ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ক্রিকেট নয়, ফুটবলই বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ॥ ফিফা সভাপতি ইনফান্তিনো

প্রকাশিত: ০৭:৫৫, ১৭ অক্টোবর ২০১৯

ক্রিকেট নয়, ফুটবলই বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ॥ ফিফা সভাপতি ইনফান্তিনো

স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ একদিনেরও কম সময় নিয়ে এক সংক্ষিপ্ত শুভেচ্ছা সফরে বাংলাদেশ ঘুরে গেলেন ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো। বিমানযোগে ঢাকা আসতে তিন ঘণ্টা ফ্লাইট দেরি হয় তার। ঢাকায় পা রাখেন বুধবার দিবাগত রাত ভোর ৪টারও অনেক পরে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে সবার অভ্যর্থনায় মুগ্ধতা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ ফুটবল দলের সাম্প্রতিক পারফরমেন্সেরও ভূয়সী প্রশংসা করেন। মঙ্গোলিয়া থেকে আসেন ইনফান্তিনো। ৪৯ বছর বয়সী এই শীর্ষ ফুটবল কর্মকর্তাকে স্বাগত জানান বাফুফে সভাপতি কাজী মোঃ সালাউদ্দিন, সহ-সভাপতি কাজী নাবিল আহমেদ ও ফিফা কাউন্সিলর সদস্য মাহফুজা আক্তার কিরণ। বিমানবন্দরে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ইনফান্তিনো বলেন, ‘সবাইকে শুভ সকাল, বাংলাদেশে আসতে পেরে আমি খুব আনন্দিত। ফিফা প্রেসিডেন্ট হিসেবে বলতে হচ্ছে, বাংলাদেশ আজ বিশ্ব ফুটবলের রাজধানী। কারণ ফিফা প্রেসিডেন্ট এখানে। এখানে ফুটবল নিয়ে এবং খেলাটির উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা হবে।’ বিকাল ৫টার পরে ঢাকা ছাড়েন ইনফান্তিনো, গন্তব্য লাওস। এই অল্প সময়ের সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের ভবনে পরিদর্শনে যান। সফর শেষ করেন ক্রীড়া সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা করে। খুব বেশিক্ষণ না থাকলেও বাংলাদেশ থেকে ভালো স্মৃতি নিয়েই ফিরছেন তিনি, ‘আমি খুবই আশাবাদী যে ভালো স্মৃতি নিয়ে ফিরতে পারবো এখান থেকে। আবহাওয়া দারুণ। অভ্যর্থনাও পেয়েছি চমৎকার। বাংলাদেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ ফুটবলের জন্য। এখানকার ফুটবলের উন্নয়নের জন্য অনেক কিছু করতে পারি আমরা।’ ১৯৮০ সালে ব্রাজিলের জোয়াও হ্যাভেলাঞ্জ। ২০০৬ এবং ২০১২ সালে সুইজারল্যান্ডের সেপ ব্ল্যাটার। এরপর ইনাফন্তিনো এলেন বাংলাদেশ সফরে। ফিফা সভাপতির সফর সঙ্গী হিসেবে ফিফা চারজন কর্মকর্তাও ঢাকায় আসেন। তারা হলেন : মাট্টিয়াস গ্রাফস্টর্ম (ডেপুট সেক্রেটারি জেনারেল), ওনোফ্রে কস্টা (চীফ অব কম্যুনেকেশন্স), সঞ্জিবান বালাসিংগাম (ডিরেক্টর অব মেম্বার এ্যাসোসিয়েশন এশিয়া এ্যান্ড ওশানিয়া) এবং ফেদেরিকো রাভিগ্লিওনে (প্রেসিডেন্টস’ অফিস ম্যানেজার)। ঢাকা ছাড়ার আগে ঢাকার