ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ফুলে ফুলে ভরে গেল কফিন

শ্রদ্ধা ভালবাসায় শিল্পী কালিদাস কর্মকারকে বিদায়

প্রকাশিত: ১১:২০, ২২ অক্টোবর ২০১৯

শ্রদ্ধা ভালবাসায় শিল্পী কালিদাস কর্মকারকে বিদায়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নিরীক্ষাধর্মী চিত্রকর্মের জন্য বিখ্যাত ছিলেন শিল্পী কালিদাস কর্মকার। গতিময় জীবনে প্রতিনিয়ত নিজেকে ভাঙতেন তার ক্যানভাস আর শিল্পকর্মে। দেশের কৃষি সমাজের গতিময়তাকে তিনি যেমন করে তুলে এনেছেন তার ক্যানভাসে তেমনিভাবে এর প্রভাব ছিল তার জীবনেও। নিজের সৃজন ভুবন ছেড়ে হঠাৎ করেই ১৮ অক্টোবর চলে গেছেন আত্মমগ্ন এ শিল্পী। হাসিখুশিতে ভরা মানুষটিকে চিরবিদায় জানাতে এসে কেঁদেছেন অনেকে। হৃদয়ের শ্রদ্ধা-ভালবাসা আর ফুলে ফুলে ভরিয়ে দিয়েছেন তার কফিন। চারুকলা ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সবুজবাগে বরেদেশ্বরী কালীমন্দির শ্মশানে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। সোমবার সকাল নয়টায় রাজধানীর বারডেম হাসপাতালের হিমঘর থেকে কালিদাস কর্মকারের মরদেহ নিয়ে আসা হয় ঢাকেশ্বরী মন্দিরে। সেখান থেকে তার মরদেহ নিয়ে আসা হয় চারুকলা প্রাঙ্গণে। শিল্পী, চারু শিক্ষক ও চারু শিক্ষার্থীরা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান বরেণ্য চিত্রশিল্পীকে। এখানে কালিদাস কর্মকারের প্রতি চারুকলা অনুষদের পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন। এছাড়া শ্রদ্ধা নিবেদন করেন চারুকলা অনুষদের অঙ্কন ও চিত্রায়ন বিভাগ, ছাপচিত্র বিভাগ, ভাস্কর্য বিভাগ, কারুশিল্প বিভাগ, গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগ, প্রাচ্যকলা বিভাগ, মৃৎশিল্প বিভাগ এবং শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। এছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে কালিদাস কর্মকারের প্রতি শ্রদ্ধা জানান প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী, শিল্পী হাশেম খান, রফিকুন নবী, সৈয়দ আবুল বারক্ আলভী, কনকচাঁপা চাকমা, রোকেয়া সুলতানা, শিল্পী হামিদুজ্জামান খান, মনিরুল ইসলাম, শহীদ কাজী, ফরিদা জামান, নেপালি বন্ধু ডি প্লামা, ডাকসুর সাবেক ভিপি আখতারুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আখতারুজ্জামান ও উপ-উপাচার্য ড. মুহাম্মদ সামাদ, নাট্যজন লিয়াকত আলী লাকী, প্রাবন্ধিক মফিদুল হক প্রমুখ। ড. গওহর রিজভী বলেন, আমরা শুধু একজন শিল্পীকে নয়, পরম বন্ধুকে হারিয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে কালিদাস কর্মকারের সহপাঠী ছিলেন প্রখ্যাত ভাস্করশিল্পী হামিদুজ্জামান খান। অশ্রুসজল চোখে শেষ দেখা দেখছিলেন প্রিয় বন্ধুকে। বললেন, ও আমার শুধু বন্ধু নয়। আমার প্রাণের বন্ধু। বাড়ি থেকে প্রথম যেদিন চারুকলা অনুষদে পা রেখেছিলাম সেদিন থেকেই ওর সঙ্গে পরিচয়, বন্ধুত্ব। একটু থেমে বললেন, কালিদাস আন্তর্জাতিকমানের শিল্পী ছিল। বাংলাদেশের চিত্রকলায় আধুনিকতার ছোঁয়া দিয়েছিল সে। এ দেশের স্থাপনাশিল্পের পথিকৃৎ ছিল ও। আমৃত্যু ক্লান্তিহীন কর্মময় এক জীবন পার করেছে সে। শুধু তাই নয়, নতুন শিল্পীদের সবসময় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে কালিদাস। ছাত্রের প্রয়াণে ব্যথিত শিক্ষক রফিকুন নবী বললেন, চারুকলায় বেশ কয়েক বছর তাকে আমি দেখেছি। সবসময় এক ধরনের কর্মব্যস্ততা তাকে তাড়িয়ে বেড়াত। এত এত মাধ্যমে সে কাজ করেছে, মাঝে মধ্যে নিজের কাছেই বিস্ময় মনে হতো। তার চলে যাওয়াটা আকস্মিক। এটি আমাদের পীড়া দিয়েছে। তার চলে যাওয়াটা শিল্পকলার জন্য অপূরণীয় এক ক্ষতি। শিল্পী হাশেম খান বলেন, কালিদাস কর্মকার বাংলাদেশের শিল্পকে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত করার জন্য নিরলস কাজ করেছেন। