ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

স্মার্টফোন- গ্রামোফোন টুইনওয়ান ভিসিআরকে পাঠিয়েছে জাদুঘরে

প্রকাশিত: ১০:৫৮, ২১ অক্টোবর ২০১৯

 স্মার্টফোন- গ্রামোফোন টুইনওয়ান ভিসিআরকে পাঠিয়েছে জাদুঘরে

সমুদ্র হক ॥ নদীর নাম সই অঞ্জনা/নাচে পাখি খঞ্জনা সই/পাখি তো নয় সে যে কালো আঁখি... আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠের এই গান শুনতে লোকে হুমড়ি খেয়ে পড়ত কলের গানের সামনে। একটু যারা ছোট তারা খোঁজাখুঁজি করত কলের গানের এই চোঙের ভেতরে গাইয়ে লোকটি ঢুকেছে কিভাবে? চোঙের ওপর আঁকা কুকুরের ছবি-সেখানে লেখা এইচএমভি, হিজ মাস্টারস ভয়েস। প্রভুভক্ত কুকুরটা বুঝিবা খুঁজছে তার গাইয়ে মুনিবকে। কলের গান মানে গ্রামোফোন। আজ অতীত। হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে আগের দিনে বাস স্টার্ট দেয়া হতো তেমনি হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে সচল করা হতো কলের গানের রেকর্ডার। ছোট্ট চিকন আলপিনটা বসিয়ে দিলেই বেজে উঠত গ্রামোফোন। শোনা যেত হেমন্ত, সতীনাথ, মান্না দে, তালাত মাহমুদের গান: লতা, আশা, ফিরোজা বেগমদের গাওয়া নস্টালজিক গান... কে এল সায়গল মোহাম্মদ রফি, মেহেদি হাসানদের দরাজ গলার গান প্রবীণদের কাছে আজও স্মৃতিকাতর। নতুন প্রজন্মের শিশুরা এসব শুনে রূপকথার গল্পই যেন শোনে। একবিংশ শতাব্দীতে ওদের প্রিয় থার্টি ইন ওয়ান (কখনও আরও বেশি স্মার্টফোন) একদার ঘড়ি, ক্যালেন্ডার, স্টপওয়াচ, টর্চ, ক্যালকুলেটর ছবি তোলার স্থির ক্যামেরা, ভিডিও ক্যামেরা সবই স্মার্টফোনে বন্দী। টিভি ভিসিআরকে জাদুঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে স্মার্টফোন। বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে ছাদের এরিয়াল ও চৌকোনা বড় ব্যাটারির সংযোগে রেডিও, ষাটের দশকের শুরুতে টর্চের ব্যাটারি সংযোগে ট্রানজিস্টারে খবর শোনার জন্য কতই না কৌতূহল। বড় চাকার (স্পুল) টেপ রেকর্ডার, ছোট পিনের স্পর্শে রেকর্ডে গান শোনার গ্রামোফোন ছিল বনেদি পরিবারের বাড়িতে। বেশি পরিচিতি কলের গান। এরপর ছোট ক্যাসেটে এলো রেকর্ডার। একই সঙ্গে রেডিও ও গান শোনার যন্ত্র হলো ‘টু ইন ওয়ান’। রঙিন টিভি, ভিডিও রেকর্ডার (ভিসিআর) আরও কত কি! প্রজন্মের শিশুদের সামনে সেসব দিনের কথা বলার সময় প্রবীণরা নস্টালজিক হয়ে পড়েন। শিশুদের সামনে ডিজিটাল ডিভাইসের স্মার্টফোন। রেডিও, ঘড়ি, ক্যালেন্ডার, স্টপ ওয়াট, টর্চ, ক্যালকুলেটর, ডিকশনারি, ছবি ধারনের স্থির ক্যামেরা, ভিডিও ক্যামেরা, সিনেমা দেখা, অডিও ও ভিডিওর গান শোনা, অনুষ্ঠান ধারণ, টিভি দেখা, ইন্টারনেট সংযোগে প্রবাসী স্বজনদের সঙ্গে ভিডিওতে কথা বলা, সোস্যাল নেটওয়ার্কে যুক্ত থেকে বিশে^র খবর জানা, দেশ বিদেশের বন্ধুদের সঙ্গে চলমান ছবিতে দেখা সাক্ষাত কত কী যে ঢুকেছে তার ইয়ত্তা নেই। প্রজন্মের শিশুদের সামনে পৃথিবী মানে গ্লোবাল ভিলেজ। ‘পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল। কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল.../সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি.../সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি/আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে আমি যেন সেই কাজ করি ভাল মনে... ’ শিশুশিক্ষা পুস্তকের এসব ছড়া কবিতা কি জানে আজকের শিশু। অংকের ধারাপাত বই আর নেই। শিশু শিক্ষা ও ধারাপাত ছিল শিশুদের জীবন গড়ার শিকড়ের পাঠ। হাতেখড়ি হতো এই বই দিয়ে। চারপাশ কাঠের বাঁধনে পাথরের শ্লেটে চিকন পেনসিল ছিল লেখার উপকরণ। এখন নেই। ঝরণা কলম নেই। এসব কলমের নিচের অংশে কালি ভরে উপরের নিবের সঙ্গে যুক্ত করে প্যাঁচ দিয়ে এঁটে লিখতে হতো। তারও আগে চিকন কঞ্চি ও পাখির পালকের আগায় নিবের মতো কেটে দোয়াতে চুবিয়ে লিখতে হতো। ট্যাবলেট পানিতে গুলিয়ে তরল কালি তৈরি হতো। অবশ্য দোয়াতে ভরা কালি পাওয়া যেত। দোয়াত-কলমের নামই শোনেনি অনেক শিশু। অতীতে শহরের ফটো স্টুডিওতে পাসপোর্ট সাইজের ছবি ছাড়াও শখের ছবি পারিবারিক ছবি বিয়েশাদির ছবি তোলা হতো সাদাকালো ফিল্মে। বারোটি ফিল্মের ১২০ ক্যামেরা, এরপর ৩৫ মিমি ফিল্মের ৩৬ ছবির ক্যামেরা, সাদাকালো ফিল্মের পর এলো রঙিন ফিল্মে ছবি তোলা। পারিবারিক অনুষ্ঠানে স্টুডিওর ক্যামেরাম্যানকে ডাকা হতো। স্থির চিত্রের পর ঢাউস সাইজ ক্যাসেটে ভিডিও ক্যামেরায় ছবি। এগুলো আর নেই। স্থির ও ভিডিও চিত্রের ফিল্মই নেই। ওসব ক্যামেরা উঠে গিয়ে এসেছে হাই ডেফিনেশনের (এইচডি) পিক্সেলের হিসেবে চিপস মেমোরি কার্ডের স্থির ও ভিডিও ক্যামেরা। সহযোগী হয়ে এসেছে উন্নত স্মার্টফোন। ডিজিটাল ডিভাইসে বেশি জিবি হিসাবের উন্নত স্মার্ট ফোন এসেছে। সেখানে মেমোরি কার্ডেরও দরকার পড়ে না। টেলিভিশন এখনও টিকে আছে। কে জানে কতদিন টিকবে! স্মার্ট ফোনে বায়োস্কোপ এ্যাপলিকশনে টিভি চ্যানেলগুলো দেখা যাচ্ছে। গুগলের ইউটিউব (গুগল ইউটিউব কিনে নিয়েছে) এই পথে নামছে। নাটক সিনেমা গানসহ সবই এখন মিলছে ইউটিউবে। কোন কিছু মিস করলে ইউটিউবে পাওয়া যাচ্ছে। পার্থক্য টিভির বড় পর্দায় নয় হাতের মুঠো পর্দায়। লেখার যন্ত্র টাইপ রাইটার রিপ্লেস হয়েছে কম্পিউটারে। একটা সময় ছাপাখানায় সিসার অক্ষরে কম্পোজ হতো। সের দরে সিসার অক্ষর কিনতে হতো। এখন সবই কম্পিউটারে। টেলিগ্রাম অতীত। পোস্টমাস্টারদের টেলিগ্রামের টরেটক্কা শব্দে (মোর্স সঙ্কেত) বার্তা লেখার দিন ফুরিয়েছে। টেলিফোন উঠে যাচ্ছে। অতীতে পেন্ডুলাম দোলানো দেয়াল ঘড়ি ছিল। সপ্তাহে একদিন চাবি দিলে সাত দিন চলতো। প্রতি ঘণ্টায় বাজতো। ‘দম দেয়া ঘড়ি’ নামেও পরিচিতি ছিল। ছিল পকেট ঘড়ি। বয়স্করা একটি চেনের সঙ্গে ঘড়ি এঁটে জামার বুক পকেটে রাখতেন। গ্রামে মাটির কলস চোখে পড়ে না। কাঁসার বাসন কোসনের ব্যবহার নেই। বিয়েশাদির অনুষ্ঠানে কাঁসার বাসন উপহার দেয়া হতো খোদাই করে নাম লিখে। আজকের দিনে এসবই স্মৃতি। সুরমাদানি, কাজলদানি প্রায় প্রত্যেক ঘরেই ছিল। সর্ষের তেলে সলতে চুবিয়ে আগুন ধরিয়ে শিখার সঙ্গে উদগীরিত কালো ধোঁয়া ভরে রাখা হতো কাজলদানিতে। কারও নজর যাতে না লাগে সেজন্য নবজাতকের কপালের পাশে কাজলের টিপ দেয়া হতো। নিজের সৌন্দর্যের জন্য চোখে কাজল দিত মেয়েরা। দানিতে ভরে রাখা সুরমা চিকন কাঠি দিয়ে চোখের নিচের অংশে টেনে দেয়া হতো। বিয়েশাদির অনুষ্ঠানে বর আর ঈদের দিনে ছেলেদের সুরমা পরা ছিল রেওয়াজ। কত কি যে পরিবর্তন হচ্ছে। কোন কোনটি আবার ফিরেও আসছে। যেমন হাতলওয়ালা কাঠের চেয়ার, কাঠের আলমারি নতুন ধারায় আসছে। চিকন গুনার জালের মিটসেফ নেই। শিল-পাটার দিন ফুরিয়েছে, এসেছে ব্লেন্ডার মেশিন। কুপি লণ্ঠন কিছু আছে তাও বিদায়ের পথে। চার্জার বাতি বিদায় করেছে হারিকেনের চিমনি। এভাবে আমাদের চিরচেনা সেই ব্যবহার্য অনেক জিনিস চোখের সামনে দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে, আবার একই জিনিস ভিন্নভাবে অতি আধুনিক হয়ে এসেছে। পুরানো জিনিস রয়ে যাচ্ছে স্মৃতির এ্যালবামে।
×