প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে ক্রীড়া সাংবাদিকদের সঙ্গে এক সংবাদ সম্মেলনে মিলিত হন ফিফা সভাপতি। এখানে তিনি বলেন, ‘যতটা জানি বাংলাদেশে ফুটবল ছাড়াও আরও অনেক খেলা হয়। কিন্তু এখানে এসে ফুটবল নিয়ে সবার আগ্রহ এবং মিডিয়ার দারুণ কর্মতৎপরতা দেখে যারপরনাই বিস্মিত হয়েছি। সত্যি বলতে কি এতটা আশা করিনি। এ থেকে একটা ব্যাপার বুঝলাম, তা হলো এদেশের মানুষের হৃদয়ে আছে ফুটবল।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে ফিফা বস বলেন, ‘সকালে আপনাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছি। আমাদের ঘণ্টাখানেকের আলাপচারিতার পুরোটাই জুড়ে ছিল ফুটবল। যুব ও তৃণমূল ফুটবল এবং গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দক্ষিণ এশিয়ান ফুটবল আসরে বাংলাদেশের মহিলা ও পুরুষ ফুটবলের ঈর্ষণীয় সাফল্য নিয়েও অনেক কথা হয়েছে। কথা হয়েছে এদেশের ফুটবলের ভবিষ্যত উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়েও।’ বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে ইনফান্তিনো বলেন, ‘ফুটবলের শেষ কথা হলো জাতীয় দল। এর জার্সিটা হচ্ছে একটি আবেগী পোশাক। এটা পড়লেই অন্যরকম অনুভূতি হয়, আমারও হচ্ছে (ফিফা সভাপতির পরনে তখন বাফুফের উপহার দেয়া বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের জার্সি)। আমি জানি সম্প্রতি আপনারা প্রবল আবেগে আক্রান্ত হয়েছেন, যখন ফিফা বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে আপনাদের দল ভারতে গিয়ে তাদের বিরুদ্ধে দারুণ খেলে ১-১ গোলে ড্র করেছিল। ম্যাচটা বাংলাদেশ জিততেও পারতো। ফুটবল আশা জোগায়, ফুটবলে আসলে সবই সম্ভব। আমি মনে করি বাংলাদেশের ফুটবলের ভবিষ্যত খুবই উজ্জ্বল। কারণ এটা অনেক জনবহুল দেশ। চেষ্টা করলে ভাল ফুটবলার পাওয়া যাবেই। ফিফা এবং ইউয়েফা এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে যথাসম্ভব সাহায্য করবে। ফুটবল খেলায় যতটা আনন্দ পাওয়া যায়, তা অন্য খেলায় ততটা পাওয়া যায় না। স্কুলের বাচ্চাদের ফুটবল খেলা দেখলেই তা বুঝতে পারবেন।’ রসিকতার সুরে তিনি বলেন, ‘এতদিন ঢাকার বিখ্যাত ট্রাফিক জ্যামের কথা শুনেছি। আজ স্বচক্ষে দেখলাম। এজন্য আমি ধন্য!’ প্রশ্ন-উত্তর পর্বে ফিফা সভাপতি বলেন, ‘অন্যান্য দেশকে ফিফা যেমন ফুটবল উন্নয়নে সহায়তা করে, তেমনি বাংলাদেশকেও করে। বাংলাদেশের ফুটবল উন্নয়নের জন্য ফিফার কিছু পরিকল্পনা অবশ্যই আছে। শুধু পেশাদার লিগ নয়, বয়সভিত্তিক ফুটবলকেও প্রাধান্য দেয় ফিফা। ফিফার নীতি হচ্ছে সব দেশই যেন ভালোভাবে ও বেশি পরিমাণে ফুটবলটা খেলতে পারে (মহিলা পর্যায়েসহ) এবং সে দেশের সরকারও যেন ফুটবলের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। ফেডারেশনগুলোকেও এজন্য সক্রিয় হতে হবে। ধনী ব্যক্তিদের ফুটবলে পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে। এটাই ফিফা নিশ্চিত করতে চায়।’ বাংলাদেশের জনপ্রিয় খেলা প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি এটা মানতে রাজী নই, বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট। এই খেলায় বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সাফল্য একেবারেই কম। তাও আবারও মাত্র গোটা দশেক দেশের খেলে। ক্রিকেট অনেক নিয়মকানুনের খেলা, ঘন ঘন নিয়ম বদলায়, সবাই তা বোঝেও না। ফুটবল অনেক সহজ নিয়মের খেলা। সবাই তা বোঝে। এই খেলা অনেক উত্তেজনাময়, হৃদকম্পন বাড়িয়ে দেয়। আসলে শুধু বাংলাদেশই নয়, ফুটবল পুরো বিশ্বেরই এক নম্বর খেলা। এখানে ক্রিকেট বহু ব্যবধানে পিছিয়ে। যে নীতিতে ক্রিকেট চলে, তাতে ক্রিকেটের কোন চান্সই নেই! সত্যি বলতে কি, ক্রিকেটের মতো লম্বা ও বিরক্তিকর খেলা কখনই ফানি গেম হতে পারে না, বরং ফুটবলই হচ্ছে ফানি গেম।’ ইনফান্তিনো আরও যোগ করেন, ‘বিশ্বকাপ ফুটবল বাছাই খেলে ২১১ দেশ। চ্যাম্পিয়ন হয় একটি দেশ। তার মানে এই না বাকি ২১০ দেশই খারাপ খেলে। ২১০ দেশেরও ক্ষমতা আছে একদিন চ্যাম্পিয়ন হওয়ার। ফিফা চায় ফুটবল খেলাটা যেন বিশ্বের সর্বত্র চর্চা হয়। এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে টেলিভিশন সম্প্রচার। টিভিতে সরাসরি খেলা দেখানোর বিধিনিষেধ এবং নিয়মকানুন আরেকটু সহজ করার কথা ভাবছে ফিফা।’ সাফ অঞ্চলে বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে বলেন, ‘একসময় বিশ্ব ফুটবলটা ফোকাস করা হতো ইউরোপ এবং আমেরিকা মহাদেশে। এখন আর সেই দিন নেই। এজন্যই ২০২২ সালে কাতারে বিশ্বকাপ হবে। সাফ অঞ্চলের প্রতিটি দেশই যদি ফুটবলে শক্তিশালী হয়, তাহলে হয়তো একদিন এই অঞ্চলেও বিশ্বকাপ আয়োজিত হতে পারে। এ ব্যাপারে ভাল বলতে পারবেন কাজী সালাউদ্দিন, কারণ তিনিই তো এই অঞ্চলের বস (হেসে)!’ বাংলাদেশের ফুটবল সম্পর্কে ধারণা? ‘সত্যি বলতে কি, খুব একটা ধারণা নেই। তবে জানি এখানে প্রিমিয়ার লিগে প্রচুর আফ্রিকানসহ অনেক ভালোমানের বিদেশী ফুটবল খেলে। আমি জামাল ভুঁইয়াকে চিনি। তিনি ডেনমার্কে জন্ম নেয়া বাংলাদেশী। দারুণ খেলোয়াড়। চিনি ঝাঁকড়া চুলের অধিকারী হামজাকে, যিনি ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলেন। এরা বাংলাদেশের আগামী দিনের ফুটবলারদের জন্য আদর্শ।’ ইনফান্তিনোর অভিমত। বিশ্ব ফুটবলে বর্ণবাদ নিয়ে ফিফা বরাবরই কঠোর। এটা ইউরোপেই বেশি হয়। এটা ফিফা কখনই বরদাশত করবে না। প্রয়োজনে আরও কঠোর হবে ফিফা এটা দমনে ... এমনটাই জানান ইনফান্তিনো। সবশেষে ফিফা বস শেষ করেন এই বলে, ‘আশা করি কাতার বিশ্বকাপ সফল হবে এবং বিপুল সংখ্যক দর্শক-পর্যটক দেশটিতে সফর করবেন।’
×