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এ বিষয়টি তাকে কেউ বলে দেয়নি। তিনি নিজেই কাজটি করেছেন। শিল্পী মনিরুল ইসলামের কাছে কালিদাস কর্মকার মানে একটি প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর এক মানুষের নাম। এ তথ্য জানিয়ে তিনি বললেন, প্রাণচঞ্চলতা আর উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে সবসময় ছবি আঁকত সে। সে সময়ের চেয়ে এগিয়েছিল। কেউ কখনও তাকে ক্লান্ত হতে দেখেনি। চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, কালিদাস কর্মকার বহু ধরনের কাজ করতেন। সেটিকে একটি ভিন্নমাত্রা দিতেন। নিজে যেমন চিত্রকর্মের ফর্ম গড়েছেন, ঠিক তেমনিভাবে সেটিকে ভেঙে আবার নতুন কিছু করেছেন। শিল্পমাধ্যমের এমন কোন জায়গা নেই, যেখানে তিনি কাজ করেননি। শিল্পী রোকেয়া সুলতানা বললেন, কালিদাস কর্মকার একটি সময়ের নাম, একটি প্রতীকের নাম। তিনি তার কর্মে চিরজাগ্রত থাকবেন তারুণ্যের উচ্ছলতা নিয়ে। পটুয়া কামরুল হাসানের সঙ্গে কালিদাস কর্মকারের সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে প্রাবন্ধিক মফিদুল হক বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতাউত্তর কালিদাস কর্মকার এক ভিন্নমাত্রার কাজ নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছিলেন। তার কথা মনে হলে পটুয়া কামরুল হাসানের কথাও চলে আসে। তাদের সম্পর্কটা ছিল গুরু-শিষ্যের মতো। সেখান থেকে তারা অনেক শিল্পকর্ম আমাদের উপহার দিয়েছিলেন। তার আসাটা যেমন হঠাৎ করে, চলে যাওয়াটাও হঠাৎ করে। রেখে গেছে তার অজ¯্র সৃষ্টিকর্ম। সেগুলো সঠিকভাবে সংরক্ষণ এবং নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য কাজ করতে হবে। কালিদাস কর্মকারের সৃজনকর্মকে সংরক্ষণের জন্য সবার সহযোগিতা চেয়ে তার বড় মেয়ে কঙ্কা কর্মকার বলেন, বাবা প্রতিমুহূর্তে দেশ ও দেশের শিল্পকর্মকে প্রচার করেছেন। এখন থেকে প্রতিবছর বাবার নামে আমরা দুই বোন প্রদর্শনী করব তার সৃজনশীল কাজ সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। যার কারণে মানুষ তাকে চিরদিন মনে রাখবে। শহীদ মিনারে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদের ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত হয় নাগরিক শ্রদ্ধানুষ্ঠান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন তার দুই মেয়ে কঙ্কা কর্মকার ও কেয়া কর্মকার। সাংগঠনিকভাবে শ্রদ্ধা জানায় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদ, সম্প্রীতি বাংলাদেশ, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, গ্যালারি কসমস, ঢাকা গ্যালারি, বিসিক নকশাকেন্দ্র, শিল্পকলা একাডেমি, বিটিভি, ঢাবি ভাস্কর্য বিভাগ প্রাক্তনী সংঘ, ঢাকা আর্ট সার্কেল, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘরসহ বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে শেষ এ শ্রদ্ধানুষ্ঠান। শহীদ মিনার থেকে কালিদাস কর্মকারের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানীর সবুজবাগের বরেদেশ্বরী কালীমন্দির শ্মশানঘাটে। সেখানে তাকে দাহ করা হয়।
×