ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ডায়াবেটিস রোগীদের মাড়ির প্রদাহ বেশি হওয়ার কারণ হলো-

ডায়াবেটিস রোগীর মুখের স্বাস্থ্য

প্রকাশিত: ১৩:০১, ২২ অক্টোবর ২০১৯

ডায়াবেটিস রোগীর মুখের স্বাস্থ্য

প্লাক : মুখে খাদ্যকণা জমে থেকে যে আবরণ সৃষ্টি হয় এর নাম ডেন্টাল প্লাক। এই প্লাক লাখ লাখ অণুবীক্ষণিক জীবাণুর সমষ্টি। মুখের দুই প্রধান রোগ ডেন্টাল ক্যারিজ ও মাড়ির প্রদাহে ডেন্টাল প্লাকই দায়ী। ডায়াবেটিস রোগীদের যে কারণে ডেন্টাল প্লাক বৃদ্ধি পেতে পারে সেগুলো হচ্ছে- (১) ডায়াবেটিস রোগ দেখা দেয়ার পূর্বেই যাদের মাড়ির প্রদাহ বা দন্ত প্রদাহ থাকে তাদের প্রদাহ নিঃসৃত রস বৃদ্ধি পায় ফলে ডেন্টাল প্লাকও বাড়তে থাকে। (২) বৃহৎ ক্ষুদ্র লালা গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত রস বৃদ্ধি পায় এবং তা খাদ্যকণার সঙ্গে মিশে প্লাক তৈরি করে। (৩) দাঁত দিয়ে খাদ্যদ্রব্য চিবানোর কর্মক্ষমতা যাদের কমে যায় (ডায়াবেটিস রোগীর মাড়ির সংক্রমণ) তাদের মুখেও প্লাকের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ডায়াবেটিস রোগীদের খাদ্য নিয়ন্ত্রিত হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাড়ির ও দাঁতের ধারণ শক্তি ও প্রতিরোধ শক্তি কমে যায় ফলে খাওয়ার সময় ব্যথা অনুভূত হয়, তাই চিবিয়ে খাবার প্রবণতাও হ্রাস পায়। এ সবের জন্য ডায়াবেটিস রোগীদের প্লাক বৃদ্ধিও তাড়াতাড়ি হয়। ডায়াবেটিস রোগীদের রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে যেমন তিনটি উ মেনে চলতে হয় যথা- উ-উরবঃ, উ-উৎঁম, উ-উরংপরঢ়ষরহব তেমনি ডায়াবেটিস রোগীদের মুখের রোগ প্রতিরোধ তিনটি উ মেনে চলা প্রয়োজন। খাদ্য : প্রথমেই উরবঃ বা খাদ্য নিয়ে আলোচনা করা যাক। বিজ্ঞানের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে শর্করা বা চিনি জাতীয় খাদ্য গ্রহণের পর মুখ পরিষ্কার না হলে কিছুক্ষণের মধ্যেই এক ধরনের অম্ল বা এসিড তৈরি হয় এবং তা দাঁতকে ক্ষয় করতে থাকে। এই ক্ষয় পদ্ধতির নামই ডেন্টাল ক্যারিজ। তা ছাড়া খাদ্যকণা জমে থাকায় যে আবরণ বা প্লাক সৃষ্টি হয় সেই প্লাক ধীরে ধীরে মাড়িকে আক্রমণ করে ফলে মাড়ির প্রদাহ বা দন্তাবরক প্রদাহ শুরু হয়। প্লাক প্রতিরোধ : ১. মূল আহার গ্রহণের (সকালের নাস্তা-দুপুরের খাবার-রাতের খাবার) মধ্যবর্তী সময়গুলোতে চিনি বা শর্করা জাতীয় খাদ্য (যেমন চকোলেট, বিস্কুট, লজেন্স, কেক, টফি, চুইংগাম, আইসক্রিম, ম-া মিঠাই) খাওয়া বন্ধ করা প্রয়োজন। ২. আহার গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই ভালভাবে কুলিকুচি, মুখ পরিষ্কার ও দুই বেলা সকালে ও রাতে দাঁত ব্রাশ করা প্রয়োজন। ৩. ডিসক্লোজিং ট্যাবলেট পানিতে গুলে নিয়ে ওই পানিতে কুলিকুচি করলে খাদ্যকণাগুলোর রং পরিবর্তন হবে (লাল রং) তখন প্লাক শনাক্ত করে খাদ্যকণাকে ব্রাশ বা মেছওয়াক করলে সহজেই পরিষ্কার হয়। ওষুধ : ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে যেমন নিয়মিত ইনসুলিন বা ট্যাবলেট জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা প্রয়োজন তেমনি দন্ত ক্ষয় রোগ প্রতিরোধ বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কার ফ্লুরাইড ব্যবহারের মাধ্যমে। আমাদের দেশে ফ্লুরাইডযুক্ত টুথপেস্টই একমাত্র সহায়ক। ডেন্টাল ক্যারিজ প্রতিরোধ : ১. নিয়মিত দুই বেলা সকালে ও রাতে (আহারের পর) ফ্লুরাইডমিশ্রিত টুথপেষ্ট দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করা প্রয়োজন। ২. ফ্লুরাইড ট্যাবলেট, ফ্লুরাইড জেল অথবা ফ্লুরাইড মিশ্রিত পানি গ্রহণ করা (অবশ্যই নির্দিষ্ট পরিমাণে)। পানিতে সাধারণতঃ ফ্লুরাইডেশন