ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৯:১৭, ২২ অক্টোবর ২০১৯

ঢাকার দিনরাত

জ্বালানি শক্তি হিসেবে এখন পর্যন্ত কয়লা এবং পেট্রোলিয়ামের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করার ফলে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে। এই তথ্য সচেতন মানুষেরই জানা। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে যে, যদি সরকারগুলো নিঃসরণ কমানোর প্রতিশ্রুত মাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হয় তবু চলমান পরিস্থিতি ২১০০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক গড় উষ্ণতা ৩.৪ ডিগ্রী বৃদ্ধির দিকে নিয়ে যেতে পারে। এক শ’ বছর ধরে তিন দশমিক চার ডিগ্রী বাড়ায় পরিবেশবাদীরা গোটা বিশ্বে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন। আর আমাদের এই ঢাকা শহরে মাত্র দুই দশকেই তাপমাত্রা বেড়ে গেছে চার থেকে সাড়ে পাঁচ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত। খোলাসা করেই বলি। গত সপ্তাহে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর গবেষণা অনুযায়ী গত ১৮ বছরে ঢাকা শহরের ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা চার থেকে সাড়ে পাঁচ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভাটারা এলাকায়। নগর পরিকল্পনাবিদের মতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা দশমিক ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস বাড়লেই আবহাওয়ায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়। আর মাটির তাপমাত্রা ১ ডিগ্রী বাড়লেই জনজীবনে ব্যাপক অস্বস্তি সৃষ্টি হয়। সেখানে ৪-৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়া খুবই আশঙ্কাজনক। এর নেতিবাচক প্রভাব আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সব ক্ষেত্রেই পড়বে। ঢাকা শহরের মাটির তাপমাত্রা এত বাড়ার কারণ সম্পর্কে নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি শহরে শুধু ঘরবাড়িই থাকবে না, প্রয়োজন অনুযায়ী কৃষি জমি, সবুজ অঞ্চল, উন্মুক্ত স্থান ও জলাধার রাখতে হবে। কিন্তু ঢাকা শহরে কৃষি জমি অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। জলাধার যা ছিল তারও বড় একটি অংশ ভরাট করা হয়েছে। এতে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়েছে। গবেষণা অনুযায়ী ১৯৯০ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা শহরে ভূপৃষ্ঠের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯ দশমিক ৯৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২৪ দশমিক ১১ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এই সময়ে ঢাকার ৮০ শতাংশের বেশি এলাকার মাটির তাপমাত্রা ১৫-১৮ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে ছিল। আর ২০০০ সালের জানুয়ারিতে মাটির তাপমাত্রা সর্বনিম্ন ১৪ দশমিক ৭১ এবং সর্বোচ্চ ২৩ দশমিক ২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস ছিল। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা হয় ১৮ দশমিক ৮০ এবং সর্বোচ্চ হয় ২৮ দশমিক ৭৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এখন ঢাকার ৮০ শতাংশের বেশি এলাকার মাটির তাপমাত্রা ২১-৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে। ঢাকাবাসীর জন্য এটা যে অশনি সঙ্কেত তাতে কোন সন্দেহ নেই। ২৪ ঘণ্টা বিলম্বে হেমন্তের আগমন বাংলাদেশে হেমন্ত শুরু হয় আশ্বিনের শেষ দিনটি বিদায় নিলেই, অর্থাৎ কার্তিক এলে। আমরা অনেকেই জানতাম না যে, পঞ্জিকা সংস্কার করা হয়েছে চলতি বছর। তাই এবারের আশ্বিন ৩০ নয়, ৩১ দিনে হয়েছে। ফলে হেমন্ত এলো ২৪ ঘণ্টা বাদে। অথচ ভেবে নিয়েছিলাম কার্তিক চলে এসেছে বুধবারেই। পুলকিতও হচ্ছিলাম এটা ভেবে যে, ঢাকার সকাল হেমন্তকে স্বাগত জানানোর জন্য অভিনব পন্থা গ্রহণ করেছে। সেটা কি? ঢাকার আকাশ মেঘে ছেয়ে গেল সকালেই এবং তুমুল জলধারা নেমে এলো। রীতিমতো আষাঢ়ে বর্ষার রূপ যেন। সে কী উচ্চশব্দ বৃষ্টির। বৃষ্টি বিরতি দিলে অফিসের উদ্দেশে বের হলাম। যানজটের কারণে দেড়-দু ঘণ্টা লাগে ২৫ মিনিটের পথ। অফিসের কাছে এসে দেখি রোদে ভেসে যাচ্ছে চারদিক, কিন্তু তার ভেতর বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টিও হচ্ছে। সে দেখার মতোই দৃশ্য বটে। শরতের পর কার্তিক-অগ্রহায়ণ মিলে হেমন্ত। নতুন ঋতুর আগমনে রূপ বদলায় প্রকৃতি। হেমন্তকে বলা হয় শীতের বাহন। প্রকৃতিতে অনুভূত হচ্ছে শীতের আমেজ। গ্রামীণ জনপদে এখন হালকা শীতের আমেজ। ঢাকায় ভোরবেলা একটু শীত শীত লাগছে বৈকি। পাতলা চাদর টেনে নিচ্ছেন গায়ের ওপর অনেকেই। কবি জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কবিতা ‘বনলতা সেন’। হেমন্তের চিত্র কবিতায় এমন- সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতো সন্ধ্যা নামে/ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলেছিল/ পৃথিবীর সব রং মুছে গেলে পা-ুলিপি করে আয়োজন/ তখন গল্পের তরে জোনাকির রং ঝিলমিল/ সব পাখি ঘরে আসে সব নদী ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন/ থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।’ আবহাওয়াবিদদের মতে এখন থেকে যত দিন যাবে ততই সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য কমতে থাকবে। পার্থক্য যত কমবে তত শীত আসতে থাকবে। উত্তরের হিম হিম বাতাসে শুষ্ক হয়ে আসবে শরীর। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে এখন প্রকৃতি যেন আর নিয়ম মানছে না। কেমন খামখেয়ালী হয়ে উঠেছে। সুসংবাদ আরও দুটি মেট্রোরেল ঢাকায় আরও দুটি মেট্রোরেল স্থাপনে ৯৩ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা ব্যয়ে পৃথক দুটি প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি একনেক। এটিকে সুসংবাদ বলব অবশ্যই। যদিও সুসংবাদটি বাস্তব রূপ নিতে সময় লাগবে বেশ, তখন নগরবাসীও যাবেন বিবিধ ভোগান্তির ভেতর দিয়ে। বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর স্টেশন এবং নতুনবাজার থেকে পূর্বাচল ডিপো পর্যন্ত ৩১ দশমিক ২ কিলোমিটার মেট্রোরেল স্থাপনে ‘ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (লাইন-১)’ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। চলতি বছরে শুরু হয়ে ২০২৬ সালের মধ্যে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার গঠিত ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। অন্যদিকে অনুমোদিত হেমায়েতপুর-আমিনবাজার-গাবতলী-মিরপুর ১-মিরপুর ১০-কচুক্ষেত-বনানী-গুলশান ২-নতুনবাজার-ভাটারা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার এমআরটি লাইন-৫ বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪১ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা। এই প্রকল্পে জাইকা ঋণ দিচ্ছে ২৯ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। এই লাইনের সাড়ে ১৩ কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ (আমিনবাজার থেকে ভাটারা পর্যন্ত) এবং সাড়ে ৬ কিলোমিটার (হেমায়েতপুর থেকে আমিনবাজার পর্যন্ত) এলিভেটেড আকারে স্থাপন করা হবে। এমআরটি লাইন-৫ প্রকল্পটিও চলতি বছর শুরু হয়ে ২০২৮ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী অনুশাসন দিয়ে বলেছেন, মেট্রোরেল বাস্তবায়ন করতে গিয়ে হাতিরঝিলের সৌন্দর্য নষ্ট করা যাবে না। এছাড়া ধানম-ি ও আশপাশের এলাকার জন্য মেট্রোরেল তৈরির পরামর্শও দেন তিনি। বর্তমানে বাহাদুর শাহ পার্ক পুরান ঢাকার সদরঘাটের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক বাহাদুর শাহ পার্ক। এর পশ্চিমে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং উত্তর-পশ্চিমে জেলা আদালত অবস্থিত। আগে এর নাম ছিল ভিক্টোরিয়া পার্ক। