ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ উন্নয়ন নিরাপত্তা ও শান্তি হোক সমার্থক

প্রকাশিত: ০৯:১৮, ২২ অক্টোবর ২০১৯

সিডনির মেলব্যাগ ॥ উন্নয়ন নিরাপত্তা ও শান্তি হোক সমার্থক

সে দিন এক টক শোতে উপস্থিত ছিলেন মীজান সাহেব, যিনি যুবলীগ করার জন্য ভিসি পদ ছাড়তে রাজি। তাঁর কথা শুনে বুঝলাম, দেশে শান্তি আর উন্নয়ন এক সঙ্গে চলতে পারছে না। সম্মানিত লোকজন করছে অসম্মানের কাজ। কে কার বিচার করবে? কে দেবে ন্যায়? বিচার বিষয়টা এখন এমন, আপনি কাউকে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখলে আপনার কিচ্ছু হবে না। বিশেষত সে মানুষটি যদি সংখ্যালঘু এমনকি নিরীহ সংখ্যাগুরুও হয়, আপনি নিশ্চিত থাকুন কেউ আপনাকে কিছু বলবে না। বলবে না বলতে কয়েকদিন খুব হৈচৈ হবে। সারাদেশের কোমলমতি মানুষ, বিবেকবান মানুষেরা এসে রাজপথে দাঁড়াবেন। এমনও হতে পারে, একজন টিচার যখন কানে ধরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়, তখন মন খারাপ করা ছাত্রছাত্রীরা দেশের শিশুরা নিজেদের কান ধরে দাঁড়িয়ে তাদের আবেগও জানাতে পারে। কিন্তু ভাববেন না এতে কোন কাজ হয়। একটা কৌশল কিন্তু খুব রপ্ত আছে আমাদের। ইদানীং এটা বেশ চলছে। লোক দেখানো বা পরিবেশ শান্ত করার জন্য কয়েকদিন, দরকারবোধে মাসখানেক এগুলো নিয়ে বেশ শোরগোল চলবে জেনে কর্তারা বড় বড় কথা বলবেন। কিছু এ্যাকশন-রিএ্যাকশনও শো করবেন । তারপর? এক সময় আপনারা যখন জুড়িয়ে যাবেন, তারা উনানটাও নিভিয়ে দেবেন। প্রয়োজনে আপনার বিবেকের চুলা কিনে নেবেন তারা। ব্যস। এরপর ওয়ান ফাইন মর্নিং আপনি জানবেন, কান ধরে যে দাঁড়িয়েছিল সে টিচারই মূলত দায়ী। নিজের ছোট কান লম্বা করার জন্য আর কেউ কোন দিন কান ধরে দাঁড়ালে তাদেরও খবর আছে। এ তো গেল একদিক। আবার দেখুন সামাজিক মিডিয়ায় এখন কোন কিছু গোপন থাকে না। এর সুফলে কত বড় বড় কাজ হয়। আবার এর বিপরীত দিকও আছে। এই যে দেশে-বিদেশে মী টু নামে কা-কারখানা চলছে, তার সব কি সমর্থনযোগ্য? আপনি নিজেকে নারী বলে অনিরাপদ মনে করছেন, আবার রাত আড়াইটায় একজন পরিচালকের বাসায় যাচ্ছেন একা। কেন? এই প্রশ্ন করলে আপনিও নারী নির্যাতক হয়ে যেতে পারেন। আপনি সিনেমায় নেমেছেন, প্রাপ্তবয়স্ক ছবিতে অভিনয় করছেন সেটা ঠিক থাকলে পরিচালকের ঘনিষ্ঠ দৃশ্য বোঝানোর ব্যাপারে আপত্তি কেন? পুরুষ যেমন একদিকে ক্রমাগত হায়েনা হয়ে উঠছে, আরেকদিকে নারীরাও কম যায় না। বলছিলাম সামাজিক মিডিয়ার কথা। এর সুফলে আমরা সম্প্রতি যে তরুণীকে দেখলাম সে আসলে কি বার্তা দিয়ে গেল আমাদের? মধ্যরাতে রাস্তায় কারা চলাচল করতে পারবে বা কারা পারবে না, এমন কি কোন আইন আছে? আমি দীর্ঘকাল এমন এক দেশে থাকি যেখানে মধ্যরাতে নারী ট্যাক্সি চালক ও যাত্রী অধিক নিরাপদ। দুনিয়ার যত দেশে গেলাম তার বেশিরভাগ দেশেই নারীদের অধিকার আর স্বাধীনতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। পাশের পশ্চিমবঙ্গের কথাই ধরুন না কেন। সেখানে দিদিদের কাছে দাদারা রীতিমতো অসহায়। তা ছাড়া সেখানকার পথঘাট এমনকি বাজার-হাটেও নারীদের আধিপত্য। আমরা কিনা বলছি আমরা তাদের ছেড়ে এগিয়ে চলেছি। আমাদের সমাজ ও দেশ নানা সূচকে তাদের ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। তাহলে আমাদের রাজধানীর রাজপথে একজন তরুণীকে এ জাতীয় ব্যবহারের স্বীকার হতে হচ্ছে কেন? যারা মনে করছে সে একা, তাদের বলি সিএনজির ড্রাইভার কি রোবট না মানুষ? একা হোক আর দোকা হোক মেয়েটি বার বার বলছিলো, লাইট ফেললে আলো ফেললে ব্যাগে ফেলুন, আমার মুখের ওপর কেন? মুশকিল হলো টকশোতে