে সমান। মনে হতো ব্যান্ড এল আর বি বুঝি আমাদের জন্যই কেবল মিউজিক তৈরি করছে। বছর চৌদ্দ আগের কথা ধানম-ির রবীন্দ্র সরবরে মাদকবিরোধী কনসার্টে গাইবেন ব্যান্ড লিজেন্ট আইয়ুব বাচ্চু। বন্ধু মারফত খবর পেলাম। সামনের সারিতে দাঁড়ানোর সুযোগ রেখে ফোন করল। দ্রুত চলে এলাম কনসার্ট প্রাঙ্গণে। তখন কেবল নবীন শিল্পীরা স্টেজে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসব অনুষ্ঠানে যেতে ভীষণ উত্তেজনা কাজ করতে বিশেষ করে যখন শুনতাম যে স্টেজে আয়ুব বাচ্চু, জেমস, কিংবা আজম খান গাইবেন সে সবের অনুভূতি এই বয়সে এসে ভাষায় ব্যক্ত করার শব্দ আমার ভা-ারে আপতাত নেই। সন্ধ্যার একটু পরেই লাইট বন্ধ করে এক আলো আঁধারি আবহাওয়ায় স্টেজে এলেন আইয়ুব বাচ্চু জীবনে ওই ছিল প্রথম এবির দর্শন! নিজের ভেতর কি যে রোমাঞ্চ কাজ করছিল বোঝানো যাবে না। প্রায় মিনিট পাঁচেক গিটারের টিউন বাজিয়ে গেয়ে উঠলেন হাঁসতে দেখ গাইতে দেখ...আহা! কনসার্টে অবস্থানরত মানুষের সমুদ্র তার সুরে দুলতে লাগল। সত্যই সে এক বাঁধন হারা উচ্ছ্বাস! নিজেকে দিয়ে উপলব্ধি করলাম তরুণ্যের রক্ত¯্রােতে আইয়ুব বাচ্চু কতটা প্রবাহিত। জীবনের দীর্ঘ সময় তার সঙ্গে আমরা একই সুরে গেয়েছি। সেই আইয়ুব বাচ্চুকে আমরা অকালে হারিয়ে ফেলেছি! দেখতে দেখতে তাও এক বছর হতে চলল। আগামীকাল শুক্রবার ১৮ অক্টোবর, আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। গেল বছর এমন উদাসী শরতকালে তার জীবনাবসান ঘটে। তার মৃত্যু খবর মুহূর্তে দেশের সব প্রান্তে বিষাদের আবহ তৈরি করে। দেশ-বিদেশ বরেণ্য কিংবদন্তি শিল্পী জেমস তখন ঢাকার বাইরে সরকারের উন্নয়ন কনসার্টে গান গাইছিলেন ঠিক সে সময় তার কাছে খবর আছে আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যু ঘটেছে। বাস্তববাদী জেমস সেদিন নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি, ক্যামেরার সামনে অঝরে কেঁদেছিলেন। সঙ্গে এবির ভক্তরা! ব্যান্ড শিল্পের মহীরুহ আইয়ুব বাচ্চু পৃথিবী ছেড়ে গেছেন আজ এক বছর হতে চলল, তার মৃত্যুর এই একটি বছর আসলে মূল কথা নয়। প্রতিটা বছর, প্রতিটা উৎসবে তার গান অনিবার্য। এসব ছাড়া জীবনের আর পাঁচটা সাধারণ দিন কিংবা নিঃসঙ্গ গভীর রাতে তার কণ্ঠে হরহামেশা শুনে যাব এখন অনেক রাত খোলা আকাশের নিচে/পৃথিবীর সকল আয়োজন আমায় ডেকেছে.. নতুবা সুখেরই পৃথিবী সুখেরই অভিনয় যতই আড়ালে রাখ আসলে কেউ সুখী নয়.. সত্যই আয়ুব বাচ্চুর মৃত্যু মানে আমাদের কাছে তার গেয়ে যাওয়া গানের অনন্তকালের সাক্ষী হওয়া।
×