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবে শহীদ বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে সিপাহী যুদ্ধের ঐক্যের প্রতীক বাহাদুর শাহ জাফরের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় বাহাদুর শাহ পার্ক। কাগজপত্রে নাম ‘বাহাদুর শাহ’ পার্ক হলেও বেশিরভাগ মানুষ এখনও একে ভিক্টোরিয়া পার্ক নামেই চেনে। বাহাদুর শাহ পার্কের বিভিন্ন সময় নামের পরিবর্তনটা কিন্তু বেশ চমকপ্রদ। ১৮ শতকের শেষভাগে এখানে আর্মেনীয়দের একটা ক্লাব ছিল। তারা সেখানে বিলিয়ার্ড খেলত। বিলিয়ার্ডের সাদা গোল বলগুলো ডিমের মতো দেখতে বলে স্থানীয় বাঙালীদের চোখে ছিল অদ্ভুত রকমের ‘ডিম’- যা আবার লাঠি দিয়ে ঠেলে খেলতে হয়। সুতরাং তারা এই ক্লাবের নাম দিল ‘আন্ডাঘর’। ধীরে ধীরে অপভ্রংশ হয়ে আন্ডাঘর উচ্চারিত হয় ‘আন্টাঘর’ নামে। পরবর্তীকালে আর্মেনীয়দের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়লে তারা ক্লাবটা বিক্রি করে দেয় ইংরেজদের কাছে। ইংরেজরা ক্লাবঘরটা ভেঙ্গে একে খোলা পার্ক বানিয়ে ফেলে। তখন এটা পরিচিত হয়ে ওঠে ‘আন্টাঘর ময়দান’ নামে। পার্কের চারদিক লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা ছিল আর ছিলো চারকোনায় চারটি দর্শনীয় কামান। আন্টাঘর ময়দানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ঢাকার নবাব আব্দুল গনি ও নবাব আহসান উল্লাহ। এরপর ১৮৫৮ সালে কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটে। রানী ভিক্টোরিয়া ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণ করার পর এই ময়দানেই সেই সংক্রান্ত একটি ঘোষণা পাঠ করে শোনান তৎকালীন ঢাকা বিভাগের কমিশনার। তারপর থেকে আন্টাঘর ময়দানের নামকরণ হয় ‘ভিক্টোরিয়া পার্ক’। পরে বাহাদুর শাহ জাফরের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় বাহাদুর শাহ পার্ক। এই পার্কের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারলাম আহসান জোবায়েরের প্রতিবেদন থেকে। তিনি লিখেছেন, ‘নতুন সাজে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে দীর্ঘদিন অব্যবস্থাপনায় পড়ে থাকা সিপাহী বিদ্রোহের স্মৃতিবিজড়িত পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক বাহাদুর শাহ পার্ক। পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পার্কটি সংস্কারের উদ্যোগ নেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। একটি প্রকল্পের আওতায় বাহাদুর শাহ পার্ক তিন মাসের মধ্যে ঢেলে সাজানোর প্রস্তাবনা ছিল। কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারিত সময়ের চেয়ে আরও চার মাস পেরিয়ে গেলেও কাজের কোন অগ্রগতি নেই। পার্কের উন্নয়ন কাজের ৩০ শতাংশও শেষ হয়নি এখনও। সংশ্লিষ্টরাও বলতে পারছে না কবে শেষ হবে পার্কের কাজ। এদিকে পুনঃসংস্কার ও সৌন্দর্য বাড়ানোর উন্নয়ন কাজের জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন তিন মাসের জন্য পার্কে জনসাধারণের প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দেয়। কিন্তু সাত মাস পার হলেও এখনও জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়নি পার্কটি। এতে সমস্যায় পড়ছেন প্রাতঃভ্রমণকারীরা।’ ইতিহাসের পাতায় আবার ফিরে যাচ্ছি। সিপাহী বিদ্রোহের প্রতি সম্মান জানাতে তাই এই পার্কটির নাম ভিক্টোরিয়া পার্কের বদলে বাহাদুর শাহ পার্ক রাখা হয়েছিল। এই পার্কে এক সময় অনেক পামগাছ ছিল। সেই পামগাছের সারিতেই ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় ঢাকায় ধরা পড়া বিদ্রোহীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। বিদ্রোহীদের মধ্যে একজন নারীও ছিলেন। এখন অবশ্য সেই পুরনো গাছগুলোর কোনটাই আর অবশিষ্ট নেই। সব কেটে ফেলা হয়েছে। সংস্কারের নাম করে দীর্ঘদিন ধরে পার্কটি বন্ধ করে রাখা হয়েছে। ভিতরের কাজেরও কোন অগ্রগতি নেই। এতে করে এলাকাবাসী বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এ পর্যন্ত পুরান ঢাকায় যতগুলো প্রকল্প হাতে নিয়েছে তার কোনটিই কি নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয়েছে? ঐতিহাসিক এই পার্কের কাজে গতি আসুক- এই প্রত্যাশা করছি। ২০ অক্টোবর ২০১৯ [email protected]
×