করা হয় ১ মিলিয়ন এর মধ্যে ১ ভাগ ফ্লুরাইড যুক্ত করে। কারণ নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি ফ্লুরাইড গ্রহণ দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক। শৃঙ্খলা : ডায়াবেটিস রোগীদেও যেমন নিয়মিত ব্যায়াম, পরিমিত আহার, রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষা করতে হয় তেমনি মুখের রোগ প্রতিরোধেও কতগুলো নিয়ম মেনে চলতে হয়। দাঁত ও মাড়ির রোগ প্রতিরোধ : শৃঙ্খলা ১. দুইবেলা সকালে ও রাতে (আহারের পর) দাঁত পরিষ্কারের সময় আঙুল এর সাহায্যে অন্তত ২-৩ মিনিটকাল মাড়ি মালিশ করা, যাতে মাড়ির ফাঁকে ফাঁকে জমে থাকা খাদ্যকণাগুলো চাপে বেরিয়ে আসে ও রক্ত সঞ্চালন বেগ স্বাভাবিক থাকে। ২. রোগ প্রতিরোধ আহারের মধ্যবর্তী সময়ে শর্করা বা চিনি জাতীয় খাদ্য পরিহার করা প্রয়োজন (খেলেও সঙ্গে সঙ্গে দাঁত ও মুখ পরিষ্কার করে ফেলা)। ৩. নিয়মিত একজন দন্তরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে (বছরে দুইবার ৬ মাস অন্তর) দাঁত, মাড়ি ও মুখগহ্বরের অবস্থা পরীক্ষা করানো প্রয়োজন। এর ফলে প্রাথমিক অবস্থায় রোগের লক্ষণ ধরা পড়তে পারে এবং অল্প ও সহজ চিকিৎসায় ভাল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু মাড়ির প্রদাহ বা দন্ত ক্ষয় রোগ অতিমাত্রায় বাড়তে থাকলে চিকিৎসা জটিল হয় এবং ব্যয় দ্বিগুণ হয়। পরবর্তীতে দাঁত হারানোর সম্ভাবনাও বেশি থাকে। যদি ডায়াবেটিস রোগীরা এই ত্রিরতেœর (তিনটি ডি) সঙ্গে পরিচিত হয়ে যান এবং নিয়মিতভাবে ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখেন তবে দাঁত ও মাড়ি সব সময় সুস্থ থাকবে। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য দাঁত বা মুখের যতেœর কয়েকটি সতর্কীকরণ ইঙ্গিত : ১. সর্বপ্রথমেই ডায়াবেটিস রোগটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখবার চেষ্টা করা প্রয়োজন। রক্তের শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখাই হচ্ছে দাঁত ও মাড়ির রোগ প্রতিরোধের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ। মাড়ির অতিরিক্ত প্রদাহ অনেক সময় ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রিত রাখতে অনেক অসুবিধার সৃষ্টি করে। যদি কোনভাবে কখনো দাঁত ও মাড়ির প্রদাহ শুরু হয় তবে ওই ঘা শুকাতে সার্জন এর কাছ থেকে আপনার মুখের যতেœর জন্যে কি কি করা প্রয়োজন তাও জেনে নেয়া প্রয়োজন। ২. প্রতি ছয় মাস অন্তর একজন ডেন্টাল সার্জনকে দিয়ে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। ডেন্টাল সার্জনকে অবশ্যই আপনার ডায়াবেটিস রোগের কথা বলে রাখবেন। যাতে আপনার দাঁত ও মাড়ি সুস্থ থাকে সে জন্য ডেন্টাল সার্জনের কাছ থেকে আপনার মুখের যতেœর জন্য কি কি করা প্রয়োজন তাও জেনে নেয়া প্রয়োজন। ৩. প্রতিদিন দুইবেলা সকালে ও রাতে দাঁত ব্রাশ এবং মাড়ির জন্য প্রয়োজন একটি নরম টুথপেস্ট। ব্রাশটিকে উপরের পাটির দাঁত থেকে নিচের পাটির দাঁত আবার নিচের পাটি থেকে উপরের পাটির দিকে, এভাবেই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দাঁত ও মাড়ি পরিষ্কার করা বিজ্ঞানসম্মত। দুই দাঁতের ফাঁক থেকে খাদ্যকণা বের করে দেবার জন্যে ডেন্টাল ফ্লস বা এক ধরনের সুতা ব্যবহার করা ভাল। ৪. কখনও যদি আপনার মাড়ি থেকে দাঁত ব্রাশের সময় বা খাবার খাওয়ার সময় রক্ত বের হয় তবে তা আপনার মাড়িতে প্রদাহের পূর্ব লক্ষণ কিনা বোঝার জন্য অবশ্যই একজন ডেন্টাল সার্জনের পরামর্শ গ্রহণ প্রয়োজন। মনে রাখবেন প্রতিকারের চাইতে প্রতিরোধই শ্রেয়, সস্তা ও নিরাপদ। অধ্যাপক ড. অরূপ রতন চৌধুরী ১৫/এ, গ্রীন স্কয়ার, গ্রীন রোড, ঢাকা-২০৫ ফোন : ০১৮১৯২১২৬৭৮
×