চরিত্রহীন বললে যে অপরাধ, সিএনজিতে মধ্যরাতে কোন মেয়েকে খারাপ মেয়ে বললে সেটাও অপরাধ হয় কি না, তা নিয়ে আমাদের কোন ধারণা নেই। কোন্টা বললে কি হয় যেমন জানি না তেমনি বলাও অনিরাপদ বৈকি। কোন অপরাধ কিংবা অপরাধীর দিকে একটু বেশি, একটু কম হওয়ার সুযোগ নেই। কথা একটাই। দেশ এগুচ্ছে, সমাজ এগুচ্ছে, তাহলে আমরা এগুচ্ছি না কেন? রাজনীতি এর উত্তর দিতে পারবে না। পারবে না, কারণ তারা তক্কে তক্কে থাকে সুযোগ নেবে বলে। একা শেখ হাসিনা সব সামাল দেবেন এটা ভাবা যেমন অন্যায়, তেমনি তাঁর ওপর এত দায় চাপানোও অযৌক্তিক। এটা জানার পরও তাঁর ওপর চাপ কমছে না। কারণ বাকি জায়গাগুলো হয় তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে, অথবা তাদের সাধ্য নেই সমাধান করার। সমাজ ও জাতির সঙ্গে রাষ্ট্রের দূরত্ব বাড়ছেই। এই ক্রমবর্ধমান দূরত্ব একসময় ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। মনে রাখা ভাল, আমাদের চেয়ে ঢের এগিয়ে থাকা রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো সামাজিক কারণেই মুখ থুবড়ে পড়েছিল, যার বেশিরভাগই এখন একাধিক রাষ্ট্র। তারপরও তাদের সমস্যার সমাধান হয়নি। একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধ কিংবা কলহে লিপ্ত তারা। আবার সমাজ যদি পশ্চাৎপদ হয় এবং মৌলবাদী হয়, তাহলে কি হতে পারে তার বড় নজির মধ্যপ্রাচ্য। তেল ও সম্পদে বিত্তশালী হওয়ার পরও তাদের হাল করুণ। নেতারা আকছার মারা পড়ছে বিদেশীদের হাতে। একের সঙ্গে অন্যের বিবাদে না আছে ঐক্য, না কোন শান্তি। একসময় এসব দেশে যাওয়া ছিল বাংলাদেশীদের জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপার। আজ তারা নিজেরাই নিজেদের দেখভাল করতে পারে না। অর্থনৈতিক উন্নয়ন একটি দেশকে পেটে-পিঠে ভাল রাখলেও তার মন বা চিত্তও ভাল রাখার দরকার আছে। মানুষের মন বড় সাংঘাতিক। কখন কি কারণে সে বিগড়ে যায় বা বিগড়ে গেলে কি হতে পারে, সেটা আমাদের সমাজপতিরা ভাল জানেন। আমাদের মতো দেশে অপরাধ দমন কিংবা নিরাপদ সমাজ গঠন মুখে বলা যত সহজ, কাজে ততটাই কঠিন। সবচেয়ে বড় সমস্যা জনসংখ্যা। ওইটুকু জমিনে এত মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা ঈশ্বরের জন্যও দুঃসাধ্য। তারপরও নিয়ম বা শৃঙ্খলার বিকল্প নেই। এক সময় তো তা ছিল। আমরা যখন বড় হচ্ছিলাম, আমাদের দেশে টাকা পয়সার সঙ্কট ছিল বটে, ভালবাসা মায়া-মমতার সঙ্কট ছিল না। আজ ঠিক তার উল্টো। মানুষের হাতে টাকা আর টাকা, কিন্তু তার বিবেক মরে গেছে প্রায়। তার চিত্তে শান্তি নেই। অনিরাপদ সমাজে তাদের সন্তানদের নিয়ে তারা আজ উদ্বিগ্ন। যাদের তারা টিভিতে দেখেশুনে বড় বড় মানুষ বলে জানে, তাদের আচরণে তারা ভয় পেয়ে যায়। সে ভয় অমূলক কিছু নয়। তাই আজ ভয় তাড়ানোর কাজটাই জরুরী। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম একদিকে যেমন আমাদের কাছ থেকে কলহ বিবাদ আর অতীতের গ্লানি দেখে ক্লান্ত, আরেকদিকে ওই তরুণীর মতো তাদের বুকের ভেতর জমে আছে সাহস। এদের কাছেই যেতে হবে আমাদের। এরাই পারবে এ দেশের জন্য এমন ফর্মুলা বের করে দিতে, যার ভেতর সমাজ রাষ্ট্র ও অর্থনীতির মেলবন্ধন থাকবে। থাকবে সবাই মিলে ভাল থাকার চাবিকাঠি। বয়সী মানুষদের টিভি ডিবেটিং রাজনীতিবিদদের বকবকানি বা সমাজ ও রাষ্ট্রে মানুষদের ভয় পাওয়া বন্ধ হলে অনেক সমস্যার সমাধান সহজ হয়ে উঠবে। তা না হলে এত আয়-উন্নতি সবই যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়তে পারে একদিন। দেশ ও সমাজের মানুষকে ভাল রাখা, তাদের ভাল থাকাই হোক সকলের অঙ্গীকার।
×